দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ১৯ জুলাই, ২০২৩ at ৬:১৪ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

বেশ জমিয়ে ডিনার হলো। অচিন সব খাবারও যে এমন উপাদেয় হয়ে উঠবে তা আমার ধারণাতেই ছিলনা। ভেজিটেবল স্যুপ ভালো হবে আশা করেছিলাম। কিন্তু স্যুপের পাশাপাশি অন্যান্য খাবারগুলোও যে এভাবে তৃপ্ত করবে তা জানা ছিল না। স্টিকি রাইচের সাথে নানা ধরনের খাবার দেয়া হয়েছিল। সবজি দিয়ে নানা পদের রান্না শুধু আমরাই নয়, চীনারাও পারে। আর তারা পারে বলেই হয়তো আজ রাতে আমার ডিনার এমন উপাদেয় হলো। সবজির ডিনারে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে তুলতে আমার লন্ডনের একটি রেস্টুরেন্টের কথা মনে পড়লো। চট্টগ্রামের সাফা মোতালেব ফাউন্ডেশনের কর্ণধার সাফা সাহেব ওই রেস্টুরেন্টের মালিক। যেখানে সবজি দিয়ে অন্তত একশ’ আইটেমের খাবার রান্না হয়। প্রতিদিন শত শত ইংরেজ সেখানে ব্যুফে লাঞ্চ ডিনার সারে।

কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম কে জানে! ডিনার সেরে রুমে ফিরেই শুয়ে পড়েছিলাম। আর দিনের ক্লান্তিই বুঝি নিদ্রাদেবীকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। সকালে ব্যুফে ব্রেকফাস্টের স্বাভাবিক আনন্দ ছিল না। বেইজিং ছাড়ার একটি তাড়া ছিল ভিতরে। বেশ দ্রুত নাস্তা সারলাম। ট্রেন ধরতে হবে। বেইজিং থেকে গুয়াংজুর হাইস্পিড ট্রেন। বেইজিং থেকে বিমানে গুয়াংজু ফেরার চিন্তা করেছিলাম। কিন্তু পরক্ষণে মনে হলো যে, এতগুলো টাকা খরচ করে ট্রেনের টিকেট করেছি। চড়া দামের সেই টিকেট নষ্ট করার কোন মানে হয়না। তাছাড়া গুয়াংজুতে আমার এমন কোন কাজ নেই যে তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। তাছাড়া অভ্যন্তরীণ রুটের বিমানগুলো সচরাচর ৭শ’ থেকে সাড়ে৭শ’ কিলোমিটার বেগে উড়ে, অপরদিকে হাইস্পিড ট্রেন ৩শ’ কিলোমিটারের বেশি বেগে ছুটবে। এতে বিমানবন্দরে যাওয়া আসা আর সিকিউরিটি চেকিংসহ চেকইন বা লাগেজের অপেক্ষা বাদ দিলে ট্রেন খুব বেশি দেরিতে পৌঁছাবে না। আমি মনে মনে হিসেব কষলাম যে, ননস্টপ হাইস্পিড ট্রেনে আমি বিমানের চেয়ে হয়তো ঘন্টা দুয়েক দেরিতে গন্তব্যে পৌঁছাবো! ২৪শ’ কিলোমিটারের মতো পথ পাড়ি দিতে বিমানে প্রায় তিন ঘন্টা ফ্লাইটাইম লাগবে। এর বাইরে বিমানবন্দরে যাওয়া আসা এবং চেকইনসহ সিকিউরিটি চেকিং মিলে আরো ঘন্টা তিনেক সময় নষ্ট হবে। অর্থাৎ ছয় ঘন্টা। কিন্তু ট্রেনে সর্বোচ্চ আট ঘন্টার জার্ণিতে আমি গন্তব্যে পৌঁছে যাবো। মাত্র দুই ঘন্টার জন্য এতগুলো টাকা জলে ফেলা ঠিক হবে না। অতএব বিমানের চিন্তা বাদ দিয়ে ট্রেনেই ফেরার সিদ্ধান্ত নিলাম। গুয়াংজু থেকে আসার সময় ফিরতি পথের টিকেট করে রাখায় বাড়তি কোন টেনশন ছিল না। শুধু হোটেল থেকে বেরিয়ে বেইজিং ওয়েস্ট রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছালেই হলো। আরো মজার ব্যাপার হলো, আমার হোটেলটি রেলওয়ে স্টেশনের পাশে, পায়ে হাঁটা দূরত্বে!হোটেলের সব বিলটিল মিটিয়ে চেকআউট করে নিলাম। যথারীতি কাগজপত্র পকেটে পুরে হাঁটা শুরু করলাম রেলওয়ে স্টেশনের দিকে। আমি জানি যে, মিনিট পাঁচেক লাগবে স্টেশনে পৌঁছাতে, তবে বিশাল স্টেশনটির নির্দিষ্ট প্ল্যাটফরমে পৌঁছাতে কতক্ষণ লাগে কে জানে! আসার সময় যেভাবে বিশাল বড় স্টেশনটির চক্করে পড়ে ঘুরপাক খাচ্ছিলাম!রেলওয়ে স্টেশনের দিকে হাঁটছিলাম। স্টেশনের ডিরেকশন আগেই জেনে নিয়েছি। এতে করে উল্টো দিকে হাঁটার ঝুঁকি ছিল না। অল্পক্ষণের মধ্যেই আমি স্টেশনের দৃষ্টিনন্দন গেটের নাগাল পেয়ে গেলাম। কি যে সুন্দর ভবন! কিন্তু ভিতরে ঢুকতে গিয়ে আমার অন্তর কেঁপে উঠলো। এ যে জনস্রোত! বানের পানির মতো হু হু করে মানুষ ঢুকছে স্টেশনে। হাজার হাজার নারী পুরুষ ও শিশু কিশোর। মানুষে মানুষে কিলবিল করা বলতে যা বুঝায় ঠিক তাই। অনেকটা দৌঁড়ের উপর ছুটছে তারা। এত মানুষ যাচ্ছে কোথায়!

