সেকালে গ্রামে অনেকগুলো দুর্গাপুজো হতো। আর আমরা তখন ছোট বয়সে আনন্দে আত্মহারা। জীবন তখন ছিল গ্রাম ভিত্তিক, গ্রামের গঠন তখনো আজকের মতো মলিন বা নিষপ্রভ হয়নি, অনেকগুলো বড় পুজো হতো -কখনো সর্বজনীন কখনোবা ব্যক্তিগত পারিবারিক পূজা। শিক্ষিত পরিশীলিত মানুষজন তখন নিয়মিত ফি হপ্তা’ গ্রামে যেতেন, তাদের পরিবার গ্রামেই বসবাস করতো। যাতায়াত বলতে তখন ছিল – ট্রেন আর নৌকা। গ্রামের হিন্দু পাড়াগুলোর দুর্দশা তখনো এত তীব্র হয়নি, বিরান হয়নি পাড়া, ঢিলে হয়নি এর বাঁধন, আজকের মতো এতো নড়বড়ে ও অনিশ্চিত অনুভূত হয়নি অবস্থান, অনেকটা স্থিতিশীল ছিল গ্রাম।
পাল সমপ্রদায়ের লোক এসে গ্রামে প্রতিমা বানিয়ে দিয়ে যেতো বড় পুজোগুলোর, আমাদের বাড়িতে দুর্গা বানাতেন ধলঘাটের আচার্য পাড়ার সরোজ আচার্য। এখন পরম্পরাগতভাবে তাঁর ছেলে বানান প্রতিমা। পুজোয় গ্রামগুলো ছিল জমজমাট আর প্রাণবন্ত। আরতি, প্রতিমা, পুজো, ধুপ, মাইক, আতশবাজি সব মিলিয়ে পুজোর ক’দিন মুখরিত থাকতো গ্রাম। আলোক সজ্জা তখন আজকের মতো চমক সৃষ্টি হয়তো করতে পারেনি, কারণ গ্রামে বিদ্যুৎ ছিলনা, তবে পেট্রোম্যাঙ বা হ্যাজ্যাক বাতির আলোয় তখন মন্ডপের চারিদিক ভরে যেতো-যেন আলোর বন্যায় উজ্জ্বল। উদ্দীপনায় সবকিছু সহজ-সুন্দর লাগতো, আনন্দ উদ্দীপক সবকিছু যেন হাতের নাগালে।
তখন চট্টগ্রাম শহরের নবগ্রহ বাড়ির ভেতরে বীণাপাণি মাইক সার্ভিস ছিল বেশ প্রসিদ্ধ। সেটা পাকিস্তান আমল হলেও তাদের ছিল কোলকাতার অনেকগুলো নতুন নতুন বাংলা গানের রেকর্ড, পুজোয় তারা সেগুলো সমেত ভাড়া করা মাইক নিয়ে হাজির গ্রামে -যা প্রাণ ভরে শুনতাম। বাজী পোড়ানোর ধুম লাগতো। ‘তারা’ বাজী আর ‘তুম্বরু’ বাজী আমার খুব প্রিয় ছিল- সহজ কথায় এগুলো পোড়ানো সহজ ছিল। অনেকে আবার ‘রসুন’ বাজী ফুটাতো-অনেক কসরৎ এর ব্যাপার ছিল সেটা, দেয়ালে তাক করে অনেক দুর থেকে ছুড়ে মারতে হতো সেটা-তবেই বিকট শব্দে ফুটতো, আমার অতো আসতোনা, আমি বরং কাঠি বাজী ফুটাতাম।
পুজোয় অনন্ত কাকা (‘খলিফা’) বাড়ি আসতেন, গজ ফিতে নিয়ে সার্ট পেন্টের মাপ নিতেন, বাজারে বার বার গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করা আর তাগাদা দেয়া হতো কখন হবে কখন পাবো সেলাই করা পেন্ট সার্ট, তাঁর সেলাই মেশিন বেশ শব্দে তরিৎ ছুটছে, আর এরই মাঝে তিনি মাথা না তুলেই বলছেন- ‘হবে হবে পেয়ে যাবে, বাবাকে দিয়ে দেবো’, ইত্যাদি। আর হাঁ, পূজোর চার দিন স্কুলের পড়া নেই, হোম ওয়ার্ক নেই-ছুটি, তবে দশমী বই বসতে হতো আবার।
ষাটের দশকে টিভি ছিলনা গ্রামে, রেডিও ছিল, তাতে কোলকাতা রেডিও স্টেশন থেকে প্রচারিত ‘মহালয়া’ শোনা যেতো, এবং পূজোতে গান ও নাটক। আমি গ্রামে প্রতিমা দেখতে যেতাম কয়েকজন মিলে-বিকেলে, রাতে বাড়ীর দুর্গাপুজোয় বেশ আমোদ করেই কাটতো।
