(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
ফিরে আসছিলাম আমরা। বেইজিং এর পথে ছুটছিলো আমাদের বাস। সামনের দিকে ছুটে চললেও আমার মনটি যেনো রেখে যাচ্ছি পেছনে। চীনের বিখ্যাত গ্রেটওয়ালের ভাঁজে ভাঁজে যেনো আটকা পড়ে রয়েছে আমার সকল ভালোলাগা। আমি ফিরে যাচ্ছি বেইজিং শহরের হোটেলে। বাসের জানালায় মাথায় রেখে দূরপাহাড়ের গ্রেটওয়াল দেখছিলাম। মুগ্ধতার পাশাপাশি ঘোরলাগা বিস্ময়ও ছিল আমার অন্তর জুড়ে। এতো বিশাল একটি স্থাপনা নির্মাণ আধুনিক বিশ্বের জন্যও বড় বিস্ময়। তবে এত শত বছর আগে কী করে যে এমন স্থাপনা নির্মিত হয়েছিল কে জানে! এই ‘কে জানে’ই আমার এবং আমার মতো অনেকের অন্তরজুড়ে বিশাল এক রহস্য হয়ে রয়ে গেলো! বিরাট এক প্রশ্নবোধক চিহ্ন যেনো গ্রেটওয়ালের পরতে পরতে।
আমাদের বাস চলছিল। শহরের উপকণ্ঠ থেকে ক্রমে আমরা ব্যস্ততম নগরীতে ঢুকে যাচ্ছিলাম। বেইজিং এর ধারেকাছে গ্রেটওয়াল দেখার অসংখ্য পয়েন্ট থাকলেও আমরা গিয়েছিলাম শহর থেকে অন্তত ৭০ কিলোমিটার দূরে। ওখানে গ্রেটওয়াল দর্শন সম্পন্ন এবং দিনের একটি বড় অংশ কাটিয়ে ফিরে চলছি আমরা। বেইজিং শহরের ব্যস্ততায় ঢুকে গেলেও আমার অন্তরজুড়ে কেবলই বিরাজ করছিল পাহাড়ের উপর গড়ে তোলা গ্রেটওয়ালের মুগ্ধতা। লাঞ্চের পরে গাইডের সৌজন্যে পাওয়া কফির মগে চুমুক দিতে দিতে নানাকিছু ভাবছিলাম। আমার ভাবনাজুড়ে বিরাজ করছিল গ্রেটওয়াল। এটি কী সত্যিই মানুষের তৈরি! মানুষ কিভাবে এতোবড় দেয়াল নির্মাণ করলো! কিভাবে!
তীব্র যানজটে অনেকক্ষণ স্থবির হয়ে থাকায় বুঝতে পারছিলাম যে, শহরের ভিতরে পৌঁছে গেছি। চারদিকে শত শত গাড়ি। সবই প্রাইভেট কার, জীপ। বাস ট্রাক কিংবা রিক্সা টেক্সি না থাকলেও এতো জ্যাম কেন বুঝতে পারছিলাম না। অনেকক্ষণ ধরে একটি পয়েন্টে আটকে আছি। সামনে পেছনে যাচ্ছে না কোন গাড়ি। গাইডের চোখে চোখ রাখলাম। প্রশ্ন– কি হয়েছে? তিনি বাঙালী মেয়ের মতো ঠোঁট উল্টালেন। আমার মতো তিনিও বুঝতে পারছিলেন না যে, কি হয়েছে বা হতে যাচ্ছে।
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসে বসে আছি। তবুও কেমন যেনো অস্বস্তি লাগছিল। কতক্ষণ এভাবে বসে থাকা যায়!! কেন বসে আছি, জ্যাম আর কতক্ষণ চলবে, জ্যামের কারণই বা কি তার কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। শুধু থমকে যাওয়া চারদিক দেখে বেশ বুঝতে পারছিলাম যে, ঝামেলা কিছু একটা হয়েছে।
চীনে এসেছি পর্যন্ত শত শত মাইল পথ চলেছি। কিন্তু আগে আর কখনো এমন ট্রাফিক জ্যামে পড়িনি। আজ হঠাৎ কী এমন হলো যে, ধারণা পাল্টে যাওয়ার উপক্রম হলো। রাস্তার ফুটপাত ধরে প্রচুর মানুষ হাঁটছেন, সামনে দৌঁড়াচ্ছেন অনেকেই। আবার কেউ কেউ পেছনেও। এরা কী বাস থেকে নেমে হাঁটা শুরু করেছেন নাকি স্থানীয়রা বাজার সদাই করে ঘরে ফিরছেন বুঝতে পারছিলাম না। বহুল জনগোষ্ঠির বিশাল দেশটিতে প্রচুর মানুষ ফুটপাত ধরে হাঁটে, রাস্তার পাশ দিয়ে দৌঁড়ের উপর চলে। এরাও হয়তো তেমনি।
আমরা ব্যস্ত সড়কের যেখানে আটকা পড়েছি তার পাশে প্রচুর দোকানপাট। দোকানগুলোতে শোভা পাচ্ছে নানা ধরণের পণ্য। কেনাকাটাও চলছে। প্রতিটি দোকানেই কমবেশি লোকজন রয়েছে। মেগাসিটি বেইজিং! দোকানে দোকানে তো মানুষ গিজ গিজ করবেই! আরো বেশ কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে এগুতে শুরু করে আমাদের বাস। সামনের গাড়িগুলোও ধীরলয়ে এগুচ্ছিল। এক সময় জ্যাম ফুরিয়ে গেলো। তবু রাস্তায় এতো বেশি গাড়ি চলছিল যে আমাদের বাসের স্পিড কোনভাবেই বাড়ানো যাচ্ছিলো না। রাস্তাজুড়ে চলছিল নানা দেশে তৈরি নানা মডেলের গাড়ি। তবে এরমধ্যে চীনের তৈরি বিভিন্ন ব্রান্ডের গাড়ির যেনো রাজত্ব চলছে।
পথিমধ্যে নেমে যাওয়ার সময় গাইড মিজ শিন চেন আমার কাছ থেকে বিদায় নিলেন। বললেন, আপনার প্যাকেজ তো শেষ। কাল তো আপনার সাথে দেখা হবে না। আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতা জানালাম। বললাম, দারুণ সময় কেটেছে তার সাথে। আমি সকালেই বেইজিং ছেড়ে যাবো বলে জানালাম তাকে। শুভকামনা জানিয়ে বিদায়ও নিলাম। ভবিষ্যতে কোনদিন বাংলাদেশ সফরে এলে আমাকে যেনো নক করে সেই অনুরোধও করলাম। নামার সময় গাইড চালককে কি কি যেনো বললেন। আমাকে বললেন, আপনাকে হোটেলেই পৌঁছে দেয়া হবে। গাইড গাড়ি থেকে নেমে গেলেন।
আমাদের বাস চলছিল। ট্রাফিক প্রচুর হলেও থেমে যাওয়ার মতো নয়। গাড়ির গতিও কিছুটা বেড়েছে। আমি ধারণা করছি যে, হয়তো আধাঘন্টার মধ্যে হোটেলে পৌঁছে যাবো। বাসে গান বাজছিল। একটি শব্দও বুঝতে পারছিলাম না। তবে সুর খুব একটা খারাপ লাগছিল না। আমাকে হোটেলের সামনে নামিয়ে দিয়ে বাস চলে গেলো। আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাসটির চলে যাওয়া দেখতে লাগলাম। কত পথ বাসটিতে চড়েছি। কেমন যেনো একটি মায়া জন্মে গেছে। আহা, মায়াটা আসলেই খুব খারাপ জিনিস।
রুমে ফিরে মন ভালো হয়ে গেলো। সবকিছু সুন্দরভাবে গুছিয়ে রাখা হয়েছে। রুমটিকে এত চমৎকারভাবে সাজিয়ে রাখা হয়েছে যে, মনে হচ্ছে এখনই বুঝি চেকইন করলাম। পানির বোতল, ফলের ঝুড়ি, চা কফির সরঞ্জাম সবই দেয়া হয়েছে নতুন করে। ওয়াশরুমের সবকিছুও চকচক করছিল। একেবারে তকতকে ঝকঝকে অবস্থা। সাবান স্যাম্পু, টুথপেস্ট, ব্রাশ সবই নতুন করে দেয়া। তারা জানে যে, রুমটিতে আমি একা থাকি, তবুও সব জিনিসই দুইজনের জন্য দেয়া। ব্যবসার টেকনিক। কাস্টমারের মন ভালো করে দেয়ার চেষ্টা আছে!