এই ভিড়ের মধ্যে নিজেকে ঠিকঠাকভাবে সামলে রাখা কঠিন মনে হচ্ছিল। আমার ট্রেন কোন প্ল্যাটফরম থেকে ছাড়বে? ওই প্ল্যাটফরমে কি করে পৌঁছাবো কে জানে! আমি ভিড়ের ভিতরে ভিতরে ছুটতে লাগলাম। মুল স্টেশনে পৌঁছার পর প্ল্যাটফরম খুঁজে নেয়া যাবে। আগে জায়গামতো পৌঁছি, তারপর যাই হোক, একটা কিছুতো হবে। তবে আমার সান্তনা এই যে, গুয়াংজুর ট্রেন ছাড়ার যথেষ্ট দেরি আছে। অচিন রেলওয়ে স্টেশন হওয়ায় আমি নির্ধারিত সময়ের বেশ আগেই এসে হাজির হয়েছি।আগেই বলেছি মানুষ কিলবিল করছে। বিশাল রেলওয়ে স্টেশনটিতে হাজার হাজার মানুষ। দেড়শ’ কোটিরও বেশি মানুষের দেশ চীনে সবকিছুই বড় বড়। তাদের রেলওয়ে স্টেশনও বিশাল। আর মানুষ যেহেতু বেশি,তাই যেখানে সেখানে কিলবিল করার মানুষের অভাব হয় না। বেইজিং এ আরো কয়েকটি রেলওয়ে স্টেশন রয়েছে। ১৯৯৬ সালে চালু করা বেইজিং ওয়েস্ট স্টেশন থেকে চীনের পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকের দূরপাল্লার ট্রেনগুলো যাতায়ত করে। এরমধ্যে লাসা (তিব্বত), হংকং, উহান এবং গুয়াংজু যাওয়ার হাইস্পিড ট্রেনগুলো এখান থেকে ছাড়ে। পুরো চীনের সবগুলো ট্রেন যদি এখান থেকে ছাড়া হতো তাহলে অবস্থা কেমন হতো কে জানে!

বিশাল রেলওয়ে স্টেশন, বিশাল সব কাজকারবার। চারদিকে হাজার হাজার মানুষ। কিন্তু কোথাও কোন ময়লা আবর্জনা নেই। একেবারে চকচকে ঝকঝকে অবস্থা। কি আশ্চর্য! রেলওয়ে স্টেশন এতো পরিস্কার হয়!

নানা ব্যারিয়ার পার হয়ে স্টেশনে প্রবেশ করার পর টের পেলাম যে, এটি কোন সাধারণ স্টেশন নয়। আসার সময় যেভাবে ট্রেন থেকে নেমে কোথাও উপরে কোথাও নিচে ছুটতে ছুটতে রাস্তার নাগাল পেয়েছিলাম, এখনো ঠিক তেমনি নানা পথ মাড়িয়ে আমাকে ট্রেনের নাগাল পেতে হবে। তবে এটা বুঝে গেলাম যে, এই স্টেশনে ট্রেনে আসা এবং যাওয়ার যাত্রীদের আলাদা পথ রয়েছে। সিঁড়ি ভেঙ্গে এবং স্কেলেটরে চড়ে আমি উপরের দিকে উঠতে লাগলাম। কত তলায় উঠলাম ঠিক ঠাহর করতে পারলাম না। তিন চারতলা উচ্চতা থেকে কী ট্রেন ছাড়বে!