দশমীর দিন একটা বিশেষ দিন-অঞ্জলী প্রদান, ঘট ঢুকানো আর প্রতিমা নিরঞ্জন- দিনের বেলায় এ তিনের সমাহার। হিন্দু বাড়িতে পহেলা বৈশাখ আর বিজয়া দশমীতে ভালো খাওয়ার আয়োজন নৈমিত্তিক। আমাদের ছোট বেলায়ও তার অন্যথার্ ছিলনা। শহরের আন্দরকিল্লায় প্রবর্তক সংঘের ঘি, পেস্তা বাদাম কিসমিস সমেত গোবিন্দভোগ চাল দিয়ে মা’র হাতের চমৎকার পোলাও, অজ মাংস, দশমী দিন সকালে বাড়ির এজমালী দীঘি থেকে ‘বড় জাল’ দিয়ে তোলা তাজা মাছের কালিয়া,সালাত, ভাজি, অম্বল, পায়েস সমেত মধ্যাহ্ন ভোজ এখনো মনে পড়ে। ধলঘাটের সিদ্ধেশ্বর পালিত এর মিষ্টির দোকান বেশ প্রসিদ্ধ ছিল। মিষ্টি কিনতে যেতুম সেখানে সকালেই, নইলে পাওয়া দায় হতো।
পুজোর ঠিক পরপরই কোন কোন স্থানে যাত্রাপালা, নাটক হতো, যেমন তখন ডেঙ্গাপাড়া বাবু অশ্বিনী বুক বাইন্ডারের বাড়িতে তাঁর ছেলে বাবু কৃষ্ণ দাশে(সদ্যপ্রয়াত)এর তত্ত্বাবধানে এরকম প্রচুর যাত্রগান হতো, ধলঘাটের বাগদন্ডীতেও অনেক নাটক হতো। এর কোন কোনটিতে যাওয়ার অনুমতি মিলতো। বছরের অন্য কোন সময়ে চিঠি না লিখলেও বিজয়া দশমী আর পহেলা বৈশাখে দূরের আত্মীয়-স্বজনকে অন্তত একটি পোস্টকার্ড লেখা ছিল হিন্দুবাড়ির রেওয়াজ,তখন তো আর আজকের মতো ই-মেইল,ফেস-বুক আর মোবাইল মেসেজ ছিলনা, গ্রামে টেলিফোন অচিন্তনীয় ছিল, কাজেই পোষ্টঅফিস ছিল নির্ভরযোগ্য যোগাযোগ মাধ্যম। বাড়িতে ফি বছর পুজো হয়েছে। পরে পরে শৈশব পেরিয়ে, কৈশোরে পূজোয় তন্ত্রধারীও করতে হয়েছে। যৌবনে জীবন কেটেছে পথে, ফুরসৎ আগের মতো আর মেলেনি পুজোয় বাড়িতে গিয়ে চারদিন কাটাবার, তবে বাড়ির পুজো এখনো চলছে শত বছরের নিরবচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতায়- গ্রাম বাংলা’র অন্যত্র অনেক স্থানে এখনো যেমন।
এবার চট্টগ্রাম শহরে পুজো দেখতে বেরুবো যথারীতি মাস্ক সমেত, অনেকগুলো পুজো মহানগরীতে। এখন টেলিভিশন প্রোগ্রামগুলোতে যে পুজো পরিক্রমা দেখানো হয় তাতে বিভিন্ন স্বাদ মেলে আরতি, প্রতিমা, আলোকসজ্জা ,এবং পূজার ভাবগাম্ভীর্যের। পশ্চিম বাংলার অনেকগুলো বাংলা চ্যানেলে এবং দেশের অনেকগুলো চ্যানেলে অনেকগুলো নাটক, নৃত্যগীত থাকবে- যা সময় নিয়ে দেখা যাবে।
বাড়িতে একদিন যেতে হবে – মাকে প্রণাম করতে , আর দশমী’র পরের দিন শুক্রবার বাড়ির সকলে মিলে একসাথে বসবে- বাড়িতে এখনো ১২০-৩০ জন লোকের বাস, এটাতে তাই ‘পাড়া’ বলাই ভালো। তারা সেখানে সকলে মিলে একসঙ্গে খাওয়ার আয়োজন করেছে- যেতে বলেছে বিশেষ করে। যাবার ইচ্ছে আছে। আর, পুজোর চার দিন গতানুগতিক একঘেয়েমী ছেড়ে একটু বৈচিত্র থাকুক জীবনে, এটাও চাইতে পারি।
লেখক : শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ, কবি ও কলামিস্ট, মানবাধিকার আন্দোলনের সংগঠক।










