আমরা জানি, বর্তমান সরকারের আমলে জনপ্রশাসনে দক্ষতা বৃদ্ধি, দুর্নীতি দমন ও শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়িত হয়েছে। জনপ্রশাসনে নিযুক্ত কর্মচারীরা যাতে স্বচ্ছতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে নাগরিকদের সেবা দিতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে কার্যক্রম চলছে। সে লক্ষ্যে জনপ্রশাসনের আইন-কানুন বিধি-বিধানের পরিবর্তন ও সংস্কার করে আরও যুগোপযোগী করার চেষ্টাও চলছে।
এ অবস্থাতেও দুর্নীতি কমে নি। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির জরিপে উঠে এসেছে গেল বছর দেশে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সেবা নিতে গিয়ে ৭০ দশমিক ৯ শতাংশ সেবাগ্রহীতা দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। গত বুধবার টিআইবি কার্যালয়ে ‘সেবা খাতে দুর্নীতি, জাতীয় খানা জরিপ ২০২১’ এর তথ্য তুলে ধরেন গবেষক ফারহানা রহমান। ১ সেপ্টেম্বর আজাদীতে প্রকাশিত ‘সেবা নিতে গিয়ে ৭০% দুর্নীতির শিকার’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে সবচেয়ে বেশি ৭৪ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ ‘দুর্নীতির শিকার হয়েছেন’ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার সেবা নিতে গিয়ে। অন্যদিকে ৭২ দশমিক ১ শতাংশ খানার উত্তরদাতা বলেছেন, সেবা পাওয়ার জন্য ঘুষ দিতে তারা বাধ্য হয়েছেন। এছাড়া ৭০.৫ শতাংশ খানার উত্তরদাতা পাসপোর্ট সংক্রান্ত কাজে, ৬৮.৩ শতাংশ উত্তরদাতা বিআরটিএতে, ৫৬.৮ শতাংশ উত্তরদাতা বিচারিক সেবায়, ৪৮.৭ শতাংশ উত্তরদাতা স্বাস্থ্যে, ৪৬.৬ শতাংশ উত্তরদাতা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে, ৪৬.৩ শতাংশ উত্তরদাতা ভূমি সেবায়, ৩৩.৯ শতাংশ উত্তরদাতা শিক্ষায়, ৩৩.৫ শতাংশ উত্তরদাতা বিদ্যুত সেবায়, ২৭.৮ শতাংশ জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগ সহায়তায়, ২৪.৫ শতাংশ কৃষিতে, ২২.২ শতাংশ বীমায়, ১৬.৩ শতাংশ এনজিওতে, ১৫.২ শতাংশ গ্যাসে, ১৫ শতাংশ ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানে, ১২.৪ শতাংশ কর ও শুল্কে এবং ১৭.৫ শতাংশ অন্যান্য ক্ষেত্রে সেবা নিতে গিয়ে ‘দুর্নীতির শিকার’ হওয়ার কথা বলেছেন।
দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিতেই এগিয়ে চললেও সরকারের নানা বিভাগে তা হ্রাস পায়নি। এ বিষয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার নির্দেশনায় দেশজুড়ে লেছে দুর্নীতিবিরোধী সর্বাত্মক অভিযান। যত প্রভাবশালী এবং সরকার কিংবা ক্ষমতাসীন দলের যত ঘনিষ্ঠই হোন না কেন, ছাড় দেননি কোনো অপরাধীকে। কারও ব্যক্তিগত অপরাধের দায় নিতেও নারাজ সরকার ও দল। সরকারের এই কঠোর অবস্থান সুধী সমাজসহ সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছে।
দেশে দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান থাকার পরও দুর্নীতির হ্রাস না হওয়ায় অবাক হচ্ছেন লোকজন। অভিযোগ আছে, তাঁরা দুর্বল আর সমাজের সাধারণ মানুষের বিষয়ে যতটা সোচ্চার, ততটা নন ক্ষমতাবান রাজনীতিবিদ, আমলা কিংবা ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে। দুর্নীতির অভিযোগ থাকলে সেগুলো খুব কমই আমলে নেওয়া হয় বলে মনে করেন দেশের অনেকে।
সাধারণ মানুষের মধ্যে দুর্নীতিবিরোধী সচেতনতা তৈরির ওপর জোর দিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, তাঁর এক বক্তৃতায়। তিনি বলেন, দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ার মাধ্যমেই কেবল দুর্নীতিকে সহনশীল মাত্রায় কমিয়ে আনা সম্ভব। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে সর্বব্যাপী প্রতিরোধ গড়ে তোলার বিকল্প নেই। কোনো মানুষ দুর্নীতিবাজ হিসেবে জন্মগ্রহণ করে না। পারিবারিক, সামাজিক ও আশপাশের পরিবেশই মানুষের জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে। তাই দুর্নীতিবিরোধী অভিযান নিজের ঘর থেকেই শুরু করতে হবে। দুর্নীতি ও দুর্নীতিবাজদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। সৎ, আন্তরিক ও নিষ্ঠাবানদের সামাজিকভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। তাহলেই দুর্নীতি হ্রাস পাবে।
বিশ্লেষকরা বলেন, একধরনের বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে দেশে। তাতে পরোক্ষভাবে দুর্নীতিবাজদের পৃষ্ঠপোষকতা করা হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে দুর্নীতির বিষয়টি অস্বীকার করা হয়। কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করলে নাগরিকসমাজ ও গণমাধ্যমকর্মীদের নাজেহাল হতে হয়। ফলে দুর্নীতিবাজরা এতে উৎসাহিত হচ্ছে। বাংলাদেশে আরও কয়েকটি কারণে দুর্নীতি কমানো যাচ্ছে না। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- রাজনীতিবিদদের প্রতিশ্রুতির ঘাটতি, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবহিদিতার অভাব, রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য অবস্থান সংকুচিত করে দেয়া এবং গণমাধ্যম ও সুশীলসমাজের প্রতিনিধিদের কথা বলার সুযোগ সীমিত করে দেয়া।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দুর্নীতি প্রতিরোধ ও দুর্নীতি দমনের অভিযানকে সফল করতে হলে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ-উদ্যমকে একযোগে কাজে লাগাতে হবে। তবে এই কঠিন লক্ষ্যে সফলতা অর্জনের একটি পূর্বশর্ত হচ্ছে দুর্নীতি সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা। যদি সংঘবদ্ধ ও সমন্বিতভাবে দুর্নীতির কদর্য চেহারাকে পরিচিত করে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে এবং জনস্বার্থে এর কুফল সম্পর্কে তথা জনসচেতনতা সৃষ্টি করা যায়, তাহলে দেশ আরও এগিয়ে যাবে।