দুশ্চিন্তার বড় কারণ ছিনতাই

নগরীর অর্ধশতাধিক এলাকায় সক্রিয় চক্র ।। ভুক্তভোগী মামলা করতে অনাগ্রহী : পুলিশ ।। পুলিশ মামলা নিতে চায় না : ভুক্তভোগী ।। মাদকাসক্তি বড় কারণ : বিশেষজ্ঞ

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ৮ অক্টোবর, ২০২২ at ৫:৩৮ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামে দুশ্চিন্তার বড় কারণ এখন ছিনতাই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং ভুক্তভোগীদের অভিযোগ পাল্টা অভিযোগে পোয়াবারো ছিনতাইকারীদের। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা নিতে চায় না পুলিশ। তবে পুলিশ বলছে, ভুক্তভোগীরাই মামলা করতে চান না। অন্যদিকে বিশেষজ্ঞদের অভিমত ছিনতাইকারীদের অধিকাংশই মাদকাসক্ত। যখন তার মাদকের প্রয়োজন পড়ে, তখন সে টাকার জন্য চুরি-ছিনতাই থেকে শুরু করে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। পুলিশের একটি সূত্র জানায়, ছিনতাইকারীদের হালনাগাদ তথ্য এবং ছিনতাইয়ের সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান তাদের কাছে নেই। এতে অপরাধ দমনে কিছুটা হলেও অসুবিধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে তাদের।
চট্টগ্রাম নগরীর স্বর্ণ ব্যবসায়ী বিমান ধর প্রতিদিন রাতে দোকান বন্ধ করে পটিয়ায় নিজ বাড়িতে ফিরে যান। গত ৬ সেপ্টেম্বর একইভাবে বাড়ি ফেরার পথে আইয়ুব আলী ও জিল্লুর রহমান নামে দুই ছিনতাইকারী উপজেলার জঙ্গলখাইন এলাকায় তার গতিরোধ করে। এ সময় নগদ টাকা ও স্বর্ণের বার কেড়ে নিতে চাইলে বিমান ধর বাধা দেন। এক পর্যায়ে না পেয়ে তাকে জবাই করে হত্যা করে পালিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা।
যাত্রী বেশে চট্টগ্রাম নগরী থেকে ফটিকছড়ি যাওয়ার পথে সঞ্জয় দাশ (২৯) নামে এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে মালামাল ছিনতাই করে সিএনজি টেক্সি থেকে ফেলে দিয়েছে ছিনতাইকারীরা। এ সময় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে তিনি গুরুতর আহত হন। ভুক্তভোগী সঞ্জয় জানান, ১৫ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ১১টার দিকে চট্টগ্রাম নগরী থেকে গন্তব্যে যাওয়ার উদ্দেশে সিএনজি টেক্সিতে ওঠেন। এর আগে যাত্রীবেশে সিএনজিতে ওঠেন দুই ছিনতাইকারী। হাটহাজারীর মির্জাপুর এলাকার সরকারহাট কালী বাড়ি রাস্তার মাথা এলাকায় পৌঁছালে ছিনতাইকারী রাশেদ তার গলায় ছুরি ধরে তার কাছ থেকে মোবাইল, নগদ টাকা ও ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। এ সময় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে তিনি আহত হন।
