দুরের দুরবিনে

অজয় দাশগুপ্ত | শুক্রবার , ৭ অক্টোবর, ২০২২ at ৮:১২ পূর্বাহ্ণ

সিডনিতে জমজমাট শারদ উৎসব চলছে। ছাব্বিশ বছর আগে যখন আমি আসি তখন সাকুল্যে তিন চারটে দুর্গাপূজা হতো এই শহরে। এখন পরিবেশ সম্পূর্ণ ভিন্ন। এ লেখা যখন লিখছি তখন আমি সবে ফিরলাম একটি পূজা দেখে। ধার্মিক বা নিষ্ঠাবান কি না জানি না তবে কিছু আচার আর নৈতিকতা মেনে চলি। যে ধর্মে জন্ম নিয়েছি বড় হয়েছি তার প্রতি শ্রদ্ধা থাকাটাই স্বাভাবিক। আমার সবসময় মনে হয় নৈতিকতাই বড় ধর্ম। সে দৃষ্টিকোণে দুর্গাপূজার বড় নৈতিক দিকটি হচ্ছে নারী শক্তির প্রতি শ্রদ্ধা। এই পূজায় পূজিত মা দুর্গা হচ্ছেন অসুর নামের অশুভ শক্তি দমনের দেবী। অসুরকে কোন দেবতা মোকাবেলা না করে দেবী কেন করলেন? এই প্রশ্নের উত্তরেই বোঝা সম্ভব নারী শক্তির প্রতি হিন্দু ধর্মের বিশ্বাস বা আস্থা কতটা।
যে কথা বলছিলাম সিডনিতে এখন নয় নয় করে দুই ডজনের কাছাকাছি পূজা হচ্ছে। আমি যে পূজা থেকে এসে এ লেখাটি লিখছি সেখানে মানুষের ভিড়ে পা রাখা মুশকিল। ভরদুপুরে দূরদূরান্ত থেকে ড্রাইভ করে আসা মানুষের ভিড়ে সয়লাব পূজা মণ্ডপ। হিমশিম খাচ্ছিলেন স্বেচ্ছা সেবক আর আয়োজকেরা। তাঁরা হাসিমুখে ভিড় সামলালেও এটা স্পষ্ট এই ভাবে চললে আগামীতে অনেক নিয়মের পরিবর্তন করতে হবে। যেমন আমেরিকা ইংল্যান্ডে টোকেন ছাড়া দুপুরের বা রাতের খাবার মিলবে না। এটা করতে তাঁরা বাধ্য হয়েছেন। ভিড় সামলানো আর মানুষের ঢল সামলাতে এর বিকল্প ছিল না। সিডনিতে এখনো সেভাবে টোকেন প্রথা চালু হয় নি। বাংলাদেশের বাঙালির মূল শক্তিই হচ্ছে আতিথেয়তা। আমরা এমন এক জাতি যারা নিজে না খেয়ে অন্যকে খাওয়াতে ভালোবাসি। ঘরে চাল আছে না ডাল আছে সেটা বিবেচনায় না রেখেই আমরা অতিথি আপ্যায়ন করি। যা আমাদের পাশের বঙ্গে অচল। তাদের সমালোচনা বা আলোচনা এ লেখার উদ্দেশ্য না কথা ্‌চে্ছ নাগরিক জীবনে কলকাতার মানুষ এতোটাই অভস্ত আর আত্মকেন্দ্রিক যে তারা এসব আপ্যায়নে আমাদের মতো উদার হতে পারে না। এমন কি তারা গায়ে খেটে কোন উৎসব আয়োজনেও নারাজ। সিডনিতে বাংলাদেশের বাঙালিদের কুড়িটা পূজার পাশাপাশি তারা করে দুএকটা। এমন কি বাংলা নববর্ষ ভাষা দিবস বা সাংস্কৃতিক উৎসব কিছুতেই নাই তারা। যা কিছু বাঙালির তার দায় দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছি আমরা।
সিডনির এবারের পূজা উৎসবের সূচনাতেই মন ভাঙ্গা একটি সংবাদ পেলাম। জনকন্ঠের কিংবদন্তী সম্পাদক দেশবরেণ্য সাংবাদিক ব্যক্তিত্ব তোয়াব খানের মৃত্যুতে প্রবাসের সুধি মহলেও বিষাদের ছায়া নেমে এসেছে। সিডনির মেলব্যাগ নামের এই কলামটি আমি লিখতে শুরু করি ২০০২ সাল থেকে। যার মানে কুড়ি বছর ধরে এই কলামটি ছাপা হয়ে আসছে। শুরুতে যখন এর নাম নির্ধারণ করার সময় হয়েছিল তখন জনকণ্ঠের বিভাগীয় সম্পাদক ছিলেন প্রয়াত শিশু সাহিত্যিক শ্রদ্ধাভাজন এখলাস উদ্দীন আহমেদ। এখলাস ভাই আমাকে সবসময় তাঁর স্নেহের ছায়ায় রেখে বড় করেছেন। ছড়া লেখার কাল থেকে কলাম লেখক হবার পেছনে জনকন্ঠ আর এখলাস ভাইয়ের ভূমিকা বিশাল। তাঁর নির্দেশ মত আমি তোয়াব খানকে একটা চিঠি বা অনুরোধ পত্র লিখে পাঠাই। তখন না ছিল মোবাইলের রমরমা না এতো ডিজিটাল মাধ্যম। এদেশে আসার পর সবাই যখন বিশাল বিশাল টিভি সেট আর বাহারী সব আসবাবপত্র কিনে জীবন গুছাতে ব্যস্ত তখন আমি কিনেছিলাম একটি ফ্যাক্স মেশিন। সে ফ্যাক্স মেশিনের কাজ ছিল জনকন্ঠ সংবাদ সহ নানা মিডিয়ায় লেখা পাঠানো। সেই চিঠিখানি পড়ে তোয়াব ভাই অনুমতি দিতে দেরী করেন নি। এখলাস ভাই সে রাতেই ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিলেন তখনকার জনপ্রিয়তম ভিন্ন ধারার দৈনিক জনকন্ঠ প্রতি সোমবার এই কলাম ছাপতে চলেছে ।
