দূরপথ

বিপুল বড়ুয়া | শুক্রবার , ১৩ নভেম্বর, ২০২০ at ৫:২৮ পূর্বাহ্ণ

সৈকতের সাথে দেখা হয়েই যায় বীনুর। অবাক হয়ে যায় সৈকত বীনুর ইতিউতি ভাব দেখে। বীনু অনেক অনেক কিছু মনে করতে বসে। অনেক কিছু তালগোল পাকিয়ে যায় বীনুর। এ কোন সৈকতকে দেখছে বীনু!
সৈকত বীনুর কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়। মুখোমুখি হয় বীনুর। দেখে বীনুর চোখে কিসের লুকোচুরি। বীনু কি পালাতে চাইছে? কিংবা কিছু কি লুকোতে চাচ্ছে?
শিল্পকলার সামনের রাস্তা, বেশ সরগরম হয়ে ওঠছে। দই ফুচকা-চটপটির ভ্যানগুলো জুড়ে উপচেপড়া ভিড়। সবার বেশ জমিয়ে হালকা পাতলা খাওয়া। কেউ কেউ ঢুকে পড়ছে আশপাশের খাওয়ার দোকানে।
দুদিক থেকে ছুটে চলছে জম্পেস গাড়ি। হর্ন বেজে চলেছে সমানে। জ্যামে আটকে থাকার তর কাউকে চুপ থাকতে দিচ্ছে না। তাই ছাড় নেই ছোটাছুটিতে। হর্নেও।
ফুটপাতের ধার ঘেঁষে কেউ কেউ বসে পড়েছেও। সবার মাঝে যেনো কুচ পরোয়া নেই ভাব। যে যার মতো আড্ডায় বসে গেছে। কে কী ভাববে তা মাথায় নেই।
তারপরও বীনু ডেকে নেয় সৈকতকে। ভেতরে ভেতরে নিজকেও তৈরি করে নেয়। দেখা যখন হয়েই গেছে তখন কিছু তো একটা বলাবলির ব্যাপার তো থাকবেই। সৈকত না বলুক-তার তো কিছু বলার থাকতে পারে সৈকতকে। সেটা তো নিজে অস্বীকারও করতে পারে না বীনু। আর সৈকত তো তার চেনা জানার-কতো দেখার।
‘কী ব্যাপার সৈকত? কদিন থেকে তো ভার্সিটিতে যাচ্ছো না। ক্লাসেও তোমার দেখা নেই।’ সৈকতের মুখোমুখি বীনু। ‘কই যাচ্ছি তো। একটু ব্যস্ত ছিলাম। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে পার্টিতেও সময় দিতে হচ্ছে। এদিক সেদিক খানিকটা ছোটাছুটিও আছে। তাই কদিন একটু ব্যস্ত ছিলাম আরকি।’
চারপাশে আলো আঁধারি রাত ঝেঁকে বসেছে। ছুটে চলা গাড়ির হেডলাইটের আলো ঝিলিক দিয়ে মাঝে মাঝে আঁধার হটিয়ে দিচ্ছে। বীনু দেখে সৈকতকে।
‘তোমার অতসবে না গেলে হয় না সৈকত। তোমার কি খুব বেশি চাওয়ার কিছু আছে? জানি না তো?’
‘ক্লাসে তোমাকে স্যাররা ভারি পছন্দ করে। টিউটোরিয়ালে তোমার মার্কিং নিয়ে সবাই তোমাকে হিংসে করে। তোমার নোট সাজেশান নিয়ে সবার কাড়াকাড়ি…। তোমার রেজাল্টতো ভালো হচ্ছেই। তুমি তো আলোচনায় আছোও সমালোচনায় নেই।’
‘এতসবের পরও সৈকত তুমি এভাবে নিজকে গুটিয়ে নিচ্ছো কেনো বলো তো। কেনো তোমার এমন চুপ মারা।’
‘নিজের সাথে কেনো অবিচার করছো সৈকত।’
সৈকতকে কিছুই বলতে দেয় না বীনু। এক নাগাড়ে সব বলে যায় বীনু। বীনু চাইছে আজ সৈকতকে অনেক কিছু শুনিয়ে ছাড়বে। কোনো কথা বলতে দেবে না। যে সৈকত সব সময় এটা সেটা নিয়ে ফটাফট কথা বলে যায়-সেই সৈকতকে আজ দুমড়ে-মুচড়ে দিয়ে দেখিয়ে দেবে-চুপচাপ থাকার মেয়ে বর্ণনা নয়-বর্ণনার বীনুও যে কথা বলতে পারে-তা আজ দেখিয়ে দেবে সৈকতকে…।
সৈকত হঠাৎ চমকে যায়। হতবাক হয়ে পড়ে বীনুর এই সোজাসাপটা কথাবার্তা দেখে। বীনু কী বলে যায়? ইঙ্গিতে কি বোঝাতে চায় বীনু? সৈকত ভাবে-বীনু বেশ আটঘাট বেঁধেই নেমেছে। অনেক অনেক খবরাখবরও নিয়ে রেখেছে বীনু। আর বীনু তো মিথ্যে বলেনি। বাড়তি কিছু বলেনি। থ্‌ হয়ে যায় সৈকত।
