দুর্নীতি জাতির জন্য একটি ক্যান্সার। ক্যান্সার যেমন মানব দেহের সকল কিছুকে ধ্বংস করে দেয়, ঠিক তেমনি দুর্নীতিও একটি জাতির সকল সম্ভাবনাকে ধ্বংস করে দেয়। চরিত্র হচ্ছে মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ। মানুষের যখন চারিত্রিক গুণাবলী ধ্বংস হয়ে যায়, তখন সে শুধু অপকর্ম করতে থাকে। দুর্নীতিই হয়ে ওঠে চরিত্রহীন মানুষের প্রধান কাজ।
তাই সমাজে শান্তি এবং জাতির উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার জন্য দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়তে হবে। আর এ জন্য দুর্নীতিকে নির্মূল করতে হবে। কিন্তু কেবল মাত্র আইন করে এবং দুর্নীতিবাজদের শাস্তি দিয়ে দুর্নীতি নির্মূল করা ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠন করা কিছুতেই সম্ভব নয়। দুর্নীতি নির্মূল ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠন করতে প্রয়োজন দুর্নীতিমুক্ত মানুষ অর্থাৎ সৎ মানুষ। কারণ, আইনের প্রয়োগ যিনি করবেন, তিনি যদি সৎ না হন তাহলে সেখানে আইন যথাযথ কার্যকর হয় না এবং সেটাই দুর্নীতি।
করোনা মহামারি মোকাবিলায় স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতি সম্পর্কে যেমন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোচ্চার হয়েছেন, তেমনি দুস্থ মানুষের ত্রাণ বিতরণে অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন বারবার; যথাযথ ব্যবস্থাপনার নির্দেশ দিয়েছেন দলীয় নেতা-কর্মীকে। এবার সরকার গঠন করার পর জাতির উদ্দেশ্যে প্রথম ভাষণ থেকেই তিন দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থানের কথা স্পষ্ট করে প্রকাশ করেছেন। এর পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাদশ সংসদের অষ্টম অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে ৯ জুলাই ২০২০ বলেছেন, দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি যেই হোক তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া অব্যাহত থাকবে। তিনি বলেন, ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সরকার দুর্নীতি ও অনিয়মের সাথে জড়িতদের দলীয় পরিচয় বিবেচনা না করেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া শুরু করে। ‘কে কোন দলের সেটি (আমাদের কাছে) বড় কথা নয়।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, দুর্নীতি বন্ধ করতে গিয়ে সরকারকে উল্টো দুর্নীতির দোষ দেয়া হচ্ছে। ‘আমরা দুর্নীতিবাজদের ধরছি। আর চোর ধরে যেন আমরাই চোর হয়ে যাচ্ছি।’ তবে, আওয়ামী লীগ সরকার অনিয়ম বন্ধে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকবে বলে জানান শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রীর এই কথা মিডিয়ায় আসার পরের দিনই স্বাস্থ্য খাতে বিগত ১০ বছরের দুর্নীতি ও অনিয়ম তদন্তে ১১ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। দায়িত্ব দেয়া হয়েছে একটি বিশেষ সংস্থাকে। গ্রেফতার করা হয়েছে কোভিড-১৯ নিয়ে প্রতারণা ও দুর্নীতিতে জড়িত ব্যক্তিবর্গকে। বিশেষত করোনা পরীক্ষায় ভুয়া রিপোর্ট দিয়ে প্রতারণাসহ বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগে প্রভাবশালী কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
আগেই বলা হয়েছে, দুর্নীতি একটি জাতীয় ব্যাধি। এটি সমাজে বৈষম্য সৃষ্টি করে। সুষম রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন ব্যাহত করে। জাতীয় এ সমস্যা প্রতিরোধে একটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুদককে গড়ে তোলা হয়েছে।
দেশপ্রেম, আদর্শ ও নৈতিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান নিতে হবে। দুর্নীতি প্রতিরোধের আন্দোলনকে সর্বজনীন করার লক্ষ্যে জাতিসংঘ বছরের একটি দিনকে আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। আমাদের পূর্বপুরুষেরা অনেক ত্যাগ ও কষ্টের বিনিময়ে আমাদের এই স্বাধীন বাংলাদেশ উপহার দিয়েছেন। কিন্তু আজ এই দুর্নীতি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন ও চেতনাকে অবমাননা করছে। সমাজ হতে দূরে সরে যাচ্ছে আদর্শ ও নৈতিকতা। এই অবস্থার পরিবর্তন করতে এদেশের যুবসমাজ সবচেয়ে বড় শক্তি। অদম্য আগ্রহ, সৃজনশীলতা এবং সুন্দর বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্ন নিয়ে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে যুবসমাজের সর্বাত্মক অংশগ্রহণ আজ সময়ের দাবি। দুর্নীতিকে ‘না’ বলার প্রত্যয়দীপ্ত অঙ্গীকার নিয়ে সর্বাত্মক নৈতিকতা চর্চার সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। দুর্নীতি দমনের জন্য সামাজিক আন্দোলনের বিকল্প নেই। দেশের যুবসমাজ অসততা, অন্যায় ও দুর্নীতির বিরোধিতা শুরু করলেই কেউ কোনো অনিয়ম বা দুর্নীতি করার সাহস পাবে না। দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে সবাইকে একসাথে কাজ করতে হবে। সমাজে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তরুণদেরকে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ বিষয়ক শিক্ষা দিতে হবে। মানুষের লোভ দমন করতে হবে। এক্ষেত্রে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন আলোচনা ও সেমিনারের আয়োজন করা যেতে পারে। আমরা প্রত্যেকে যদি আমাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে দেশপ্রেম, নৈতিকতা ও সামাজিক দায়বদ্ধতার আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে দুর্নীতির মূলোৎপাটন করতে পারি, তবে এর সুফল দেশের প্রতিটি নাগরিক ভোগ করবে এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে।