(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
সাজ সাজ রব ফরবিডেন সিটির প্রাসাদে। চারদিকে আনন্দের বন্যা। রাণী যাবেন বাপের বাড়ি। এই আনন্দ যেনো রাণীর একার নয়, এই আনন্দ ছড়িয়ে গেছে সবার মাঝে। বিশাল বহর যাবে রাণীর সাথে। বিশ্বস্ত দাসি এবং কয়েকজন সখীকে সাথে নিয়ে যাবেন রাণী। বহরের নিরাপত্তার জন্য থাকবে সেনাপতিসহ সৈন্য–সামন্ত। পাল্কিতে চড়ে যেতে হবে রাণীকে। কয়েক মাস কেটে যাবে পথে। দীর্ঘ এই পথচলায় পাহাড় পর্বতও ডিঙ্গাতে হবে, পাড়ি দিতে হবে মাঠ ঘাট। কষ্টকর এই যাত্রায় রাণীর যাতে কোন কষ্ট না হয় তার সব ব্যবস্থাই করা হবে। রাণীর আনন্দযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে কোন কিছুরই কার্পণ্য করা হবে না। আহা, বিয়ের কত বছর পর জন্মস্থানে যাচ্ছেন রাণী!! যেখানে তিনি ছুটেছেন, খেলেছেন। বেড়ে উঠেছেন, স্বপ্ন দেখেছেন। অতি সাধারণ পরিবারে বেড়ে উঠা কিশোরী কী কোনদিন ভুলেও রাণী হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন? কে জানে!! চীনের ছিন রাজবংশের প্রথম সম্রাটের রাণী হওয়ার মধ্য দিয়ে গ্রামীন এক কিশোরীর জীবনমান আবর্তিত হচ্ছিল একেবারে অচিন এক ভিন্ন আবহে!
যাক, বাপের বাড়ি যাওয়ার জন্য রাণী গোছগাছ সম্পন্ন করলেন। শুভ একটি দিন দেখে যাত্রা করেন রাণী। লাকি সেভেন নয়, চীনে বিশ্বাস করা হয় সংখ্যার মধ্যে ‘৯’ ই লাকি। তাই রাণী যাত্রা করেছিলেন চমৎকার একটি মাসের নবম দিনে, ৯ তারিখে। পাল্কিতে। সৈন্য সামন্তের পাহারায় দাসী বাদী সখী নিয়ে পথে নামেন রাণী। যেতে হবে বহুদূর। বহু দিনের পথ! আহা, কতদিনের জন্য পথই হবে বাড়ি–ঘর! সকাল গড়িয়ে দুপুর হলো। দুপুরের খাওয়া দাওয়াও হলো। পাল্কির ঝিমুনিতে রাণীর চোখ জোড়ায় মনে হয় ভর করছিলো তন্দ্রা। রাণী কি সম্রাটকে নাকি বাপের বাড়ি স্বপ্নে দেখছিলেন কে জানে! হঠাৎ পাল্কি থেমে গেল। রাণীকে নেমে আসতে বলা হলো। পাইক পেয়াদা জানালেন, নেমে আসুন রাণী মা। আমরা পৌঁছে গেছি। ঘোর লাগা চোখে রাণী পাল্কি থেকে নামলেন। কিছুই বুঝতে পারছিলেন না তিনি। বাপের বাড়ি যেতে যেখানে দু’চার মাস লাগার কথা সেখানে সকালে যাত্রা করে বিকেল গড়ানোর আগে পৌঁছলাম কোন যাদুবলে! রাণী বুঝতে পারছিলেন না কিছু। সবইতো ঠিক আছে। সেই নদী। সেই পাহাড়। সেই দোকানপাট। সেই মাঝী। দোকানের দোকানীরাও কথাবার্তা বলছিলেন রাণীর বাপের বাড়ির স্থানীয় ভাষায়। তাহলে পথ বিলীন হলো কোথায়? কিভাবে কয়েক মাসের পথ মাত্র এক বেলায় ফুরিয়ে গেল! মুখ ভরা হাসি নিয়ে বেরিয়ে আসলেন সম্রাট। দু’হাত বাড়িয়ে বুকে নিলেন রাণীকে। বললেন, বাপের বাড়ি পছন্দ হয়েছে? তোমার জন্যই সবকিছু তৈরি করিয়েছি। হাট–বাজার, পাহাড়–পর্বত–নদী সবই বানিয়েছি। তোমার জন্মস্থানের মতো একটি জনপদ। তোমার বাপের বাড়ির বাজার থেকে দোকানীও ধরে এনেছি। তারাই এখানে বেচাকেনা করবে। আমরাও যখন ইচ্ছে তখন এখানে এসে থাকবো। তুমি নদীতে ভাসবে, পাহাড়ে উঠবে। পাখীর গান শুনবে। আমি শুধু তোমার পাশে পাশে থাকবো। কী বলে এসব! ঘোর লাগা চোখে রাণী চারপাশ দেখছিলেন! সম্রাট কী সত্যিই বলছেন! সত্যিই কী তার বাপের বাড়ির জনপদের মতো কৃত্রিম এক জনপদ তৈরি করা হয়েছে!