সৈকত তো আজকাল নিয়মিত ক্লাসে যাচ্ছে না। রীতিমতো গ্রুপ মেনটেইন করা শুরু করেছে। বেশ বড়োসড়ো পদও পেতে যাচ্ছে গ্রুপে। সব্বাই বেশ খাতির যত্নও করছে সবাই। এমনকি বিভাগের দু’একজন স্যারও সৈকতকে আবডালে আড়ালে সমীহও যে করছে তা সৈকত ইতোমধ্যে টের পেতে শুরু করেছে। এ কান সে কান হয়ে সে সব কথা ক্যাম্পাসে ছড়িয়েও পড়েছে। তা অনেকের মতো বীনুর কানে পৌঁছাটা তো স্বাভাবিক।
তাইতো বীনু চটে মটে ওঠা। তাকে খুব করে পেয়ে বসা। ‘না বীনু তুমি যা ভাবছো তা ঠিক না। এই একটু মিছিল-মিটিং হলে সবাই ধরে বসে। ওদের সাথে মাঝে মধ্যে একটু ঘোরাঘুরি করা-ব্যস আর কিছু না।’
‘অতসব নিয়ে তুমি অযথা ভাবাভাবি করো না তো বীনু।’ দেখো আমি ঠিক ঠিক আবার ভালো ছেলের মতো সুড়সুড় করে ক্লাসে ঢুকে পড়ছি।’
‘আর রেজাল্ট। দেখো সবাইকে চমকে দিয়ে ক্লাস নিয়ে বেরিয়ে আসবো।’
যেনো লম্বা বক্তৃতা দিয়ে বসে সৈকত। বীনু সৈকতের চোখে মুখে দুচোখের আলো ফেলে পরখ করে সৈকতকে। কী বলে সৈকত? এতসব কি সৈকতের মন থেকে বলা। নাকি তাকে মিছেমিছি এটা সেটা বুঝিয়ে দেওয়া।
জানো সৈকত আমার খুব ভয় হয় আজকাল। ম্যালা গোলমাল লেগেই আছে ক্যাম্পাসে। শাটল ট্রেনে কী যে ভয়ঙ্কর দলাদলি। কেউ কাউকে ছাড় দেয় না। হলে হলে দিনে রাতে সংঘাত। পক্ষ-বিপক্ষের বক্তৃতা-রেষারেষি। কী কাণ্ড চলছে?’
‘আর শুনছি তোমার সাথে কার কার না যোগাযোগ। তুমি দল করছো-গ্রুপ করছো এর ওর সাথে। সব কানে আসে আমার। অথচ এরি মধ্যে তোমার সাথে দেখাও হচ্ছে না। কোনো খবরাখবর পাচ্ছি না-সৈকত। আমার খুব ভয় হচ্ছে সৈকত…।’
হাসে সৈকত। ‘দুর বাদ দাওতো ওসব বীনু। আমি ওসব ঝামেলায় নেই। কোনো ভেজালে নেই। সবার সাথে তাল মিলিয়ে চলি আর কি।’
বীনু সৈকতের দিকে তাকিয়ে থাকে। কী বলে সৈকত। এটা কি সৈকতের কথা। না তাকে নিছক সান্ত্বনা দেওয়া। কোনো রকমে পার পাওয়ার জন্য বলা।
সৈকত উঠে দাঁড়ায়। ‘কিছু খাবে-দই ফুচকা, চটপটি’। বীনু মাথা নাড়ে। শিল্পকলার মাঠে কাদের জমজমাট অনুষ্ঠান চলছে। ইথারে ভেসে বেড়াচ্ছে গানের কলি। সঞ্চালকের গলা চড়িয়ে বেশ উপস্থাপনা। গেটে ভিড় জটলা। আলো আঁধারে ভৌতিক অবয়ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল বিশাল রেইন ট্রি।
গেটের দিকে এগিয়ে যায় সৈকত-বীনু। দু’একজন চেনাজানাকে চোখে পড়ে। সোসিওলজির সায়মা, ফরেস্ট্রির নন্দিতা, বোটানির ফাহাদ হাই করে। বীনু প্রত্যুত্তর দেয়। সাথে সৈকতকে দেখে অবাক হয়ে তাকায় কেউ কেউ। চোখে-মুখে প্রশ্ন হয়তোবা। বীনু সব দেখে।
বীনু সে সব প্রশ্ন এ মুহূর্তে কাটাকুটি করে। ফিরে যেতে চায় না ক্যাম্পাসের কিংবা শার্টলের কথা কাহিনিতে। আলতো সৈকতের একটা হাত হাতে তুলে নেয়। কেমন ভারী জমাট বাঁধা যেনো। বীনু ভাবে সৈকতের এই ভারী হাতটা সে পাখির পালকের মতো হালকা করে নেবে-কলুষিত হতে দেবে না। এ হাতটা ধরে সে বেঁচে থাকবে-জীবনকে উপভোগ করবে-অনেক রঙিন স্বপ্ন বুনবে। আর হাতছাড়া করবে না সৈকতকে। তাকে নিয়ে পথ চলবে-দূরপথ-অনেক অনেক পথ…।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদুঃখ বিলাস
পরবর্তী নিবন্ধজোসেফ ব্রডস্কির একটি কবিতা