দুর্নীতি আমাদের দেশের বড় সমস্যা হিসেবে বিবেচিত। দুর্নীতির মাধ্যমে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা সীমাহীন সম্পদ গড়ার খবর দেশের মানুষের কাছে অস্বস্তিকর ধারণার জন্ম দিয়েছে। এদের দুর্নীতির খবর প্রকাশ হয়ে যাওয়ার কারণে জনসাধারণ তাদের বিষয়ে অবগত হয়েছেন। অনেকের ধারণা, দেশের অভ্যন্তরে এরকম অনেক দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষ আছেন, যাদের জন্য দেশের অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। দুর্নীতির মাধ্যমে যারা সম্পদশালী হচ্ছেন কিংবা হয়েছেন, তাদের ব্যাপারে খোঁজ–খবর অব্যাহত রাখলে দেখা যাবে–একদিন না একদিন আসল তথ্য প্রকাশিত হয়ে যাবে।
বিশেষঞ্জরা বলেন, দুর্নীতি আমাদের রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক কাঠামোর রন্ধ্রে রন্ধ্রে এমনভাবে সংক্রমিত দুরারোগ্য ক্যানসারের মতো বিস্তার লাভ করছে যা থেকে বিপজ্জনক অস্ত্রোপাচারের পরও আরোগ্য লাভ কষ্টসাধ্য। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সর্বত্র এ সমাজব্যাধি শক্ত শেকড় গেড়ে বসেছে। বিস্ময়ের ও একই সঙ্গে পরিতাপের বিষয় এই যে ব্যবসায়ী সম্প্রদায় ও ইদানীং অল্প কয়েকটি সমাজ প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য কোনো সামাজিক সংগঠন বা সুশীল সমাজের সদস্য কেউ প্রকাশ্যে এ কথা স্বীকার করছেন না যে আমাদের গোটা সমাজ অসম্ভব রকমের দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে, আমরা মারাত্মক সামাজিক ব্যাধিতে ভুগছি। যদিও খোদ প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে সোচ্চার ও উচ্চকণ্ঠ। তিনি নিজে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন, আমাদের বাসায় পিয়নের কাজ করতো যে–জন, সে এখন চারশ কোটি টাকার মালিক। কীভাবে এটা সম্ভব? এছাড়া জাতীয় সংসদের ২০২৪–২০২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। দুর্নীতি বিষয়ে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দুর্নীতিগ্রস্ত কোনো ব্যক্তিকেই ছাড় দেওয়া হবে না, সেই যে–ই হোক।
সামাজিক সংগঠন কিংবা সুশীল সমাজের বেশিভাগ মানুষ যেখানে প্রকাশ্যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে তেমন কিছু বলছেন না, সেখানে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শুধু গুরুত্ববহ নয়, সময়োপযোগী ও প্রশংসাযোগ্য। সাবেক পুলিশ প্রধান, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক সদস্যসহ বেশ কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তার দুর্নীতির অভিযোগ আলোচনায় এলে প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেন। শুধু সরকারের সাবেক কর্মকর্তা নয়, বর্তমান কর্মকর্তা–কর্মচারীদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য হুঁশিয়ারি বার্তা হিসেবে পরিগণিত হবে। তিনি যখন বলেন ‘দুর্নীতি করলে কারো রক্ষা নেই। যারা দুর্নীতি করবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’ প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্যে দুর্নীতিবাজরা কতটুকু শংকিত জানা না গেলেও দেশের মানুষ কিন্তু খুবই খুশি। কেননা, ‘দুর্নীতি দেশের অর্থনেতিক উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং জাতির নৈতিক উন্নয়নের প্রধান অন্তরায়’।
দুর্নীতি এমন এক ভয়ংকর সামাজিক ব্যাধি, যা নির্মূল করা মোটেই সহজ কাজ নয়। তবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আপামর জনসাধারণ দাঁড়ালে বা ভূমিকা পালন করলে দুর্নীতি নামক গভীর দুষ্টক্ষতের বিস্তার রোধ করা মোটেই অসম্ভব কাজ নয়। এছাড়া সরকার ও সুশীল সমাজের দুর্নীতি প্রতিরোধে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ, নতুন নতুন সামাজিক মূল্যবোধ, সুশাসন ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দুর্নীতি বহুলাংশে কমিয়ে আনা যাবে। আমরা মনে করি, দুর্নীতি দমন বিষয়টি সকলের দায়িত্ব হওয়া উচিত। দুর্নীতিমুক্ত সমাজ ও প্রশাসন গড়তে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে সনিষ্ঠ আন্তরিকতায়। প্রধানমন্ত্রী যেভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছেন, ঠিক সেভাবে আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
অর্থনীতিবিদরা বিশ্বব্যাপী দুর্নীতিকে দুষ্টক্ষত হিসেবে শনাক্ত করেছেন। তাঁরা বলেছেন, ‘গণতন্ত্র ও উন্নয়নের পথে দুর্নীতি যেমন সবচেয়ে ক্ষতিকর, তেমনি সমাজ কল্যাণ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পথে দুর্নীতি হলো এককভাবে সবচেয়ে বিপজ্জনক বাধা।’ তাই এই দুষ্টক্ষত যদি নিরাময় করা না হয়, তাহলে আমাদের সমাজ ব্যবস্থা অচিরেই পুরোপুরি অকার্যকর হয়ে পড়বে। সুতরাং দুর্নীতি বিরোধী অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে। এ অভিযান যেন সুসংহত ও গতিময় হয়– সেই প্রত্যাশা আমাদের।