দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ৯ আগস্ট, ২০২৩ at ১০:৩৪ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

অস্বাভাবিক গতিতে ছুটছিল আমার ট্রেন। ভিতরে বসে তীব্র গতি টের না পেলেও আমি বেশ বঝুতে পারছিলাম যে, ট্রেনটিকে ঘিরে কি ঝড়ই না বাইরে বয়ে যাচ্ছে! ঘন্টায় তিনশ’ দশ কিলোমিটারের গতিবেগ যে দুনিয়ার অনেক কিছুকেই লন্ডভন্ড করে দিতে পারে তাও বেশ বুঝতে পারছিলাম। তবে আমাদের ট্রেন কোনকিছুকে ধ্বংস না করে নিজের পথেই ছুটছে। ট্রেনের অন্তত হাজার দুয়েক মানুষকে গন্তব্যে পৌঁছে দেয়ার জন্যই দুরন্ত এই গতি। ট্রেনটি এত বিপুল গতিতে ছুটলেও ভিতরে বসে তা টের পাওয়ার কোন উপায় ছিল না। ডিজিটাল ডিসপ্লেতে কেবল ট্রেনের গতি দেখাচ্ছিল। সেখান থেকেই যা জানা!

আগেই বলেছি ট্রেনের জানালার কাচে ব্যবহৃত হয়েছে বিশেষ ধরণের প্রযুক্তি। যাতে এতো বেপরোয়া গতির ট্রেনের ভিতরে বসেও বাইরের সবকিছু অতি স্বাভাবিক লাগছিল। হঠাৎ মনে হলো, কাচের প্রযুক্তির জন্য হয়তো বাইরের সবকিছু স্বাভাবিক দেখছি কিন্তু ভিতরে কফির কাপ নিয়ে এই যে চুক চুক করছি সেটাওবা স্বাভাবিক থাকছে কেমনে! কফির কাপতো নড়ছে না। ৫০/৫৫ কিলোমিটার বেগের ট্রেনে বসে কফি খেতে তিনবার কাপ উল্টায় তো পাঁচবার গায়ে পড়ে। অথচ ৩১০ কিলোমিটারের গতিঝড়েও ট্রেনের সিটে কফির কাপে কোন নড়ন চড়ন নেই। কত শক্তিশালী শক এবজরভার ট্রেনটিতে ব্যবহৃত হয়েছে তা ভাবছিলাম। এতো গতি, এতো বেগ,এতো নড়াচড়া সবই চাকার সাথে লাগানো ছোট্ট স্প্রিংটি হজম করে নিচ্ছে! ট্রেনের ভিতরে বসে থাকা যাত্রীকে একটুও ধাক্কা লাগতে দিচ্ছে না। এমন অর্জনের পর কী ‘চীনা মাল’ বলে অবজ্ঞা করার সুযোগ থাকে!

কফি শেষ করে আমি আবারো কুমড়ো বিচির প্যাকেটে হাত দিলাম। চিফসের মতো প্যাকেটটির ভিতর থেকে একটি একটি বিচি নিয়ে কুটুস কুটুস করতে খারাপ লাগছিল না। আমার চোখ জানালার বাইরে। উদাসী চোখে আমি চীনের কৃষি বিপ্লব দেখছিলাম। ফলে ফলে ভরে থাকা এক একটি বাগান আমাকে চুপি চুপি বলে দিচ্ছিলো আমাদের অক্ষমতার কথা। কৃষিপ্রধান দেশ হয়েও যে আমরা চীনা ফলের উপর কী নিদারুণভাবে নির্ভরশীল তাই যেনো জানিয়ে দিচ্ছিলো।

আচমকা ফোন বেজে উঠলো। আমাকে ফোন করার তেমন কেউ নেই। পকেট থেকে ফোন বের না করেই বুঝতে পারছিলাম যে, গুয়াংজু থেকে জাহেদ ভাই ফোন করেছেন।

