দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ বলেছেন, শুধু আইন দিয়ে দুর্নীতি কমানো সম্ভব নয়। গেল বছর ১ হাজার ৮০টি অভিযোগ পর্যালোচনা করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যেসব অভিযোগ কমিশনে আসে, তার বেশিরভাগই তফসিলবহির্ভূত। আর বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে গণমাধ্যম বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে কথা বললেও সুনির্দিষ্ট তথ্য–প্রমাণ তাদের কাছ থেকে পাওয়া যায় না।’
‘দুর্নীতি দমনে নাগরিকদের ভূমিকা’ শীর্ষক এক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে একথা বলেন দুদক চেয়ারম্যান। শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া মিলনায়তনে এ সেমিনারের আয়োজন করে মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি)। দুদক চেয়ারম্যান বলেন, ‘নাগরিক সচেতনতা সৃষ্টি না হলে, সামাজিকভাবে দুর্নীতিবাজদের বয়কট না করলে শুধু আইন দিয়ে দুর্নীতি কমানো সম্ভব নয়। দুর্নীতি রেখে দেশের উন্নয়নও সম্ভব নয়, হলেও সে উন্নয়ন টেকসই হবে না। দুর্নীতি সহনীয় পর্যায়ে আনতে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সম্প্রতি জাতীয় সংসদে দুর্নীতি দমনে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতির কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, দুর্নীতির কারণে দেশের সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। সংসদে এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা আরও বলেন, কেবল আইন প্রয়োগ ও শাস্তির মাধ্যমে দুর্নীতি রোধ সম্ভব নয়। সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলে সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে দুর্নীতির মূলোৎপাটন করা হবে। তিনি বলেন, দেশ ক্রমাগত এগিয়ে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধির সঙ্গে মানুষের জীবনমানেরও উন্নয়ন ঘটেছে। তাই অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি জ্বালানি, প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদাও ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে। ফলে গ্যাস চাহিদার সরবরাহ সামঞ্জস্যপূর্ণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এ সময় তিনি জ্বালানি খাতের উন্নয়নে সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তার ফিরিস্তি তুলে ধরেন।
আমরা জানি, বর্তমান সরকারের আমলে জনপ্রশাসনে দক্ষতা বৃদ্ধি, দুর্নীতি দমন ও শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়িত হয়েছে। জনপ্রশাসনে নিযুক্ত কর্মচারীরা যাতে স্বচ্ছতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে নাগরিকদের সেবা দিতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে কার্যক্রম চলছে। সে লক্ষ্যে জনপ্রশাসনের আইন–কানুন বিধি–বিধানের পরিবর্তন ও সংস্কার করে আরও যুগোপযোগী করার চেষ্টাও চলছে।
এ অবস্থাতেও দুর্নীতি কমে নি। প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, দুর্নীতির কারণে দেশের সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিতেই এগিয়ে চললেও সরকারের নানা বিভাগে তা হ্রাস পায়নি। এ বিষয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার নির্দেশনায় দেশজুড়ে চলেছে দুর্নীতিবিরোধী সর্বাত্মক অভিযান। যত প্রভাবশালী এবং সরকার কিংবা ক্ষমতাসীন দলের যত ঘনিষ্ঠই হোন না কেন, ছাড় দেননি কোনো অপরাধীকে। কারও ব্যক্তিগত অপরাধের দায় নিতেও নারাজ সরকার ও দল। সরকারের এই কঠোর অবস্থান সুধী সমাজসহ সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দুর্নীতি প্রতিরোধ ও দুর্নীতি দমনের অভিযানকে সফল করতে হলে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ–উদ্যমকে একযোগে কাজে লাগাতে হবে। তবে এই কঠিন লক্ষ্যে সফলতা অর্জনের একটি পূর্বশর্ত হচ্ছে দুর্নীতি সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা। যদি সংঘবদ্ধ ও সমন্বিতভাবে দুর্নীতির কদর্য চেহারাকে পরিচিত করে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে এবং জনস্বার্থে এর কুফল সম্পর্কে তথা জনসচেতনতা সৃষ্টি করা যায়, তাহলে দেশ আরও এগিয়ে যাবে।
সাধারণ মানুষের মধ্যে দুর্নীতিবিরোধী সচেতনতা তৈরির ওপর জোর দিয়েছিলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, তাঁর এক বক্তৃতায়। তিনি বলেন, দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ার মাধ্যমেই কেবল দুর্নীতিকে সহনশীল মাত্রায় কমিয়ে আনা সম্ভব। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে সর্বব্যাপী প্রতিরোধ গড়ে তোলার বিকল্প নেই। কোনো মানুষ দুর্নীতিবাজ হিসেবে জন্মগ্রহণ করে না। পারিবারিক, সামাজিক ও আশপাশের পরিবেশই মানুষের জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে। তাই দুর্নীতিবিরোধী অভিযান নিজের ঘর থেকেই শুরু করতে হবে। দুর্নীতি ও দুর্নীতিবাজদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। সৎ, আন্তরিক ও নিষ্ঠাবানদের সামাজিকভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। তাহলেই দুর্নীতি হ্রাস পাবে।