রাতে ডিনার কোথায় করবো তা নিয়ে একটু চিন্তায় পড়ে গেলাম। ঠিক কোথায় গিয়ে ঠিকঠাকভাবে খাবার পাবো বুঝতে পারছিলাম না। অচিন শহরে রাস্তায় রাস্তায় ঘোরাও বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। হোটেলের রেস্টুরেন্টে কী সেরে নেবো! এই ধরণের ফাইভস্টার হোটেলের রেস্টুরেন্টে খাবার খেলে প্রচুর কড়ি ফেলতে হয়। তবে এটুকু ঠিক যে, এসব রেস্টুরেন্টে অথেনটিক কিছু ফুড পাওয়া যাবে। কোন গোঁজামিল দেয়া হবে না। বাইরে গিয়ে ঠিকঠাকভাবে বুঝিয়ে বলতে না পারলে বরং ঝামেলায় পড়ে যাবো। অনেকগুলো ফল রয়েছে আমার টেবিলে। হোটেল কর্তৃপক্ষ কমপ্লেমেন্টারি দিয়েছে। কমলার খোসা ছড়াতে ছড়াতে মনে হলো, যতগুলো ফল এই ঝুঁড়িতে রয়েছে এগুলো দিয়ে দিব্যি ডিনার হয়ে যায়। অসুবিধা হচ্ছে কোন ঝাল নেই। ঝাল কিছু না খেলে আমার ডিনার করছি বলেই মনে হয় না! কী এক বাঙালী অভ্যাস!!
টিভিতে কী কী সব অনুষ্ঠান চলছিল। একেকটি চ্যানেলে একেক ধরনের অনুষ্ঠান। টক শো টাইপেরও একটি অনুষ্ঠান দেখলাম। চীনে সরকারের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলতে পারে না। এসব টকশো কি নিয়ে হয় কে জানে! গানের অনুষ্ঠানও চলছিল একটি চ্যানেলে। অপর চ্যানেলে নাটক কিংবা সিনেমার মতো কিছু একটা। আমি একটির পর একটি চ্যানেল ঘুরিয়ে সময় কাটাতে লাগলাম। অলস সময় কাটানোর জন্য টিভি দেখার কোন বিকল্প ছিল না। কিছু না বুঝলেও টিভির অনুষ্ঠানমালা দিব্যি আমার সময়গুলো পার করে দিচ্ছিলো।
পেট জানান দিচ্ছিল যে ক্ষুধা লেগেছে, কিছু খেতে হবে। হ্যাঁ, খেতেই হবে। দুপুরেও ভালো লাঞ্চ হয়নি। রাতে যদি ডিনার ঠিকঠাকভাবে না হয় শরীর গোলমাল করবে। দূরদেশে শরীর গোলমালের মতো খারাপ আর কিছুই হতে পারে না। তাই হোটেলের রেস্টুরেন্টেই ডিনার সারবো বলে মনস্থির করলাম। ইন্টারকমে ফোন করে রেস্টুরেন্টে ডিনারের কি ব্যবস্থা আছে জানতে চাইলাম। মোটামুটি ইংরেজীতে বুঝানো সম্ভব হলো যে, আমি একজন ভেজিটেরিয়ান, তাই সবজি দিয়েই রাতের খাবার সারতে হবে। ওপার থেকে ভদ্রমহিলা আমাকে যা বললেন সোজা বাংলায় তার অর্থ হচ্ছে, সবজির বহু আইটেম তারা করে। বেশ অনায়াসে তাদের ভেজ খাবার দিয়ে আমি ডিনার সারতে পারি বলেও তিনি আশ্বস্ত করলেন। তবে কিছুটা গলা নিচু করে বললেন যে, আমি যেনো রেস্টুরেন্টে গিয়েই ডিনার সারি। রুম সার্ভিসে ডিনার সারতে হলে বহু বেশি অর্থ পরিশোধ করতে হবে বলেও তিনি জানালেন। আমি মনে মনে হাসলাম। বেচারি, মালিকের বড় ক্ষতি করে দিলেন!!