রাণী কী মুগ্ধ হয়েছিলেন? বিভোর হয়েছিলেন প্রেমে?? সেই তথ্য লিখা নেই চীনের বেইজিং এর সামার প্যালেসের সামনে লিখে রাখা উপরের গল্পটিতে। তবে রাণীর জন্য যে এই ভূস্বর্গ গড়ে তোলা হয়েছিল তার উল্লেখ রয়েছে। রাণীর বাপের বাড়ির আদলেই গড়ে তোলা হয় সামার প্যালেস। রাণীর সুখের জন্য, রাণীর মুখের একটু হাসির জন্য গড়ে তোলা হয় কৃত্রিম পাহাড়, কৃত্রিম লেক। গাছ গাছালী সবই তৈরি করা হয় রাণীর বাপের বাড়ির আদলে। বড় বড় গাছ এনে বসিয়ে দেয়া হয়েছিল লেকের পাড়ে। লেকের বুকে বড়সড় একটি দ্বীপও নির্মাণ করা হয়েছিল। যাতে বাগান তৈরি করে রাণীকে মুগ্ধ করার নিরন্তর এক চেষ্টা করেছিলেন প্রেমাতুর সম্রাট।
এবার বেইজিং শহরের অদূরে গড়ে তোলা কৃত্রিম ভূস্বর্গটির একটু বর্ণনা দিই। ১১৫৩ সালে গড়ে তোলা এই ভূস্বর্গকে আজো দুনিয়ার হাতে গোনা দু’চারটি সুন্দর স্থানের একটি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বরে ইউনেস্কো রাণীর জন্য গড়ে তোলা এই স্থাপনাকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ঘোষণা করে। কারণ হিসেবে ইউনেস্কো উল্লেখ করে যে, বাগানটি চীনের ল্যান্ড স্কেপ ডিজাইনের এক অনন্য নিদর্শন। যেখানে পাহাড়, বিস্তৃত জলরাশি, প্রাসাদ, প্যাভেলিয়ন, মিলনায়তন, মন্দির, সেতু সব মিলিয়ে এক অপূর্ব মাধুর্য সৃষ্টি করেছে। দুনিয়ার খুব কম কৃত্রিম স্থাপনায় এমন নান্দনিকতা রয়েছে।
রাণীর প্রেমে মাতোয়ারা সম্রাট কী করে যে এমন একটি স্থাপনা গড়ে তোলেছিলেন কে জানে। ৭০ হাজার বর্গমিটার এলাকাজুড়ে গড়ে উঠেছে এই বাগান। বাগানটির সামনে বিপুল জলরাশীর ২.২ বর্গকিলোমিটারের বেশী বিস্তত প্রায় ৩০ ফুট গভীর কুনমিং লেক। নদীর মতো পানি থৈ থৈ করে লেকে। লেকের বিপরীত পাশে প্রায় ২.৯ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় ২০০ ফুট উঁচু পাহাড়। ২০০ ফুট! ২০ তলা ভবনের সমান উঁচু। পাহাড়ের চূড়ায় চীনা স্থাপত্যে নির্মিত নান্দনিক একটি মন্দির। পাহাড়জুড়ে হরেক রকমের গাছগাছালী, নিচে সাজানো গোছানো বাগান।
এবার আসুন আসল কথাটি শুনি। ২.৯ বর্গকিলোমিটারের নদীর মতো ৩০ ফুট গভীর লেকটি কৃত্রিম। নদীর মতো ঢেউ খেলানো এই লেকটি মানুষ দিয়ে তৈরি করিয়েছেন সম্রাট। কোদাল দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে হাজার হাজার মানুষ লেক তৈরি করেছেন। আবার লেক খনন করতে খোঁড়া মাটি জড়ো করে মানুষ দিয়েই তৈরি করিয়েছেন ২০০ ফুট উঁচু পাহাড়। লেকের মাঝে বড়–সড় যেই দ্বীপটির কথা আগে বলেছি সেটিও তৈরি করিয়েছেন মানুষ দিয়ে। নানা অঞ্চল থেকে বড় বড় গাছ তুলে এনে মানুষই লাগিয়েছেন পাহাড়ে, দ্বীপে। মানুষের পাশাপাশি হাতি ঘোড়ারও ব্যবহার করা হয়েছিল বিশাল এই কর্মযজ্ঞে। দিনের পর দিন পরিশ্রম করে রাণীর বাপের বাড়ির আদলে তৈরি করা হয় এক জনপদ, কিংবা একটি আলাদা জনপদের সবকিছু।
