(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
ট্রেন ছুটছে। প্রচন্ড গতি। তিনশ’ কিলোমিটারেরও বেশি বেগে এগুচ্ছে আমাদের ঝড়ো ট্রেন। ঝড়ের গতির চেয়ে বহু বেশি গতি এই ট্রেনের। এমন গতিতে ঝড় হলে গাছগাছালীতো দূরের কথা, বহু দালান কোটাও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। কিন্তু ট্রেনটি দিব্যি ছুটছে। রেল লাইনের পাশে তেমন কোন গাছগাছালী নেই, তবে কিছুটা দূরে আমাদের মতো মাঠ ঘাট হাট সবই রয়েছে। রয়েছে ফসলি জমি, ধানের ক্ষেত, ফলের বাগান। চমৎকার প্রকৃতি, সবুজে সবুজে একাকার মাঠে কাজ করছেন কৃষক, শ্রমিক। কমলা এবং মাল্টার বাগানগুলোতে থোকায় থোকায় ঝুলছে ফল। সবুজ বাগানে হলদে হয়ে উঠা ফলগুলো বেশ লোভনীয় ভঙ্গিতে যেনো হাতছানি দিচ্ছে। আমাদের ট্রেন প্রচন্ড গতিতে ছুটলেও অত্যন্ত স্বাভাবিক দেখাচ্ছিল বাইরের দৃশ্য। জানালায় বিশেষ ধরনের কাচ ব্যবহার করায় দ্রুতগতির ট্রেনগুলোর ভিতরে বসেও বাইরের সবকিছু স্বাভাবিক দেখা যায়, এই ট্রেনেও দেখা যাচ্ছিল।
আমাদের ট্রেনটি গতির ঝড় তুলে যেভাবে এগুচ্ছে ঠিক একইভাবে বিপরীত দিক থেকেও মাঝে মাঝে ঝড় তুলে আসছিল ট্রেন। বেইজিংগামী ট্রেনগুলো নানা অঞ্চল থেকে আসছিল। পরস্পর বিপরীতমুখী দুইটি ট্রেন সমান্তরাল দুইটি লাইনে পরস্পরকে অতিক্রম করার সময় প্রচন্ড গতিতে একটি অপরটিকে কেমন যেনো ধাক্কা দেয়। এরা যেনো পরস্পরের শত্রু। একটি যেনো অপরটিকে থামিয়ে দিতে চায়। বিপরীতমুখী গতির চাপ বা বাতাসের তোড়ে ট্রেনটি যেন উড়ে যেতে চায়, থেমে যেতে চায় কিংবা চায় হুমড়ি খেতে। ক্ষণিকের এই ধাক্কা কলজের একেবারে গভীরে গিয়ে লাগে! দুইটি ট্রেন যদি একই লাইনে উঠে যায়! আর ভাবতে পারছিলাম না। কেমন যেনো ভয় ভয় লাগছিল। ট্রেনের গতি ৩০৫ কিলোমিটার!! যাওয়ার সময় এই গতি ৩০৮ কিলোমিটার পর্যন্ত উঠেছিল। এবারও নিশ্চয় তুলবে। তবে আর তিন কিলোমিটার যে কেনো উঠছে না কে জানে! নাকি এটি আরো বেশি গতিতে ছুটবে তাও শুধু সময়ই বলতে পারবে।
খাবার ভর্তি ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে এক তরুণী এগিয়ে আসছিলেন। যাওয়ার সময়ও এমন ট্রলির দেখা মিলেছিল। কফি কিনে খেয়েছিলাম। হাই–স্পিড ট্রেনে কোন হকার দেখিনি। রেলওয়ে কোম্পানির তরুণী কর্মী খাবারের একটি ট্রলিতে নানা ধরনের খাবার বিক্রি করছিলেন। সবই হালকা খাবার। কফি, চিপস, চানাচুরভাজা টাইপের। প্রক্রিয়াজাত করা খাবার। এসবের প্রতি আমার কোন ইন্টারেস্ট নেই। তবে আমার পাশের সিটে বসা ভদ্রলোক ক্রমাগত কুমড়ো বীজ এত সুন্দর করে খাচ্ছিলেন যে, আমার বেশ লোভ লাগছিল। কুমড়োর বিচিকে ভাজা করে খাবারটি তৈরি করা। দাঁত দিয়ে কুটুস কুটুস করে ভেঙ্গে ভিতরের কচি শাঁস খাচ্ছিলেন ভদ্রলোক। অনেকক্ষণ ধরে খাচ্ছিলেন তিনি। আমি আড়চোখে দেখেছি এবং ট্রলি আসলে জিনিসটি পাওয়া যায় কিনা দেখবো বলে মনস্থির করে রেখেছিলাম।
আমার পাশে যখন ট্রলি নিয়ে তরুণী দাঁড়ালেন আমি তাকে একটি কফি দেয়ার কথা বললাম। একইসাথে ভদ্রলোক যে জিনিসটি খাচ্ছে সেটি আছে কিনা জানতে চাইলাম। জিনিসটির নাম বলতে না পারায় আমি আঙ্গুলের ইশারায় ভদ্রলোকের হাতের চিপসের প্যাকেটের মতো প্যাকেটটি দেখালাম। তরুণী মাথা নাড়লেন। আমি কফির কাপটি নিয়ে মূল্য চুকিয়ে দিলাম।
তরুণী সরে যাওয়ার পর আমার পাশের ভদ্রলোক দাঁড়ালেন এবং উপরের লাগেজ স্পেস থেকে তাঁর হ্যাভারশেকটি বের করে তার ভিতর থেকে এক প্যাকেট কুমড়োর বীজ বের করে আমার দিকে বাড়িয়ে মাথাসহ ঘাড় বাঁকা করলেন। আমি যতই না না করছিলাম ততই তিনি বাঁকা হচ্ছিলেন। কারো কথা কেউ বুঝতে পারছিলাম না, তবে বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দিয়ে পরস্পরকে বুঝাতে চেষ্টা করছিলাম। এক পর্যায়ে ভদ্রলোক আমার পাশে বসে প্যাকেটটি হাতে গুঁজে দিলেন। এত আন্তরিকতার সাথে তিনি প্যাকেটটি আমাকে ধরিয়ে দিলেন যে, আমি মূল্য দেয়ার কথা মুখেও আনতে পারলাম না। অল্পক্ষণের মধ্যেই আমরা দু’জনই কুটুস কুটুস করতে লাগলাম।
ভদ্রলোককে কৃতজ্ঞতা জানালাম। ট্রলিওয়ালী রেলওয়ে কর্মী আমার পাশ দিয়ে ফেরার সময় ভদ্রলোকের জন্য একটি কফি নিলাম। আমি বেশ মুগ্ধ হলাম যে, ভদ্রলোক কফিতে কোন আপত্তি করলেন না। বেশ আনন্দচিত্তে কফি নিলেন। ভদ্রলোক আমার জন্য যে আন্তরিকতা দেখিয়েছেন তার ঋণ শোধ করা অসম্ভব। কারো ভালোবাসার প্রতিদান পুরোপুরি দেয়া যায় না। আমি সেই চেষ্টাও করলাম না। তবে একটি কফি খাওয়াতে পেরে কিছুটা হালকা লাগছিল। চীনের মানুষদের নিয়ে নানা ধরনের কথাবার্তা আমরা প্রায়শ শুনি। আমাদের চট্টগ্রামে হাজার হাজার চীনা নাগরিক কাজ করেন। আমাদের এলাকায় থাকেন। এমনকি আমি যেই এ্যাপার্টমেন্টে বসবাস করি সেখানেও চীনা নাগরিক পরিবার পরিজন নিয়ে থাকেন। তাদের সাথে আমাদের কারো তেমন কোন মেলামেশা নেই, কথাবার্তাও হয়না। লিফটে দেখা হলে মাঝেমধ্যে হাই হ্যালো বা হাসি বিনিময় ছাড়া আর তেমন কিছু হয়না। ভাষা না জানাটা এক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় হয়ে রয়েছে বলেও আমার মনে হয়। আমরা চীনা ভাষা জানি না। ওরা বাংলা জানে না। আমরা টুকটাক ইংরেজি বললেও ওনাদের অধিকাংশই ইংরেজির ধার ধারেন না। ফলে শুধুমাত্র বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দিয়ে সম্পর্ক খুব একটা জোরালো হয়না। কিন্তু ভাষার মিল না থাকলেও ট্রেনের ভিতরে ভদ্রলোক শুধু বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দিয়ে আন্তরিকতার যেই নজির স্থাপন করলেন তা অনন্য। আমি মুগ্ধ হয়ে ভদ্রলোকের সাথে একটু গল্প জমানোর চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু ব্যাপারটি একটুও এগুলো না। কেউ কারো কথা বিন্দুমাত্র বুঝতে পারছিলাম না।
প্রচন্ড গতিতে ছুটছে আমাদের ট্রেন। ৩১০ কিলোমিটার বেগে ছুটছি আমরা। এটাকে কি ‘ছুটছি’ নাকি ‘উড়ছি’ বলতে হবে বুঝতে পারছিলাম না। এমন গতিতেও যে ছুটা যায় তার কোন ধারণাই আমার ছিল না। খবরের কাগজে নানা গতির ট্রেনের কথা পড়েছি, কিন্তু সেই ট্রেনের এভাবে ছুটে চলায় রোমাঞ্চিত হচ্ছিলাম।
কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মনে নেই। হাইস্পিড ট্রেনের সিট খুব বেশি আরামদায়ক নয়। হেলান টেলান তেমন একটা দেয়া যায় না। খুব সামান্য পরিমাণে হেলানো যায়। কিন্তু এমন খাড়া সিটে কেমন করে যেনো মাথা গুঁজে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। ফোনে ঘুম ভেঙ্গে গেলো আমার। গুয়াংজু থেকে জাহেদ ভাই ফোন করেছেন। আমি কতটুকু এসেছি জানতে ফোন করেছেন তিনি। কিন্তু আবিষ্কার করলাম যে, ঘাড়ে বেশ ব্যথা হয়ে গেছে। সিটে আরাম না থাকার ফলে এমন অস্বস্তিকর ব্যথার কবলে পড়তে হলো বলে বুঝতে পারছিলাম।
জাহেদ ভাইর প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে টের পেলাম যে, আসলে ট্রেনটি এখন কোথায় বা আমি কতদূর এসেছি তা আমি জানি না। এখানে পথ ঘাট বা স্টেশন চেনার কোন সুযোগ আমার নেই। তাছাড়া পাশের জনের কাছ থেকে মানুষ নানাকিছু জানতে পারে। এখানে তাও জানার সুযোগ নেই। তাই জাহেদ ভাইকে বললাম যে, কতদূর এসেছি বুঝতে পারছি না, তবে ট্রেন ৩১০ কিলোমিটার বেগে আপনার দিকে আসছে। নির্দিষ্ট সময়ে গুয়াংজু পৌঁছে যাবো এবং কেউ একজনকে স্টেশনে পাঠানোর জন্য অনুরোধ করে ফোন রেখে দিলাম।
পানির একটি বোতল আমার কাছে ছিল। ঘুম থেকে জাগার পর পানি খেয়ে কিছুটা স্বাভাবিক হলাম। গলা কেমন যেনো শুকিয়ে গিয়েছিল। একটি কফি হলে মন্দ হতো না। কফির জন্য আনচান করতে করতে সময় পার করছিলাম। বাইরে চমৎকার আলো। দারুণ উজ্জ্বলতম একটি দিন। ট্রেন ছুটছে ধানক্ষেত বা ফসলি মাঠ পার হয়ে। বৈদ্যুতিক খুঁটি কিংবা গরু ছাগলের পাল পেছনে ফেলে এগিয়ে চলছিলাম আমরা। বেশ কিছুক্ষণ পর তরুণী আবারো ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে আসলেন। আমি কফি নিলাম। পাশের ভদ্রলোককেও ইশারা করলাম। কিন্তু তিনি দুহাত জোর করে কেমন যেনো একটি ভঙ্গি করলো। না তিনি আর কফি নেবেন না। তরুণীর হাত থেকে কফি নিয়ে আমি চুক চুক করতে লাগলাম। আমাদের হাইস্পিড ট্রেন তখন ঘন্টায় ৩১০ কিলোমিটার বেগে ছুটছিল। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।