গত ২২ মে রাতে পলাশ কান্তি দে নামে এক ব্যক্তি নগরীর ইপিজেড থানার ইপিজেড মোড়ের বে-শপিং সেন্টারের সামনে থেকে একটি সিটি সার্ভিস বাসে ওঠেন। তিনি ওই বাসে বন্দর থানার নিমতলা বিশ্বরোড মোড়ে আসার পর গাড়ি থেকে নামতে চান। কিন্তু বাসের চালক হালিশহর থানার বড়পোল মোড়ে নামিয়ে দেওয়ার কথা বলে তাকে নামতে দেননি। এরপর সিটি বাসটিতে যাত্রীবেশে থাকা তিন ব্যক্তি ভুক্তভোগী পলাশের বাম উরু ও হাতের আঙুলে ছুরিকাঘাত করেন। তার পকেট থেকে নগদ ১০ হাজার টাকা ও দুটি মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয় ছিনতাইকারীরা। রাত সাড়ে তিনটার দিকে পলাশকে লালখান বাজার ফ্লাইওভারের ওপর ফেলে পালিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা। সেখান থেকে দায়িত্ব পুলিশ সদস্যরা পলাশকে উদ্ধার করে একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা দেন।
এ তিনটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সাম্প্রতিক সময়ে ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে হতাহত হওয়ার ঘটনা ঘটছে অহরহ। তবে আহতদের অনেকেই আইনি ঝামেলায় পড়তে চান না, ফলে পুলিশের কাছেও যান না। হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে চলে যান। এদিকে অভিযোগ উঠেছে, ছিনতাই প্রতিরোধে পুলিশি টহল বাড়ানো হলেও কমছে না এসব ঘটনা। যদিও পুলিশ বলছে, চুরি কিংবা ছিনতাই ঠেকাতে কাজ করছেন তারা।
কোতোয়ালী থানার ওসি জাহিদুল কবির আজাদীকে বলেন, ছিনতাইয়ের ঘটনা প্রতিরোধে থানা পুলিশ কাজ করছে। থানা এলাকাগুলোয় নিয়মিত টহল দেওয়া হচ্ছে। রাস্তা খালি থাকার কারণে ছিনতাইয়ের প্রবণতা রাতে এবং ভোরবেলা বেশি দেখা যায়। যেকোনো ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটলে বা তাদের কবলে পড়লে সেটি সংশ্লিষ্ট থানাকে অবহিত করার পরামর্শ দেন এই কর্মকর্তা। মোবাইল ফোন ও নগদ অর্থ হারানোর ঘটনায় থানায় অভিযোগ করা হলেও পুলিশ ছিনতাইয়ের ঘটনাকে ‘পাত্তা দেয় না’ বলে ভুক্তভোগী অনেকের অভিযোগ। তবে ওসি কোতোয়ালীর ভাষ্য, ছিনতাইয়ের শিকার ব্যক্তিরা থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করলেও মামলা করতে অনীহার কারণে তারা ছিনতাই প্রতিরোধে তেমন কিছু করতে পারেন না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাদকাসক্তির কারণে চুরি-ছিনতাই যেমন বেড়ে যায়, ঠিক তেমনি এসব ঘটনা ঘটাতে গিয়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করতেও দ্বিধাবোধ করছে না ছিনতাইকারীরা। অ্যাথেনা মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও মানসিক স্বাস্থ্য পরামর্শ কেন্দ্রের মেন্টাল হেলথ কাউন্সেলর নুসরাত সাবরিন চৌধুরী বলেন, মাদকাসক্তির সঙ্গে অপরাধের একটি বড় যোগসূত্র রয়েছে। মাদকাসক্তি এক ধরনের মানসিক রোগ। মাদকের প্রতি নির্ভরশীলতা তৈরি হওয়ার কারণে ব্যক্তির স্বাভাবিক চিন্তাশক্তি থাকে না, বরং মাদকই তাকে নিয়ন্ত্রণ করে। যখন তার মাদকের প্রয়োজন পড়ে, তখন সে টাকার জন্য চুরি-ছিনতাই থেকে শুরু করে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। সমাজ থেকে মাদকাসক্তি দূর করতে মাদক প্রতিরোধমূলক নানা তৎপরতার পাশাপাশি পরিবারের ভূমিকা ও সচেতনতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