কত শ্রমিকের কতদিন লেগেছিল সেই তথ্য বোর্ডে লিখা নেই। তবে ধরণা করা হয় যে কয়েক লাখ মানুষ এবং বিপুল সংখ্যক হাতি কয়েক বছর ধরে এখানে কাজ করেছিল। প্রেমাতুর সম্রাট শুধু রাণীকে সুখী করার জন্য, রাণীর মুখে হাসি ফোটানোর জন্য বছরের পর বছর বহু মানুষের রাতের ঘুম হারাম করে ছেড়েছিলেন। সম্রাট এসব করিয়েছিলেন শুধু রাণীর জন্য। রাণীকে মুগ্ধ করার জন্য। কিন্তু কতটুকু করতে পেরেছিলেন কে জানে !!
১১৫৩ সালে ছিন রাজবংশের সম্রাট বাগানটি গড়লেও পরবর্তী সম্রাটদেরও জায়গাটি দারুণ পছন্দ হয়ে যায়। ১৭৫০ সালের দিকে এসে মিং রাজবংশের সম্রাট এলাকাটিতে নিত্য নতুন স্থাপনা নির্মাণ করতে থাকেন। আর ফরবিডেন সিটি থেকে গ্রীষ্মকালে সবাই চলে আসতে শুরু করেন। চীনের শাসনের কেন্দ্রবিন্দু ফরবিডেন সিটি থেকে প্রায় ২৬ কিলোমিটার দূরের এই কৃত্রিম ভূস্বর্গে রাজা–রাণীরা পুরো সভাসদ নিয়ে বছরে পাঁচ মাস কাটাতেন । ১ মে থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিশাল চীন সাম্রাজ্যের পুরো রাজকার্য পরিচালিত হতো এখান থেকে। নদী, পাহাড়, দ্বীপ এবং বাগানের সমন্বয়ে অনন্য হয়ে উঠা স্থানটিকে আদর করে নাম দেয়া সামার প্যালেস।
সামার প্যালেস পরবর্তী সম্রাটদের কাছে যতটুকু না ছিল প্রেমের তার থেকে ঢের বেশী ছিল ভোগ বিলাসের। সামার প্যালেসে রাণীর পথ চলার জন্য তৈরি করা হয় দুনিয়ার সবচেয়ে লম্বা করিডোর। ৭২৮ মিটার লম্বা এই করিডোর তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে সাংহাই থেকে আনা পাথর এবং বিশেষ কাঠ। পরো করিডোর জুড়ে হাজার হাজার চিত্রকর্ম। সবই শিল্পীরা নিজ হাতে এঁকেছেন। ফরবিডেন সিটি থেকে সামার প্যালেসে রাণীর নৌবিহারের জন্য খনন করা হয়েছে ২৬ কিলোমিটারের কৃত্রিম নদী। এই নদী ধরে নৌবহর আসতো সামার প্যালেসে। কৃত্রিম লেকের ঘাটে বানানো হয় সাদা মার্বেলের আস্ত জাহাজ। বিশাল করিডোর দিয়ে এসে ঘাটের ওই পাথরের জাহাজে বসে রাণী শুধু চা খেতেন। চীনের প্রথম বিদ্যুৎ দেয়া হয় এই সামার প্যালেসে। চীনে প্রথম গাড়িও বেইজিং থেকে চালিয়ে এই সামার প্যালসে আসে। রাণীকে নিয়ে মার্সিডিস বেঞ্জ কোম্পানির গাড়ি এসেছিল দুনিয়ার অন্যতম সেরা এই ভূস্বর্গে। ভোগ বিলাসে মাতোয়ারা সম্রাট, সম্রাজ্ঞী কিংবা রাজা রাণীরা কখনো কী ভাবতে পেরেছিলেন তাদের সবকিছু এভাবে সবার হয়ে যাবে! (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী