রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেবী দুর্গাকে আনন্দময়ী বলে অভিহিত করেছেন। কারণ আনন্দের মাঝেই আসে জীবনের পরিপূর্ণতা। অসুর বিনাশিনীরূপে দশভূজা দেবী দুর্গার আগমন ঘটে প্রতি বছর, প্রতি শরতে। দুর্গাপূজা হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব।
পন্ডিত অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ তাঁর ‘দেবী দুর্গা’ প্রবন্ধে বলেছেন, প্রাচীনকালে ঋষিরা ধ্যানের সময় আগুন না জ্বালিয়ে সেখানে ‘দক্ষকন্যা’ বা কুন্ডের ওপর গীতবর্ণের মূর্তি স্থাপন করতেন। মূর্তিটি ছিল অগ্নির প্রতীক এবং তার নামকরণ করা হয়েছিল ‘হব্যবাহনী’। এই মূর্তিই পরে পরিণত হলো দুর্গায়। ‘কুন্ডের দশদিক দুর্গার দশহাত’ এবং বৈদিক যুগের শেষ দিকে দেখা যায় ‘দক্ষকন্যা’ ক্রমশ উমাতে পরিণত হলেন। রমা প্রসাদ চন্দ্র তাঁর এক নিবন্ধে বলেন, দুর্গাপূজার আমরা যত প্রাচীন উৎসবই খুঁজি না কেন, সবচেয়ে প্রাচীন যে মহিষমর্দিনীর মূর্তিটি পাওয়া গেছে, তা পঞ্চম শতাব্দীর। গবেষকদের আলোচনায় জানা যায়, সভ্যতার তিনটি পর্যায়ে মানুষ তিন রকমের পূজা করতেন। সাত্ত্বিকী পূজায় দেয়া হয় নৈবেদ্য, তবে তা আমিষ নয়, করা হয় জপ ও যজ্ঞ। রাজসী পূজায় দেয়া হতো বলি এবং নৈবেদ্য হতো আমিষের। তাপসী পূজায় জপ, যজ্ঞ, মন্ত্র কিছুই লাগত না।
তবে নৈবেদ্য দেয়া হতো মদ মাংস দিয়ে। দুর্গোৎসব সম্পর্কে একটি মূল্যবান গ্রন্থ আছে বিমল চন্দ্র দত্তের। ঐ গ্রন্থে দেখা যায়, প্রথম শতকে কুষান যুগে, চতুর্থ পঞ্চম শতকে গুপ্তযুগে, সপ্তম শতকে পল্লব যুগে এবং ১১–১২ শতকে সেন বংশের আমলে দেবীর মহিষমর্দিনীর রূপ ছিল। সেই সময়ের দুর্গা প্রতিমার কিছু চিত্র এখনও আঁকা আছে মধ্য এশিয়ার তাজিকিস্তানের পেনজিকেন্ট শহরে দুটো মন্দিরের দেয়ালে। কুষান যুগে দুর্গা ছিলেন লাল পাথরের তৈরি, হাত ছিল দু’টি। পায়ের নিচে সিংহ, বাম হাত ত্রিশূল, ডান হাতে অভয়মূদ্রা। পাল যুগে অর্থাৎ ১২৮৯ সালে দেবির তিনটি চোখ এবং চারটি হাত ছিল। দশভূজা অর্থাৎ দশ হাত দুর্গার আত্মপ্রকাশ ঘটে আঠারো শতকে।
বাংলাদেশে প্রথম দুর্গাপূজার প্রচলন হয় মোগল সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে। সম্রাটের বিদূষক কুল্লুক ভট্টের পিতা উদয় নারায়ণ কুলোপুরোহিত রমেশ শাস্ত্রীর কাছে যজ্ঞানুষ্ঠানের পরামর্শ নিয়ে পূজা করেন। পরে উদয় নারায়ণের পৌত্র অর্থাৎ কুল্লুক ভট্টের পুত্র কংস নারায়ণ তাহিরপুরের রাজা হন (এখন রাজশাহী জেলায়)। পন্ডিতরা এ বিষয়ে সবাই একমত যে, রাজা কংস নারায়ণই এ দেশে সর্বপ্রথম দুর্গাপূজা অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা। এই পূজার ব্যয় হয়েছিল সেই আমলের নয় লাখ টাকা।
বাংলাদেশের সব জেলায় ঐতিহ্যবাহী দুর্গোৎসবের বিস্তৃত বিবরণ তুলে ধরা বক্ষ্যমান নিবন্ধে সম্ভব নয়। তবুও কিঞ্চিত উল্লেখ করছি। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবের সময় বিক্রমপুর পরগনার ভাগ্যকুল জমিদার বাড়ির রাজা ব্রাদার্স এষ্টেটের এবং সাটুরিয়া থানার বালিহাটি জমিদার বাড়ির দুর্গাপূজা আয়োজনের ব্যাপকতায় কিংবদন্তি হয়ে আছে। ঢাকা শহরে সর্বপ্রথম দুর্গোৎসবের ব্যাপক প্রচলন ঘটে নবাব সলিমুল্লাহর আমলে। সে সময় সিদ্ধেশ্বরী জমিদার বাড়ি ও বিক্রমপুর হাউসে জাঁকজমক সহকারে পূজা হতো। ১৯২২–২৩ সালে আরমানিটোলার জমিদার ছিলেন বিক্রমপুরের রাজা ব্রাদার্সের বাবা শ্রীনাথ রায়। রায় বাড়ির পূজা দেখার জন্য প্রতিদিন প্রচুর বিদেশী নাগরিক মন্ডপে উপস্থিত থাকতেন। সমসাময়িক কালে আরও যেসব জমিদার পূজার আয়োজনের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন, তাঁরা হলেন ফরাশগঞ্জের রূপলাল দাশ, রঘুনন্দন দাশ, বাংলাবাজারের শিরিশ দাশ, আরএন দাশ, কেএম দাশ, অভয় দাশ, প্যারী দাশ ও প্রেমময় দাশ। পুরনো ঢাকার অনেক রাস্তাঘাট, অলিগলি এখনও সে যুগের অনেক জমিদারদের নামের সাক্ষ্য বহন করছে।
লালবাগ থানার ঢাকেশ্বরী মন্দিরের পূজাও অনেক পুরনো। অনুমান করা হয়, প্রায় ৯২ বছর যাবত এখানে নিয়মিত পূজা হয়ে আসছে। ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতিষ্ঠা ১৯১৬ সালে। সেই হিসাবে এবারে পূজার বয়স ১০৩–এ পড়ল। দুর্গাপূজার কথা বলতে গেলে শাঁখারী বাজার ও তাঁতীবাজারের নাম আসবেই। শাঁখারী বাজারে প্রথম দুর্গাপূজা শুরু হয় ইংরেজ আমলের একেবারে শেষের দিকে। এককভাবে পূজাটি করেন সুরেশ্বর ধর নামে এক ব্যবসায়ী। ১৯৫৫ সালে বারোয়ারী পূজা শুরু হয় ৪৭ নম্বর বলরাম ধরের বাড়িতে। এরপর ৭০ সালে গঠিত শাঁখারী বাজারের শারদীয় পূজা সংসদ–এর উদ্যোগে পূজা অনুষ্ঠান শুরু হয়। তাঁতী বাজারের মোক্তার ফণীভূষণ ধর নিজ বাড়িতে একক উদ্যোগে একটানা ২৫/২৬ বছর ধরে পূজা করতেন। তাঁর শেষ পূজা ছিল ‘৭২ সালে। এখানকার আরও উল্লেখযোগ্য পূজা ছিল বাগানবাড়ি ও কোতোয়ালি শিব মন্দিরে। ‘৭১–এ মন্দিরটি পাকবাহিনী ধ্বংস করে। এক সময়ে ঢাকা শহরে কেমন প্রতিমা উঠত ১৯৪০–এর একটি পরিসংখ্যানে তা জানা যাবে। সূত্রাপুরে ১১টি, রায়ের বাজারে ৮টি, রথখোলায় ৩টি, লক্ষ্মীবাজারে ৪টি এবং ওয়ারীতে ২টি। জমিদারী প্রথা বিলুপ্তির পর দুর্গাপূজার ঐতিহ্যগত ধারারও বিচ্যুতি ঘটে।
ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা ও গৌরীপুরের জমিদার বাড়ি, পাবনার জমিদার বাড়ি, টাঙ্গাইলের আরপি সাহার বাড়ি, নেত্রকোনার আশুজিয়া, নওপাড়া, বাড়বি প্রভৃতি তালুকদার অধ্যুষিত গ্রামে ব্যয়বহুল পূজার আয়োজন ছিল গর্ব করার মতো। ১৯৭১–এর পর শৃঙ্খলমুক্ত মাতৃভূমিতে ‘মাতৃবন্দনায়’ নতুনভাবে আন্দোলিত হয় সনাতন সমাজ। বারো মাসে তেরো পার্বণের বাংলাদেশে উৎসবের বান নামে। স্বাধীনতার পর প্রথম পূজা উদযাপনের উদ্যোগ নেয় শাঁখারী বাজারের প্রতিদ্বন্দ্বী নাট্যগোষ্ঠী। মহানগর সর্বজনীন পূজা কমিটি গঠিত হয় ১৯৭৭ সালে। সংঘমিত্র সংসদ ১৯৮২ সাল থেকে এবং নবকল্লোল গোষ্ঠী ‘৮৪ সাল থেকে শাঁখারী বাজারে পূজার আয়োজন করে আসছে। ২০০৮ সাল থেকে সবচেয়ে ব্যয়বহুল পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে বনানী–গুলশান পূজামন্ডপে। এ উপলক্ষ্যে এ বছর তারা যুগপূর্তির বিশেষ অনুষ্ঠান করেছে। সর্বজনীন পূজা কমিটির উদ্যোগে ১৯৯১ সাল থেকে অনুষ্ঠিত হচ্ছে মহালয়া। প্রতি বছরই প্রতিমার সংখ্যা বাড়ছে। এবার সারা দেশে প্রতিমার সংখ্যা ৩১,১০০। ঢাকা শহরে এবার পূজা মন্ডপের সংখ্যা ২৩৭। এবার দেবীর আগমন ও বিদায় একইভাবে, ঘোটকে। ধর্মপ্রাণ হিন্দুরা স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় দুর্গতিনাশিনী দুর্গাকে আবাহন করে প্রতি বছর।
লেখক: যাত্রাব্যক্তিত্ব; নাটকে বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক।