বিমান বিধ্বস্ত হয়ে ঢাকার মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজে বহু শিশুর মৃত্যুর পর চীনের তৈরি ‘এফ–৭ বিজিআই’ যুদ্ধবিমানের নিরাপত্তা ও নির্ভযোগ্যতার প্রশ্নটি সামনে এলেও তা মানতে রাজি নন বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খান। তিনি বলেছেন, বিমানবাহিনীর বহরে থাকা জঙ্গি বিমানগুলোর বয়স বেশি হলেও লাইফটাইম পার হয়ে যায়নি। আর এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণে কোনো ছাড় দেয় না বিমানবাহিনী।
গতকাল মঙ্গলবার কুর্মিটোলায় বীর উত্তম এ কে খন্দকার বিমানবাহিনী ঘাঁটিতে ওই বিধ্বস্ত বিমানের পাইলট, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলামের ফিউনারেল প্যারেড শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নে এ বিষয়ে কথা বলেন তিনি। দুর্ঘটনায় পড়া এফ–৭ বিজিআই যুদ্ধবিমানটি পুরনো হয়ে গিয়েছিল বলে যে কথা উঠেছে, সে বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, বিমান সাধারণত সহজে পুরাতন হয় না। প্রত্যেকটা বিমানেরই একটা লাইফটাইম আছে। সুতরাং এই বিমানগুলোর প্রায় ৩০ বছর পর্যন্ত লাইফটাইম আছে। এক যুগ, দুই যুগ কোনো ব্যাপার না, ব্যাপারটা হচ্ছে আমরা এটাকে ঠিকমত রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারছি কিনা? আমি আপনাদের আশ্বস্ত করতে চাই, আমরা আমাদের বিমানের কোনো কম্প্রোমাইজ করি না রক্ষণাবেক্ষণে। কেননা যে দেশ থেকে বিমান কিনি সেদেশ থেকে আমরা রক্ষণাবেক্ষণের সমস্ত প্রযুক্তি এবং দরকার হলে যা যা প্রয়োজন হয়, সেটাও আমরা তাদের সাথে চুক্তি করে নিই। সুতরাং আমাদের রক্ষণাবেক্ষণ সব ভালো হয় বিমানের, ইঞ্জিনের। খবর বিডিনিউজের।
তবে এই বিমানের প্রযুক্তি যে পুরনো হয়ে গেছে, সে কথা স্বীকার করে এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খান বলেন, একটা কথা বলতে পারি, প্রযুক্তিগতভাবে এই বিমানগুলো পুরনো হয়েছে, এই বিমান পুরনো না, প্রযুক্তিগতভাবে পুরনো। নতুন প্রযুক্তির বিমানের জন্য অবশ্যই আমরা চেষ্টা করছি। আপনারা সবাই জানেন, আমরা ভবিষ্যতে নতুন প্রযুক্তির বিমান আনব। তার মানে এই না যে, ওইটা অ্যাকসিডেন্ট হবে না। হইতেই পারে, সেটা হচ্ছে আসল কথা। কিন্তু এই বিমানগুলো আমরা যথাসম্ভব ভালোভাবে মেরামত করি, দেশে–বিদেশে সব জায়গায় আমরা এগুলোকে যা যা রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন হয়, সেগুলো করি।
দুর্ঘটনা প্রতিরোধের ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, দুর্ঘটনা প্রতিরোধে আমাদের বিভিন্ন রকমের পরিকল্পনা তৈরি আছে। সারা বিশ্বে যেভাবে হয়, আমরাও সেভাবে করে চলেছি। তারপরও দুর্ঘটনা হয়। আপনি উন্নত বিশ্বেও দেখবেন, বড় বড় অত্যাধুনিক জঙ্গিবিমান আছে, সেগুলোও দুর্ঘটনায় পতিত হয়। কিছুদিন আগে এফ–৩৫ জঙ্গিবিমানও দুর্ঘটনায় উপনীত হয়েছে। তো, সেটা তো আর কেউ গ্যারান্টি দেবে না। আমরা অবশ্যই এই দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা নেব, ভবিষ্যতে সেটা প্রতিকার করব ইনশাআল্লাহ।