হ্যালো বলতেই জাহেদ ভাই বললেন, ট্রেন একদম ঠিকঠাকভাবে পৌঁছে যাবে। স্টেশনে জুবায়ের থাকবে। আপনি এলোমেলো না ঘুরে সবাই যেদিক দিয়ে বের হয় সেপথে এগুতে থাকবেন। জুবায়ের আপনাকে খুঁজে নেবে। আপনি ট্রেন থেকে নেমে জুবায়েরকে একটি ফোন করবেন।

জাহেদ ভাই মনে করছেন আমি হারিয়ে যাবো। আমার সেই ভয় নেই। চীনে এসেছি পর্যন্ত ভাষাগত সমস্যায় কিছু প্রতিকূলতা মোকাবেলা করলেও হারিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থায় পড়িনি। তাছাড়া ঠিকানা এবং হাতে নেটসহ একটি মোবাইল থাকলে হারানোর সুযোগ কই। আমি মনে মনে হাসলাম। পৃথিবী সত্যিই আঙ্গুলের ডগায় চলে এসেছে।

আমাদের ট্রেন ছুটছিল। গতিতে কোন হেরফের নেই। একই গতিতে ছুটছে ট্রেনটি। কী করে সম্ভব! আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো বাইরে তাকিয়ে সাতরাজ্যের সব ভাবনা ভাবছিলাম। চীনের নানা অঞ্চলের নানা স্মৃতি ভাসছিল চোখে। কত বড় দেশ! কত মানুষ, কত সম্পদ! চারদিকে কত সমৃদ্ধি!!

ট্রেন ছুটছিল। সবকিছু ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু একেবারে আচমকা প্রচন্ড হৈ চৈ শুরু হলো। চিৎকার এবং চেঁচামেচিতে কান পাতা দায় হয়ে পড়লো। অচিন ভাষা এক কর্কশ লাগছিল যে আমার ইচ্ছে করছিল কানে হাত দিতে। কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। শুধু দেখছিলাম যে, তিন চারজন মানুষ প্রচন্ড শোরগোল করছেন। তারা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করছিল। ক্রমে তা যেনো সংক্রমিত হচ্ছিল। আমার মাত্র কয়েকসিট পরেই এই ঘটনা। এখন তা যদি ক্রমে এদিকেও সংক্রমিত হয় তাহলে আমার বিপদ হবে। হাতাহাতির মতোও কী শুরু হলো? চরম শোরগোল চলছিল। একজন যেনো অপরজনের ঘাড় মড়কে দেবেন! কিন্তু কি নিয়ে এই ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হলো বুঝতে পারছিলাম না। পাশের জনকে জিজ্ঞেস করবো সেই সুযোগও ছিল না। আমি কিছুটা শংকিত হয়ে শোরগোল দেখতে লাগলাম।

কিভাবে যে খবর পেলো কে জানে! ইউনিফর্ম পরিহিত বেশ শক্তসমর্থ্য চারজন মানুষ অনেকটা ঝড়ের বেগে ছুটে আসলেন। তারা কি কি সব বলে লোকগুলোকে শান্ত করে ফেললেন। অল্পক্ষণের মধ্যেই ট্রেনের পরিবেশ একেবারে শান্ত হয়ে গেলো। যাত্রীদের সকলেই নিজেদের কাজে মগ্ন হলো, ট্রেনটি ছুটে চলছিল।

