সামপ্রতিক সময়ে দারিদ্র্যের প্রকৃতি ও গতিশীলতা বেশ দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন। তাঁরা বলেন, সমাজে যেমন পরিবর্তন হচ্ছে, অর্থনীতিতেও পরিবর্তন হচ্ছে। আগে যে গতানুগতিক ধারা ছিল সেটি এখন বিদ্যমান নেই। এখন মানুষ দরিদ্র্য হচ্ছে বিভিন্ন কারণে। এর মধ্যে রয়েছে কাঠামোগত বৈষম্য, সমাজের ক্ষমতাবান ও অভিজাতদের প্রতি রাষ্ট্রের নীতিগত পক্ষপাত, বিশ্বায়নের প্রভাব, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের প্রতিকূল প্রভাব, জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত দুর্যোগ এবং চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে সম্পর্কিত আরো অনেক কারণ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দারিদ্র্যের একটি বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিঘাত আমরা সরাসরি মোকাবেলা করছি। জলবায়ুু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের প্রেক্ষাপটে দরিদ্র এবং নিম্ন আয়ের ঝুঁকিপূর্ণ পরিবারগুলোর জন্য এমন আর্থিক কৌশল তৈরি এবং বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন, যা দুর্যোগ মোকাবেলায় দ্রুত এবং কার্যকরভাবে পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। আমাদের এমন আর্থিক পণ্য এবং পরিষেবা ডিজাইন করতে হবে যা এই ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং কার্যকরভাবে সাড়া দেয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করবে, যা বাংলাদেশের তিনটি প্রভাবের পথকে অন্তর্ভুক্ত করবে: স্থিতিস্থাপকতা, অভিযোজন ও উত্তরণ। সমাজ ব্যবস্থা, কৃষি ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াও মানবসৃষ্ট দুর্যোগে দারিদ্র্যে প্রভাব পড়ছে। দারিদ্র্য সৃষ্টির নতুন কারণগুলো গভীরভাবে পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় নীতি গ্রহণ করতে হবে। দরিদ্র জনগোষ্ঠী যাতে আসন্ন দুর্যোগ মোকাবিলা করতে পারে সেই সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তফা কে মুজেরী এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, উন্নয়নশীল দেশগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে কার্যকর, দক্ষ ও ন্যায়সংগত সামাজিক নিরাপত্তা এবং সুরক্ষা কার্যক্রম দারিদ্র্য ও অসমতা সরাসরি হ্রাস করতে পারে। বাংলাদেশে দারিদ্র্য হ্রাসে অগ্রগতি সত্ত্বেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক জনসংখ্যা এখনো বিদ্যমান, যারা বিভিন্ন দুর্বলতার কারণে দারিদ্র্যের সংস্পর্শে থাকে। বাস্তবতা এটা দেখায় যে দরিদ্র ও নিকট–দরিদ্রগোষ্ঠী সব নেতিবাচক ঝুঁকি ও ধাক্কা মোকাবেলা করতে পারে না তাদের নিজস্ব সম্পদ ব্যবহার করে। ফলস্বরূপ বাংলাদেশে বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচি আবির্ভূত হয়েছে দরিদ্র ও নিকট–দরিদ্রদের সহায়তা করার জন্য, যাতে নেতিবাচক ঝুঁকি ও ধাক্কা তাদের কল্যাণ প্রভাবিত করতে না পারে। বাংলাদেশে সামাজিক সুরক্ষার আইনগত ভিত্তি দেশের সংবিধান দ্বারা প্রদান করা হয়েছে। বিগত বছরগুলোয় সামাজিক সহায়তা বাংলাদেশের প্রধান সামাজিক সুরক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। অন্তর্ভুক্তিমূলক রূপান্তর ও উন্নয়নের জন্য সামাজিক সহায়তার গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে এটি জোর দিয়ে বলা যেতে পারে যে দেশে বিদ্যমান সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা যাদের সামাজিক সুরক্ষা দরকার তাদেরকে সঠিক সুরক্ষা দিতে সক্ষম নয়। অর্থাৎ এটি সমাজের দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের জনগোষ্ঠীর সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করে না। সর্বজনীন সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি প্রায় অচল অবস্থায় আছে। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় শতাধিক প্রোগ্রাম আছে। এসব প্রোগ্রাম পরিচালনার ক্ষেত্রে দুর্নীতি থেকে শুরু করে অর্থের অপচয় বিদ্যমান। অনেক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় একটি পরিবারকে মাসে ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা দেয়া হয়। কিন্তু বর্তমান সময়ে এ সামান্য পরিমাণ টাকার তাদের জীবনযাত্রায় কোনো প্রভাব ফেলার ক্ষমতা কি আছে? সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি এমনভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে যাতে দরিদ্র জনগোষ্ঠী তাদের সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি পুনর্বাসন কর্মসূচিগুলোয় অন্তর্ভুক্ত হতে পারে ও নিজের আয়–উপার্জন বৃদ্ধি করে স্বাবলম্বী হতে পারে। আবার যারা বয়োবৃদ্ধ বা সক্ষমতা নেই তাদের জন্য এমন কর্মসূচি নিতে হবে যাতে তারা মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকতে পারেন। অর্থাৎ আমাদের সহায়তা কর্মসূচিগুলোকে ঢেলে সাজানো দরকার।
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির একটি দুর্বলতা হচ্ছে, ভাতা পাওয়ার উপযুক্ত নন, এমন অনেক মানুষকে রাজনৈতিক বিবেচনায় ও দুর্নীতির মাধ্যমে বাছাই করা হয়। যোগ্যতা থাকলেও অনেকে ভাতা পান না। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির এসব দুর্বলতা ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্যের চক্র থেকে বেরোনোর পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেন, অনেক যোগ্য (যাঁদের প্রয়োজন আছে) মানুষ সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধার আওতায় আসেননি, আবার অনেকে রাজনৈতিক বিবেচনায় এ সুবিধা পেয়েছেন। এখানে স্বচ্ছতা আনা জরুরি। অনেকগুলো মন্ত্রণালয়–দপ্তরের মাধ্যমে এ সেবা না দিয়ে সামাজিক নিরাপত্তাসেবা একক কাঠামোর মধ্যে আনা প্রয়োজন।