কি লিখব বা কিভাবে লিখব সেটা মাথায় পোক্ত হবার ভেতরেই গড়ে উঠেছে আস্থা আর বিশ্বাসের ভিত্তি। কত মানুষ কত বিভাগীয় সম্পাদক এলেন গেলেন কিন্তু তোয়াব খান তো হিমালয় সমান এক মানুষ। তিনি যা বলতেন বা করতেন তা তাঁর মতোই অটল অনঢ়। সিডনির মেলব্যাগ তখন এখানকার জীবনযাত্রা আর নবাগত বাঙালিদের সমস্যা সম্ভাবনা নিয়ে আবর্তিত হবার কারনে তারুণ্যের ভেতর এর ব্যাপক চাহিদা তৈরী হয়। পরবর্তীতে এদেশে পড়তে আসা বা অভিবাসন নিয়ে আসা অনেক তরুণ তরুণীর মুখে শুনেছি তাদের এদেশে আসার ব্যাপারে সিডনির মেলব্যাগ কি প্রভাব ফেলেছিল।
তোয়াব খান আমাদের দেশের সংবাদপত্র জগতের একজন দিকপাল। নানা ক্রাইসিস মোমেন্টে তাঁর ব্যক্তিত্ব ও মেধা সংবাদপত্রকে সাহস ও ভরসা যুগিয়েছে। মনে পড়ে বিএনপি আমলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলার দিন তাঁর সাধে কথা হয়েছিল। ব্যথিত ও জ্বলে ওঠা তোয়াব খান কতটা আঘাত পেয়েছিলেন তা পরদিন তখনকার জনকণ্ঠ দেখলেই বোঝা সম্ভব। ওয়ান ইলেভেনের সময় জনকন্ঠকে টার্গেট করে তার বিভিন্ন ফ্লোরে তালা ঝুলানোর সময় ও বাহিনীর মানুষজন তোয়াব খানের সাথে আচরণে ছিল সংযত। কারণ তারা জানতো তিনি কে এবং কি তাঁর ব্যক্তিত্ব। আওয়ামী লীগের জন্য কঠিন সে সময়েও আমার নেয়া শেখ রেহানার সাক্ষাৎকারটি প্রথম পাতায় ছাপিয়ে দেশের মানুষকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন মিডিয়া কি করতে পারে।
তোয়াব খানের চলে যাওয়া দেশের জন্য মিডিয়ার জন্য কতটা অপূরণীয় তার হিসেব করবে সময়। কিন্তু এটা নিশ্চিত তাঁর প্রয়াণ বাংলাদেশীদের ভেতর বিষাদের ছায়া নামিয়েছে। বহু মানুষ দেশে বিদেশে নীরবে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানানোর পাশাপাশি মনে মনে স্মরণ করছে এই কৃতী মানুষটিকে। জনকন্ঠের অতীত ও সাফল্যের সাথে ছায়ার মতো জড়িয়ে থাকা তাঁকে জানাই সশ্রদ্ধ অভিবাদন।
বলছিলাম পূজা বা শারদ উৎসবের কথা। এই উৎসব দেশের মতো বিদেশে ও বাঙালির অন্যতম প্রাণের উৎসব। তাই দেশ ভালো ধাকলে উৎসব নিরাপদ থাকলে বিশ্ববাঙালিও নির্বিঘ্নে পালন করতে পারে উৎসব। গতবছরের ঘটনার পর নানা ধরণের শঙ্কা আর ভয় কাজ করছিল মনে মনে। কিন্তু আনন্দ আর উৎসব কি তা মানে? তার কাজ হচ্ছে নদীর মতো বয়ে যাওয়া। বাঙালির দুর্গাপূজা এখন আর হিন্দুদের পূজায় সীমাবদ্ধ নাই। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণে তা হলেও মূলত এর সাথে জড়িয়ে গেছে শিল্প সংস্কৃতি ও জীবনবোধ। সে বোধের অন্যতম প্রতীক দুর্গা। যিনি একদিকে দেবী অন্যদিকে নারী শক্তি বা উইমেন এমপাওয়ারমেন্টের মূর্ত প্রতিমা। শুভ শারদীয়া। সিডনি থেকে বিজয়ার শুভেচ্ছা।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধআল্লাহ ভীতি ও রাসূলের (সা.) প্রেম অন্তরে ধারণ করতে হবে