বিমানের ইঞ্জিনের অবস্থা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের গুজবে বিশ্বাস না করার পরামর্শ দিয়ে বিমানবাহিনী প্রধান বলেন, গুজব বিশ্বাস কইরেন না, এটা আমার সবার প্রতি অনুরোধ। ইঞ্জিনেও আমরা অনেক বেশি কেয়ারফুল। কেননা আমার একজন পাইলটের একটাই ইঞ্জিন। সো, আমরা ইঞ্জিন নিয়ে কখনো কম্প্রোমাইজ করি না। এটা প্রযুক্তিগতভাবে পুরনো। কিন্তু এই ইঞ্জিনের যত ঘণ্টা থাকার কথা, তার এক ঘণ্টাও বেশি ফ্লাই করি না। এবং এটা যা যা মেরামত করার কথা, আমরা সম্পূর্ণভাবে করি। সুতরাং এ ব্যাপারে আমাদের মনে কোনো সন্দেহ নাই। কিন্তু বিকল যখন হবে, সেটা বলে কয়ে হয় না, সেটা কখন হবে আমরা সেটা বলতে পারি না। আমরা কম্প্রোমাইজ করেছি এমন কোনো সন্দেহ আমার মনে নাই।
কারণ জানতে ধৈর্য ধরতে হবে : পাইলটের মৃত্যু ও জঙ্গিবিমানটি গুঁড়িয়ে যাওয়ায় দুর্ঘটনার কারণ জানতে ধৈর্য ধরার পরামর্শ দিয়েছেন হাসান মাহমুদ খান। তিনি বলেন, আমি এই মুহূর্তে দেশে ইউনিফর্ম পরা সিনিয়র মোস্ট এয়ারম্যান। তারপরও আমার নিজস্ব কোনো ধারণা এখন বলা উচিত হবে না। তবে অবশ্যই এটা একটা সিঙ্গেল ইঞ্জিন বিমান, আমাদের এই ইঞ্জিনের অনেক টেকনিক্যাল প্রবলেম হতে পারে, পাখির আঘাত হতে পারে, অন্য কিছু হতে পারে। শেষ মুহূর্তে এত কম সময় ছিল, অনেক কিছু বলতে পারতাম, যদি বিমানটা অক্ষত থাকত অথবা পাইলট আমাদের সাথে থাকত। কিন্তু এই দুজনের একটাও নাই আমাদের কাছে। তদন্ত করতে একটু সময় লাগবে জানিয়ে সে পর্যন্ত ধৈর্য ধরার আহ্বান জানান তিনি।
স্কুলের খালি মাঠে নামানোর চেষ্টা করার কারণে পাইলট তৌকির ইসলাম বিমান থেকে অক্ষত অবস্থায় বের হওয়ার সুযোগ পাননি বলে ধারণা বিমানবাহিনী প্রধানের। তিনি বলেন, বিমানটা যখন পাইলটের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে, তখন সে সর্বোপরি চেষ্টা করেছে বিমানটাকে একটা খালি জায়গায়, বিশেষ করে ওই মাঠটায় গিয়েছিল, যেখানে সে নামানোর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তার সেই চেষ্টা সফল হয়নি বলব। কারণ বিমানটা আছড়ে পড়েছিল বিল্ডিংয়ের উপরে। কিন্তু সে সেই নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্য, বিমানটাকে দিকনির্দেশনায় যাওয়ার জন্য যে মূল্যবান সময় দিয়েছে, তার জন্য তার যে ইজেকশন বলি আমরা, বিমান থেকে বের হওয়ার যে পদ্ধতি আমাদের, সেটা বিলম্বিত হয়ে যায় এবং তার ফলে সে তার নিজের জীবন উৎসর্গ করেছে বা সে আজ আমাদের মাঝে নাই।
