দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ২৬ জুলাই, ২০২৩ at ৫:৫০ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

বেইজিং ওয়েস্ট রেলওয়ে স্টেশনের আট নম্বর প্ল্যাটফরমে বসে আছি। ট্রেনের অপেক্ষায় বসে থাকা ছাড়া আমার আর কিছু করারও নেই। এদিক ওদিক হাঁটতে গেলে যে হারিয়ে যাবো তা মোটামুটি নিশ্চিত। কারণ বিশ্বের নানা দেশে বহু রেলস্টেশন দেখলেও এত ব্যস্ততা আর কোথাও দেখেছি বলে মনে করতে পারছিলাম না। সচরাচর রেলওয়ে স্টেশনে প্রচুর লোক থাকে, তবে একইসাথে এত লোক গিজগিজ করতে আর কোথাও দেখিনি।

বেইজিং বসে আমি টোকিও রেলওয়ে স্টেশনের কথা ভাবছিলাম। বেশ ক’বছর আগে টোকিও রেলওয়ে স্টেশন থেকে বুলেট ট্রেনে চড়ার খায়েশ হয়েছিল আমার। নানা পথ পেরিয়ে স্টেশনে ঢুকে ভিমরি খাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। একটির পর একটি এঙেলেটরে নামতে নামতে আমাকে যখন নির্দিষ্ট প্ল্যাটফরমে এনে বুলেট ট্রেনের সামনে দাঁড় করানো হল তখন বলা হল যে, সাত তলা নিচে এসে ট্রেনের সামনে দাঁড়িয়ে আছি! জাপান প্রবাসী হীরা ভাইয়ের দিকে আমি চোখ বড় করে তাকিয়ে ছিলাম! বলেন কি! সাত তলা মাটির নিচে! তাহলে কী পাতাল রেলে চড়ছি!

গ্রাউন্ড ফ্লোর থেকে সাত তলা নিচের এই ট্রেন উপরে উঠবে কি করে! নাকি পুরো পথই পাতাল রেলের মতো সুড়ঙ্গপথে যাবে! হীরা ভাই বলেছিলেন, স্টেশনের বাইরে গিয়েই ট্রেনটি গ্রাউন্ড ফ্লোরে উঠে যাবে এবং তারপরই স্বাভাবিক রেললাইন ধরে ঘন্টায় দুইশ’ কিলোমিটারেরও বেশি গতিবেগে গন্তব্যে ছুটবে। টোকিও রেলওয়ে স্টেশনেও প্রচুর লোক কিলবিল করছিল। তবে আজ বেইজিং রেলওয়ে স্টেশনে মনে হলো টোকিওর চেয়ে বেশি মানুষ গিজগিজ করছে। টোকিওতে সাত তলা মাটির নিচে নেমেছিলাম। এখানে যে কততলায় আছি কে জানে!

কফিতে চুমুক দিতে দিতে সাতরাজ্যের ভাবনা ভাবছিলাম। কি কি সব ভাবছি! কোত্থেকে যে এত ভাবনা আসে! আহা, বিদেশে একা থাকলে কী যে অসহায় লাগে! কত স্বজনের কথা যে মনে পড়ে! বেইজিং রেলওয়ে স্টেশনে বসেও আমি একে একে নানাজনের কথা ভাবছিলাম। কফির মগে চুমুক দিতে দিতে এক অসহায় ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে রই আমি।

একেবারে আচমকা, চোখের পলক ফেলার আগেই যেনো একটি ট্রেন এসে দাড়ালো লাইনে। এত নিঃশব্দে ট্রেনটি আসলো যে সামনে আসার পরই কেবল আমি বুঝতে পারলাম যে, আস্ত একটি ট্রেন এসে গেছে। খেয়াল করে দেখলাম যে, বিশটিরও বেশি বগি লাগানো রয়েছে ট্রেনটিতে। বেশ লম্বা লম্বা বগি। যদিও জানি যে এই ট্রেনটি গুয়াংজুর নয়। এটিতে আমার চড়তে হবে না। তবুও নিজ থেকেই আমার চোখ দুইটি ওই দুই তরুণ তরুণীকে খুঁজতে লাগলো। পেয়ে গেলাম। আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে প্রায় একই সময়ে যুবকটির সাথে আমার চোখাচোখি হলো। তিনি মাথা নাড়লেন। মানে এটি নয়! আমি হাসলাম। মাথাও নড়ালাম। চোখের ভাষায় প্রকাশ করলাম কৃতজ্ঞতা।