আমাদের বডি চেক করা হলো। লাগেজ স্ক্যানিংও। ভিতরে ঢোকার পর আমি আবারো ভড়কে গেলাম। কিছুটা ভয়ও করতে লাগলো। এক একটি প্ল্যাটফরম থেকে বিশ ত্রিশটি ট্রেন ছাড়ার ঘোষণা দেয়া হচ্ছে ডিজিটাল ডিসপ্লে বোর্ডে। একটি বোর্ডে একটির পর একটি ট্রেন ছাড়ার সময় প্রদর্শিত হচ্ছে। বিশ মিনিট থেকে আধা ঘন্টা পর পরই ট্রেন! হায় আল্লাহ, কী অবস্থা!! গুয়াংজুর ট্রেন ঠিকঠাকভাবে ধরতে পারবো তো!

বোর্ডে আমার ট্রেনটির সময় প্রদর্শিত হচ্ছিল। আট নম্বর প্ল্যাটফরম থেকে ছাড়বে। এখনো এক ঘন্টা সময় আছে। কিন্তু এই এক ঘন্টায় আমি আট নম্বরের নাগাল পাবো তো! বডি চেক করছিলেন এক তরুণী। তার কাছে গেলাম। ৮ নম্বর প্ল্যাটফরমে কোনপথে যেতে হবে জানতে চাইলাম। তরুণী আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকলেন। কিন্তু কোন উত্তর দিলেন না। আমি বুঝতে পারলাম যে, চীনের এই তরুণী ইংরেজী ‘এইট’ শব্দটি জীবনে শুনেনি! চীনে ইংরেজী দিয়ে চলা খুবই কঠিন। বিশেষ করে সাধারণ লেবেলে। আমি এক পুলিশকে ‘হ্যালো’ বললাম। না, বেচারা দৌঁড়ের উপর আছে। ‘হ্যালো’র উত্তর দেয়ার সময় তার নেই। পরে কয়েকজন যাত্রীকেও থামানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু আশ্চর্য, সবাই ছুটছে। ৮ নম্বর প্ল্যাটফরম না পেলে যে আমার দুঃখ চরমে পৌঁছবে তা বেশ বুঝতে পারছিলাম।

চারদিকের দৌঁড়াদৌঁড়ির মাঝে মোটামুটি ধীরস্থিরভাবে এগিয়ে আসছিলেন বেশ সুদর্শন এক যুবক, সাথে এক তরুণী। তারা স্বামীস্ত্রী কিনা বুঝতে পারছিলাম না। তবে ইশারা করতে দাঁড়িয়ে গেলেন। মুখে কিছু না বলে আমি আমার টিকেটটি বাড়িয়ে ধরলাম। টিকেটের উপর চোখ বুলাতেই যুবকের মুখে হাসির রেখা দেখা গেলো। চোখাচোখি করলেন সাথের তরুণীর সাথে। আমাকে তাদের অনুসরণ করতে বললেন। ইংরেজীতে বললেন যে, তারাও ওই ট্রেনের যাত্রী এবং গুয়াংজু যাচ্ছেন। পৃথিবীর বহু দেশে ট্রেনে চড়া এই আমি যে, বেইজিং রেলওয়ে স্টেশনে ট্রেন খুঁজে পাবো না তা ভাবতেই পারছিলাম না। নিজেরই লজ্জা লাগছিল। তরুণতরুণীর পেছনে ছুটতে ছুটতে মনে হচ্ছিল স্মার্টনেসের পুরোটাই ভাষার উপর নির্ভর করে। ভাষা না জানলে সব স্মার্টনেসই হারিয়ে যায়। নিজেকে অচিন দরিয়ায় কূলহারা সাঁতারু মনে হয়।

কোনপথ দিয়ে যে কোথায় আসলাম কে জানে। তবে নিজেকে ‘আট নম্বর’ প্ল্যাটফরমে আবিস্কার করে বেশ স্বস্তি পেলাম। যুবক যুবতীকে কৃতজ্ঞতা জানালাম। যুবক বললেন, আরো আধা ঘন্টা পরে গুয়াংজুর ট্রেনটি প্ল্যাটফরমে আসবে। তার আগে আরো দুইটি ট্রেন এখান থেকে ছেড়ে যাবে।

আধা ঘন্টা অলস বসে থাকতে আমার কোন সমস্যা নেই। সময়মতো যে প্ল্যাটফরমে এসে পৌঁছাতে পেরেছি তাতেই যেনো বর্তে যাচ্ছিলাম। এক ধরনের স্বস্তিতে মন ফুরফুরে হয়ে উঠলো। ফিরে যাচ্ছি গুয়াংজু। যেখানে আমার বন্ধু ইউছুপ আলীর অফিস এবং বাসা রয়েছে। রয়েছে নিজেদের লোকজনও। আমার খুব কফি খেতে ইচ্ছে করছিল। পাশেই কফিশপ। আমি লার্জ সাইজের এক মগ কফি নিয়ে হাইস্পিড ট্রেনের অপেক্ষা করতে লাগলাম। (চলবে)

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপাহাড়ী পদের পদ্য
পরবর্তী নিবন্ধবঙ্গোপসাগরের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় গুরুত্ব দেওয়া জরুরি