লুকানোর কিছু নাই, কার কাছ থেকে লুকাব? : বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া লাশ লুকানোর গুজবও এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিচ্ছেন এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খান। তিনি বলেন, ক্র্যাশ সাইটে এক ধরনের অশান্তি বিরাজ, এটা খুবই দুঃখজনক। অনেক গুজব চলছে, এই গুজবে কান দেবেন না। যখন আমাদের কাছে যে আপডেট আসছে, আহত–নিহতের, সেটা আমরা সাথে সাথে আইএসপিআরের মাধ্যমে আপনাদেরকে জানিয়ে দিচ্ছি। এখানে লুকানোর বা গোপন করার কোনো বিষয়ই নাই। কার কাছ থেকে লুকাব? আপনারা আমাদের দেশের মানুষ, আমরাও এই দেশের মানুষ। দুর্ঘটনা, দুর্ঘটনাই। আমরা চেষ্টা করছি, এটাকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে।
তিনি বলেন, সরকারের পাশাপাশি বিমানবাহিনীও সবসময় হতাহতদের পাশে থাকবে এবং থাকছে। আহতদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে যা যা করণীয়, আমরা সবকিছু করব। গতকালই আমরা উচ্চ পর্যায়ের একটা তদন্ত দল গঠন করে দিয়েছি। তারা অতি শিগগির এই তদন্ত করে বের করবে যে, কী ঘটনা ঘটেছিল এবং তার প্রেক্ষিতে যদি কোনো ভুলত্রুটি থেকে থাকে, আমরা ভবিষ্যতে তার অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।
বিমানবাহিনীর প্রধান বলেন, আপনাদের মাধ্যমে দেশবাসীকে একটা বিশেষ অনুরোধ করতে চাই, সেটা খুব জরুরি আমার জন্য, আপনাদের মাধ্যমে বলা, সেটা হচ্ছে দয়া করে আপনারা দেশের এই বিপদে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন গুজব, ভুল তথ্যে কান দেবেন না। একটা শক্তিশালী বিমানবাহিনী দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য অপরিহার্য। দয়া করে গুজব ছড়িয়ে দেশের সার্বভৌমত্বের এই স্তম্ভকে দুর্বল করে দেবেন না।
মাইলস্টোনে বিমান যখন আছড়ে পড়ছিল, তখন তুরস্কের পথে ছিলেন বিমানবাহিনী প্রধান হাসান মাহমুদ খান। ঘটনা শোনার পর তুরস্কের বিমানবন্দর থেকে দেশের পথ ধরার কথা বলেন তিনি। তিনি বলেন, এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় আপনাদের সবার মতো আমারও হৃদয় ভেঙে গেছে। আপনারা জানেন, মাত্রই আমি সফরে বেরিয়েছিলাম, জরুরি সফর ছিল, আমি ওই বিমানবন্দর থেকেই আজকে ফিরে আসছি সকালে। যখন সংবাদ পেয়েছি, বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। তিনি বলেন, যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে, সেটা রিকভার করাই হবে আমাদের মূল কাজ। যদিও জানি, এটা কোনোভাবেই আমরা সম্ভব করতে পারব না। তবে আমি যেটা বলেছি বারবার, আমরা তাদের পাশে থাকব। আমরা সম্মিলিতভাবে অনেকেরই কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব করতে সক্ষম হব ইনশাআল্লাহ।
তিনি বলেন, আহতদের সুচিকিৎসা, এটাই আমার মনে হয় এখন সবচেয়ে জরুরি, যারা আমাদের মাঝে এখনো অসুস্থ হয়ে আছেন বা আহত হয়ে আছেন, তাদেরকে আমরা সর্বাত্মক চিকিৎসা প্রদান করব এবং তারা যাতে সম্পূর্ণভাবে সুস্থ হয়, সেটাই আমাদের মূল লক্ষ্য।