নানাধরনের পণ্যের পসরা নিয়ে তরুণী আবারো ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে সামনে দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। আমার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কফি নিলাম। আসলে আমার আরো কিছু খাবার খেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কি খাবো বুঝতে পারছিলাম না। তরুণীর কাছে কি কি খাবার আছে, সেগুলোর নাম ধামই বা কি তাও জানি না। আবার কোন খাবারের ভিতর যে কি দেয়া আছে তাও বুঝতে পারছিলাম না। এতে করে ক্ষুধা থাকলেও খাবার কেনার সুযোগ পাচ্ছিলাম না। নিজের বোতলের পানি এবং কফির কাপে নিরীহ চুমুক দেয়া ছাড়া আমার যেনো আর কিছু করার ছিল না। ট্রেনের গতি কমে আসছিল। বুঝতে পারছিলাম যে, হালকা করে ব্রেকে পা দেয়া হচ্ছিল। আড়াইশ’ কিলোমিটার বেগে ছুটছে ট্রেন। ট্রেনের গতি কমার অর্থ আমরা গন্তব্যের কাছাকাছি চলে এসেছি। ঘড়ির কাঁটাও একই ইঙ্গিত দিচ্ছিল। ঘন্টা খানেকের মধ্যেই আমরা গুয়াংজু পৌঁছে যাবো। এতো আগ থেকে ব্রেক কষা শুরু হয়েছে! মনে মনে হাসলাম। এভাবে গতি না কমালেতো গুয়াংজু স্টেশন উড়িয়ে দিয়ে ট্রেন হংকং সীমান্তের দিকে ছুটবে!

ট্রেনের গতি আরো কমে গেলো। দেড়শ’ কিলোমিটারে নেমে আসলো। ক্রমে আরো। একশ’ কিলোমিটার বেগে বেশ কিছুক্ষণ চলার পর কড়া ব্রেক কষার মতো করে গতি নিয়ন্ত্রণ করা হলো। বুঝতে পারলাম যে, অল্পক্ষণের মধ্যেই আমরা গুয়াংজু ছুঁয়ে ফেলবো। গতি আরো কমলো। আশ্চর্য হলাম যে, ঘড়ির কাঁটা ধরেই ট্রেনটি থেমে গেলো। এক মিনিটও এদিকওদিক হলো না। প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটারের একটি যাত্রায় কি করে এভাবে মিনিট সেকেন্ড হিসেব কষে সময় ঠিকঠাক রাখা সম্ভব কে জানে!

বগির দরোজা খুলে গেলো। যাত্রীরা হুড়োহুড়ি করে নামতে শুরু করলেন। চীনাদের সাথে আমাদের চরিত্রগত বেশ কিছু মিল দেখতে পেলাম। ট্রেন স্টেশনে পৌঁছার আগ দিয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়া এবং থামার সাথে সাথে হুড়োহুড়ি করা। বিমানেও আমরা একই কাজ করি। বিমান ল্যান্ড করার সাথে সাথে আমাদের অনেকেই দাঁড়িয়ে যান। দরোজা খোলার আগে হুমড়ি খেয়ে পড়ার উপক্রম হয়। আমি বসে থাকলাম। খেয়াল করে দেখলাম যে, আমার পাশের ভদ্রলোকের মাঝেও কোন বিকার নেই। তিনিও বসে রয়েছেন।

বগির ভিড় কমে গেলো। আমরা সামনে এগুলাম। প্ল্যাটফরমে নেমে সকলের সাথে আমিও সামনের দিকে হাঁটতে লাগলাম। ফোন করলাম জুবায়েরকে। এক্সিট পথ ধরে সামনে আসতেই জুবায়েরের সাথে দেখা হয়ে গেলো। একটি বড় গেটের পাশে আরো কিছু লোকজনের সাথে জুবায়ের দাঁড়িয়েছিল।

জুবায়েরকে সামনে দেখে আমি যেনো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। কতদিন পর একজন বাঙালি দেখলাম। বাংলায় কথা বলার জন্য আমার পরাণটি আনচান করে উঠলো। কেমন আছো জুবায়ের বলতেই পরাণটি ভরে গেলো। জুবায়ের আমার হাত থেকে ব্যাগটি টেনে নিয়ে সামনের দিকে পা বাড়ালো। (চলবে)

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসংসারের বোঝা বহন করতে পারাই পুরুষত্বের অহংকার!
পরবর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধু : ইতিহাসের মহানায়ক