রেস্টুরেন্টে গিয়ে চোখ কপালে উঠলো। ওরে বাবা, এটা রেস্টুরেন্ট নাকি বার!! টেবিলে টেবিলে মদের বোতলের জয় জয়কার! সমানতালে চলছে নারী পুরুষের হল্লা। চীনারা যে কী পরিমাণ হল্লা করে!! বোতল নিয়ে মাতোয়ারা হয়ে উঠা মানুষগুলো অধিকাংশই তরুণ–তরুণী। সংখ্যা কম হলেও এক একজন তরুণীর সরব উপস্থিতি বেশ কানে লাগছিল। আমি একটি টেবিলে বসলাম। বিব্রত না হলেও অস্বস্তি লাগছিল। এতগুলো পাড় মাতালের (?) সাথে বসে ডিনার সারা আসলে কঠিন। পরিস্থিতি এখনো শান্ত। তারা বেশ আনন্দের সাথেই মদ বিয়ার খাচ্ছে। তবে এই ধরনের মদের আসরে পরিস্থিতি কখন যে কোনদিকে মোড় নেয় তা কেউ জানে না। যে কোন সময় লাগালাগি, খুনোখুনি হতে পারে। আমি কি উদ্বিগ্ন? ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। তবে ভালো লাগছিলো না। হাতে ছোট্ট একটি নোটবুক নিয়ে একজন ওয়েটার আসলেন আমার কাছে। তরুণী কিছুটা ঝুঁকে অর্ডার নেয়ার জন্য তাকালেন আমার দিকে। বিয়ার নাকি হার্ড ড্রিংকস নেবো জানতে চাইলেন অল্পবয়সী মেয়েটি। ডিনার করবো বলাতে কিছুটা আমতা আমতা করে মেয়েটি বললেন, ‘হুম, ডিনারের আগে তো বিয়ার অথবা হার্ড ড্রিংকস নেবেন।’
আমি মাথা নাড়লাম। না, লাগবে না। আমি শুধুই ডিনার করবো। তরুণী আর কথা বাড়ালেন না। রুম থেকে ফোনে কার সাথে কথা বলেছিলাম বুঝতে পারছিলাম না। রেস্টুরেন্টের ক্যাশে তিনজন তরুণী বসে আছেন। আমি ওয়েটারকে বললাম, রুম থেকে আমি একজনের সাথে ফোনে কথা বলেছিলাম। ওনাকে পেলে আমার অর্ডার করতে সুবিধা হবে। ওয়েটার মাথা নাড়লেন এবং কাকে যেনো ইশারা করলেন। অপর একজন তরুণী আমার কাছে আসলেন। তিনি বেশ বিগলিত হয়ে বললেন, রুম থেকে আমার সাথেই কথা বলেছিলেন আপনি। আপনার ডিনারের ব্যাপারটি দেখছি। তিনি আমাকে কয়েকটি আইটেমের নাম বলে ওগুলো দিয়ে দিব্যি ডিনার হয়ে যাবে বলেও আশ্বস্ত করলেন। আমি কিছু না বুঝে মাথা নাড়লাম। শুধু এটুকু বললাম যে, আমি ভেজিটেরিয়ান। কোন ধরনের মাছ বা মাংস যাতে না থাকে! (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।