অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের সব পর্যায়ে সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে কঠোরভাবে দুর্নীতি দমনের জন্য সচিবদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, স্বাধীনভাবে নব উদ্যোমে সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে। দুর্নীতি কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। সাহসের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হবে। কারও কোনো কথায় কান না দিয়ে বিবেকের ওপর আস্থা–বিশ্বাস রেখে সততার সঙ্গে সরকারি দায়িত্ব সম্পন্ন করতে হবে। সরকারের সব কাজ হবে মানুষের জন্য, মানুষের কল্যাণ ও জনস্বার্থে। প্রধান উপদেষ্টার তেজগাঁও কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সচিব সভায় সরকারের সচিবদের উদ্দেশে তিনি এসব কথা বলেছিলেন। প্রধান উপদেষ্টা সচিবদের উদ্দেশে আরও বলেন, অধিক্ষেত্রে কাজ করতে গিয়ে কী কী সমস্যায় পড়ছেন, তা চিহ্নিত করে সেগুলো সংস্কার করুন। স্বাধীনভাবে সরকারি দায়িত্ব পালনে বাধাগুলো কী, তা ঠিক করুন। সমস্যাগুলো সমাধানে কোনো আইনগত বাধা থাকলে আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিন। স্বাধীন মনোভাব নিয়ে নির্মোহভাবে দায়িত্ব পালন করুন। কোনো ধরনের হীনম্মন্যতায় ভুগবেন না।
প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, দুর্নীতি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে। সরকারি অফিসে সেবা নিতে গিয়ে মানুষকে হয়রানির শিকার হতে হয়। সুবিধা না দিলে সেবা মেলে না। এসব আর চলবে না। সরকারি অফিস হবে মানুষের ভরসাস্থল। তিনি আরও বলেন, দুর্নীতির মূলোৎপাটন করে সেবা সহজ করার মাধ্যমে জনগণের সর্বোচ্চ সন্তুষ্টি অর্জন করতে হবে। সরকারি অর্থের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। সরকারি কেনাকাটায় যথার্থ প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতে বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করতে হবে। ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এরপর ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এ সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এটিই ছিল প্রথম সচিব সভা।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের এক বছর অতিবাহিত হতে চলেছে। কিন্তু দুর্নীতি দমন হলো কতটুকু। বিশ্লেষকরা বলেন, ‘দেশের মানুষ এখনও আগের মতোই, কোথাও কোথাও আগের চেয়ে বেশি দুর্নীতির শিকার হচ্ছে। সেবার বিনিময়ে ঘুষ দেওয়া এখনও দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য অংশ হয়ে আছে। সরকারি অফিসগুলোতে এখনও ঘুষ ছাড়া কোনো কাজ হয় না। তাহলে প্রশ্ন জাগে, এই সরকার কি আদৌ দুর্নীতি দমন করতে চেয়েছিল? সরকারের কোনো পরামর্শদাতা কি হঠাৎ কোনো সরকারি দপ্তরে গিয়ে সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা জানার চেষ্টা করেছেন? বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ–বিআরটিএ, সাব–রেজিস্ট্রি অফিস কিংবা সরকার পরিচালিত হাসপাতালগুলোতে হঠাৎ অভিযান চালিয়ে দায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিয়েছেন? না। বরং এই অচল কাঠামোর মধ্যেই তারা যেন আরামদায়ক অবস্থানে বসে আছেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনো প্রতীকী পদক্ষেপও নেওয়া হয়নি। সাধারণ মানুষের মনে আশা সঞ্চার করার মতো কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ দেখা যায়নি। একবারও কেউ মাঠ পর্যায়ে না গিয়ে শুধু ফাইলপত্র ও আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ থেকেছেন। বিশেষ করে প্রশাসনে বদলি ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে দুর্নীতি আজও প্রকট। বরং এখন ঘুষের অঙ্ক আরও বড় হয়েছে। পার্থক্য এই যে, এখন কর্মকর্তাদের আগের মতো রাজনৈতিক নেতাদের খুব একটা ভাগ দিতে হয় না। অভিযোগ আছে, বর্তমান কর্মকর্তাদের বড় একটি অংশই ছিল আগের সরকারের দোসর, যারা ক্ষমতা ধরে রাখতে গণতন্ত্র ও সাধারণ মানুষের জীবনকে জলাঞ্জলি দিয়েছিল। তাদের স্বপদে বহাল থাকাও সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তোলার জন্য যথেষ্ট।’
সাধারণ মানুষের মধ্যে দুর্নীতিবিরোধী সচেতনতা তৈরির ওপর জোর দিচ্ছেন বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ। তাঁরা বলেন, দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ার মাধ্যমেই কেবল দুর্নীতিকে সহনশীল মাত্রায় কমিয়ে আনা সম্ভব। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে সর্বব্যাপী প্রতিরোধ গড়ে তোলার বিকল্প নেই। কোনো মানুষ দুর্নীতিবাজ হিসেবে জন্মগ্রহণ করে না। পারিবারিক, সামাজিক ও আশপাশের পরিবেশই মানুষের জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে। তাই দুর্নীতিবিরোধী অভিযান নিজের ঘর থেকেই শুরু করতে হবে। দুর্নীতি ও দুর্নীতিবাজদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। সৎ, আন্তরিক ও নিষ্ঠাবানদের সামাজিকভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। তাহলেই দুর্নীতি হ্রাস পাবে। তাঁরা বলেন, দুর্নীতিকে হয়তো নিঃশেষ করা সম্ভব না। তবে দুর্নীতি করার পথকে রুদ্ধ করতে হবে।