প্রচুর লোক ট্রেনে চড়ছিল। প্রতিটি দরজায় ভিড়। ব্যাগ ব্যাগেজ নিয়েও উঠছে মানুষ। শত শত মানুষ ট্রেনটির বিভিন্ন বগিতে উঠছে। কত বগি হবে, গুণে দেখলে কেমন হয়! কিন্তু মানুষের ভিড়বাট্টা ঠেলে ঠুলে এত হাঁটাহাঁটি করতে ইচ্ছে করলো না। একটির পর একটি বগি, যেনো বগির বহর। এত লম্বা শরীর নিয়ে ট্রেনগুলো কিভাবে যে গতির ঝড় তোলে!

হাতের কফি শেষ হয়েছে। আমি মগটি বিনে ফেলার জন্য এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলাম। আচমকা যেনো ট্রেনটি লাফ দিল এবং দাড়াশ সাপের মতো ছুটে এমন করে চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেলো যে ব্যাপারটি সত্যিই দেখার মতো ছিল। ঘন্টায় তিনশ’ কিলোমিটারেরও বেশি গতিবেগে চলা এসব ট্রেনের স্পিডমিটারের কাটা ন্যানো সেকেন্ডে যে কোথায় গিয়ে ঠেকে তা আমি জানি না। স্টার্ট করতেই কী একশ’ কিলোমিটার বেগ উঠে যায়? আহা, আমাদের ট্রেন চলে ঘন্টায় ৪০ থেকে ৫৫ কিলোমিটার বেগে! হতাশার মাঝেও আমি মুগ্ধ হয়ে ট্রেনের চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। ব্‌্রডগেজ লাইনটি তখন খাঁ খাঁ করছে।

কফির মগটি ফেলতে গিয়ে দেখলাম যে, চীন বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বিশ্বমানের হয়ে গেছে। শহরের আবাসিক, বাণিজ্যিক বা অন্যান্য এলাকাগুলোর অবস্থা জানি না। ওভাবে খেয়ালও করিনি। তবে রেলওয়ে স্টেশনে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দারুণ একটি ব্যবস্থা তারা করে রেখেছে। তিন রঙের তিনটি বিন পাশাপাশি রাখা হয়েছে। সবুজ, নীল এবং ধূসর রঙের বিনগুলোতে পৃথক পৃথক বর্জ্য ফেলার নির্দেশনা রয়েছে। এরমধ্যে সবুজ বিনে খাদ্য বর্জ্যসহ পচনশীল জৈব বর্জ্য, নীল বিনে বোতল, ক্যান এবং প্লাস্টিক, কাগজ এবং বোর্ডপেপারে তৈরি বর্জ্য এবং ধূসর রঙের বিনে জৈব ছাড়া অন্যান্য ধরণের বর্জ্যগুলো ফেলতে বলা হয়েছে। আমি নীল বিনে আমার কফির মগটি ফেলে দিলাম। আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম যে, এই বর্জ্যগুলো নিয়ে পরবর্তীতে রিসাইক্লিং করে নতুন পণ্য তৈরি হয়ে বাজারে আসবে। এই কফির মগে হয়তো কোন চীনা তরুণী আদুরে চুমুক দেবে!