অভিযোগ রয়েছে, নগরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য বাড়লেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের তৎপরতা তেমন লক্ষণীয় নয়। মাঝে মধ্যে অভিযান ও গ্রেপ্তারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ সিএমপির ১৬ থানা পুলিশ। ছিনতাইকারী, টানা পার্টি, মলম পার্টি, গামছা পার্টি, অজ্ঞান পার্টির দলনেতা, হোতা গ্রেপ্তার বলা হলেও নগরীতে এসব অপরাধীদের দৌরাত্ম্য ঠেকাতে পারছে না পুলিশ। যার কারণে প্রতিদিনই সাধারণ মানুষ ছিনতাইকারী প্রতারকসহ বিভিন্ন অপরাধীদের টার্গেট হচ্ছে। মাঠ পর্যায়ের একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, তাদের কাছে আট বছর আগের এক তালিকায় শতাধিক ছিনতাইকারীর নাম আছে। তবে বর্তমানে তাদের অবস্থা কী এবং নতুন করে কারা ছিনতাইয়ে জড়িয়েছে তার বিস্তারিত তথ্য নেই।
পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, নগরীর প্রায় অর্ধশতাধিক এলাকায় সক্রিয় রয়েছে কয়েকটি ছিনতাইকারী চক্র। এসব চক্রে পেশাদার ছিনতাইকারীদের পাশাপাশি উঠতি বয়সী কিছু তরুণও জড়িয়ে পড়ছে। নগরীর ছিনতাইপ্রবণ হিসেবে পুলিশের খাতায় কোতোয়ালী থানার লাভ লেইন থেকে নেভাল অ্যাভেনিউ, এম এ আজিজ স্টেডিয়াম থেকে সিআরবি কাঠের বাংলো, টাইগারপাস মোড় থেকে কদমতলী, ডিসি হিল থেকে রাইফেল ক্লাব, শহীদ মিনার এলাকা, সার্সন রোড, আসকার দীঘির পাড় থেকে গণি বেকারি মোড়, রহমতগঞ্জ এলাকা চিহ্নিত। এছাড়াও নিউমার্কেট, বিআরটিসি মোড় এলাকায় মোবাইল ছিনতাইকারীরা সক্রিয়। চকবাজার থানার কলেজ রোড, খুলশী থানার জাকির হোসেন রোড, আমবাগান এলাকা, পতেঙ্গা থানার কাঠগড়, হালিশহর থানার বড়পোল এলাকা, বায়েজিদ বোস্তামী থানার মুরাদপুর অঙিজেন রোড, ষোলশহর-বায়েজিদ বোস্তামী সড়ক এলাকায়ও অহরহ ছিনতাই হচ্ছে।
সূত্রে জানা যায়, নগর পুলিশের সদস্যরা সশস্ত্র ছিনতাইকারীদের বেপরোয়ার বিষয়টি জানে। স্পটগুলোও প্রায় চিহ্নিত। এই স্থানগুলোতে নিত্যদিন ঘটনা ঘটলেও পুলিশের বড় কোনো অভিযান নেই। ছিনতাইয়ের শিকার অধিকাংশ ভুক্তভোগীর দাবি, পুলিশ ছিনতাইয়ের ঘটনাগুলোকে তেমন পাত্তা দেয় না। তাছাড়া থানা-আদালত ছোটাছুটি করতে হবে- এমন আশঙ্কায় অধিকাংশই মামলার ঝামেলায় যেতে চান না।
চট্টগ্রাম ইপিজেডের একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা জানান, কিছুদিন আগে অফিস থেকে ফেরার পথে বিআরটিসি মোড়ে বাস থেকে নামার পর তার মোবাইল ফোন ছিনতাই হয়। বিষয়টি থানায় জানালে তারা মামলা করার পরামর্শ দেয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, মামলা করতে আদালতে যাওয়াসহ নানা ঝক্কি-ঝামেলা এড়াতে অনীহা প্রকাশ করি। পরে জিডি করে চলে এলেও তাতে কোনো সুফল পাইনি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশান্তির নোবেল গেল বেলারুশ ইউক্রেন ও রাশিয়ায়
পরবর্তী নিবন্ধপ্রশ্নের উত্তর খুঁজে ফিরছে স্বজনরা