নির্দিষ্ট সময়ে আমার ট্রেন এসে গেলো। ওই যুবক চোখের ইশারা করলেন। চীনা যুবকটি বেশ পরোপকারী বলে মনে হলো। নাহলে আমার বিষয়ে এত সজাগ থাকার দরকার ছিল না। টিকেটে আমার সিট নম্বরের পাশেই বগি নম্বর রয়েছে। আমি বেশ সহজেই নির্দিষ্ট বগির হদিশ পেয়ে গেলাম। সিটে বসার অল্পক্ষণের মধ্যেই ট্রেনটি ছুটতে শুরু করলো। নিজের অজান্তে ঘড়ির দিকে তাকালাম। আশ্চর্য, এক সেকেন্ডেরও হেরফের নেই। একেবারে ঘড়ির কাঁটা ধরে নড়তে শুরু করলো ট্রেনের চাকা। অতপর প্রচন্ড গতিতে ছুটতে শুরু করলো। ট্রেনের গতিবেগ দেখা যাচ্ছিল বগিতেই। ডিজিটাল একটি মিটারে স্পিড দেখা যাচ্ছিল। মাত্র মিনিট কয়েকের মধ্যেই আমাদের ট্রেনের গতিবেগ দুইশ’ কিলোমিটার ছাড়িয়ে গেলো। আমি জানি যে, অল্পক্ষণের মধ্যেই এই বেগ ৩শ’ কিলোমিটার ছাড়িয়ে যাবে। হেলিকপ্টারের চেয়ে বেশি গতিতে ছুটবো আমরা। ঢাকাচট্টগ্রামসহ আমাদের অভ্যন্তরীণ রুটে চলাচলকারী ছোট এয়ারক্রাফটগুলোর কাছাকাছি গতি নিয়ে আমরা গুয়াংজুর পথে এগুতে থাকবো। মাটিতে এমন দুর্দান্ত গতি রোমাঞ্চ জাগায়। ভাবতে ভালো লাগে যে, তিনশ’ সোয়া তিনশ’ কিলোমিটার বেগে ছুটছি। ছোট বিমানগুলো ৪শ’ থেকে ৫শ’ কিলোমিটার বেগে চলাচল করে। বিশ্বের বহুদেশই বিমানের গতি ট্রেনে নিয়ে এসেছে। চীনও তাতে সফল হচ্ছে। আসার সময়েও একই ধরনের ট্রেনে ঝড় তোলার অভিজ্ঞতা থাকায় ফেরার গতিও যে তীব্র হবে তা বেশ বুঝতে পারছিলাম।

মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল যে, জাপান কিংবা ইউরোপের দেশগুলো রেল চলাচলের ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি করেছে। চীনের উন্নতি জাপানের মতো হবে সেটি ভাবার কোন কারণ নেই। চীন ইউরোপকে টেক্কা দেবে তাও আমি মনে করছি না। তবে ওসব দেশে ট্রেনের সময়জ্ঞানের যে টনটনে ভাব দেখেছিলাম চীনে যে সেই ভাব এত প্রকটভাবে থাকবে তা আমার ভাবনাতেও ছিল না। ঘড়ির কাঁটা ধরে ট্রেনের ছুটে চলার ব্যাপারটি আমাকে অনেকগুলোর প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিল। কী করে তারা এভাবে সময় মেনটেইন করে! একদম মিনিটসেকেন্ড পর্যন্ত ঠিকঠাক থেকে যায়। ঘড়ির কাঁটার সাথে ট্রেনের চাকার এমন দুর্দান্ত সমন্বয় বেশ কঠিন। জাপান কিংবা ইউরোপের দেশগুলোতে এই সমন্বয় ঘটেছে বহু আগে। চীনও সেই একই কাতারে নিজেদের নিয়ে যাচ্ছে।

ট্রেন ছুটছে। আড়াইশ’ কিলোমিটারে উঠে গেছে গতি। ট্রেন ছাড়ার মাত্র মিনিট কয়েকের মধ্যেই এমন দুর্দান্ত গতি অকল্পনীয়। ট্রেন ছুটছে। গতি বাড়ছে। আমি জানি এই গতি তিনশ’ দশ পর্যন্ত উঠে যাবে। প্রতি ঘন্টায় তিনশ’ দশ কিলোমিটার! নন স্টপ ছুটবে একটি ট্রেন। প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দেবে মাত্র ঘন্টা কয়েকে! (চলবে)

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রবাহ
পরবর্তী নিবন্ধমোগাদিশুতে আত্মঘাতী বোমা হামলায় ৩০ সেনা নিহত