দূরের দুরবিনে

অজয দাশগুপ্ত | শুক্রবার , ২৯ জুলাই, ২০২২ at ৫:০২ পূর্বাহ্ণ

সমাজ ও রাষ্ট্র একসাথে না চললে এগুনো যাবে না

সমাজ ও রাষ্ট্র যদি একসাথে চলতে না পারে সে দেশ এগুবে কিভাবে ? আজকের বাংলাদেশ এক অসীম বিস্ময়ের নাম। একসময় তলা বিহীন ঝুড়ি বা বটমলেস বাস্কেট নামে পরিচিত দেশটি এখন অর্থনৈতিক ভাবে এগুচ্ছে । তার দৃশ্যমান উন্নয়ন আর মানুষের হাতে টাকার পরিমান দেখে বোঝার উপায় নাই এর অভ্যন্তরে কোন অভাব বা দারিদ্র্য আছে। আমাদের জাতিসত্তাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবার ব্যাপারে বলিষ্ঠ একজন নেতার দরকার ছিল । বঙ্গবন্ধু তাজ উদ্দীন আহমদ সৈয়দ নজরুলদের মৃত্যুর পর কাজটা কঠিন হয়ে গেছি। ফিনিঙ পাখির মতো নেতৃত্বের ধ্বংসস্তুপ আর সামরিক বাহিনীর শাসন থেকে উদ্ধার করেছে জনগণ। আর সেই জনম্যান্ডেটে গদীতে এলেন শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধু কন্যার নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে চলেছে। কিন্তু সমাজ?
কিছুদিন পরপর দেশের নানা জায়গায় শিক্ষা ও শিক্ষক নির্যাতনের আড়ালে যে সংখ্যালঘু নির্যাতন তা এখন যেন নিয়মে পরিণত হতে চলেছে। অনেকে মনে করেন এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। আমার তা মনে হয় নি। বরং আমার মনে হচ্ছে এসব কাজের ভেতর দিয়ে গ্রাউন্ড তৈরী করা হচ্ছে। আমরা মানি আর না মানি এই আওয়ামী লীগ আর আগের আওয়ামী লীগ এক না। এখন যে দল দেখি তারা আসলে প্রশাসন নির্ভর । তাদের খুঁটি বাহিনী। আগে মানুষ ই ছিল আওয়ামী লীগের মূল শক্তি। এখন তারা আছে কি নাই সেটা বিষয় যতোটা তারচেয়ে বড় বিষয় প্রশাসনের সাহায্য। তাদের দ্বারা আপাতত: দমন করা গেলেও ক্রমেই ভারত বিদ্বেষ আর সংখ্যালঘু বিদ্বেষ এক হয়ে পড়ছে। আর সেখানেই আছে সর্বনাশের শেষ সংকেত।
সমাজে ভারত বিদ্বেষ এখন তুঙ্গে। এর কারণ বা এফেক্ট সবাই বোঝেন। একতরফা বাংলাদেশকে দায়ী করা ও অনুচিত। দুটি দেশের সম্পর্ক যখন যে পর্যাবে যেমন থাকুক না কেন ভারত বা পাকিস্তানের সাথে আমাদের অতীত জড়িয়ে। ইতিহাস ও পূর্বাধিকারের কারণে ভারতের সাথে সম্পর্কের কথা মনে রাখতেই হবে। যে কথা বলছিলাম সারা বিশ্বে যে কয়েকটি জাতি মেধা দিয়ে তাদের অবস্থান নিশ্চিত করেছে তাদের মধ্যে ইহুদিরা অগ্রগণ্য। কাল মার্কস থেকে আইনষ্টান বা আজকের জুকার বার্গ সবার ঐ একটাই পরিচয়। জেনে অবাক হয়েছিলাম সবচেয়ে অধিক নোবেল জয়ী এই জাতির মানুষেরা তাঁদের অর্জ ন দু ভাবে উৎসর্গ করেন। প্রথম তাঁদের জাতিসত্তার কাছে তারপর তিনি যে দেশের নাগরিক তার উদ্দেশ্যে । ফিলিস্তান দখল ও তাদের ওপর অমানবিক যুদ্ধংদেহি আচরণ আর অমানবিক নির্যাতনের কারণে আমরা ঐ রাষ্ট্রের ভূমিকা সমর্থন করি না। বরং তাদের বিরুদ্ধে থাকি। তাই বলে অকারণ জাতি বিদ্বেষ বা তাদের ভালো দিক গ্রহণ না করার কোন কারণ থাকতে পারে না ।
এমন আরেকটি জাতি ছিল শ্রীলঙ্কার তামিল জনগোষ্ঠী। এরা ও সারা বিশ্বে মেধা দিয়ে তাদের জায়গা করে নিয়েছিল। আমেরিকা ইংল্যান্ড অষ্ট্রেলিয়ায় এদের আধিপত্য আর মেধার ঝলকানি চোখে পড়ার মতো ছিল একসময়। কিন্তু গৃহযুদ্ধে ইচ্ছেয় বা অনিচ্ছায় এদের ভূমিকা হয়ে উঠেছিল আত্মঘাতী। ভালো মন্দ এমন কোন জাজমেন্টে না গিয়েই বলবো এরা অকাতরে টাকা পাঠিয়ে নিহত প্রভাকরণ আর তামিল টাইগারদের শক্তি যোগাতেন। সে যুদ্ধের ফলাফল কি হতে পারে সে ধারণা থাকার পরও উগ্র জাতীয়তাবাদ ও স্বজাতির কষ্ট দু;খ নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে তারা যে ভূমিকা নিয়েছিলেন তা ইতিহাসে গৌরবের কিছু বলে বিবেচিত হবে না। ফলাফলে তামিলদের স্বাধীনতার স্বপ্ন তো চুরমার হয়েছে ই সারা দুনিয়ায় ইমেজ সংকটা আর পরাজয়ের গ্লানি তাদের ব্যাকফুটে ঠেলে দিয়েছে ।
বাকী ভারতীয়রা। আপনি তাদের পছন্দ করেন আর না করেন মেধা দিয়ে তারাও জায়গা করে নিচ্ছে দুনিয়ায়। একসময় সাপ ব্যাঙ ফকির সাধু আর কালা জ্বর ম্যালেরিয়ার দেশ নামে পরিচিত ইন্ডিয়া এখন অর্থনৈতিক শক্তি। দুনিবার সব বড় বড় ফোরামে তাদের অবস্থান শক্ত পোক্ত। আমেরিকার মুরুব্বীয়ানা কমুক আর বাড়ুক তারাই এখনো নাম্বার ওয়ান দেশ নামে পরিচিত।
এই কথাগুলো বললাম এই কারণে আমাদের দেশে মেধা বা রুচির পরিবর্তে সবসময় জাতিগত ধর্মগত পরিচয়কে প্রাধান্য দেয়া হয়। আর সে কারণেই সংখ্যালঘু নামের মানুষগুলো হয়ে ওঠে গিনিপিগ। তাদের জীবন পড়ে সংকটে। একইভাবে আজ কিন্তু প্রগতিশীল বাঙালি মুসলমান সমাজ ও আছেন ঘোর বিপদে। ড: রতন সিদ্দিকীর ঘটনাটি নিশ্চয় ই ভুলে যাই নি আমরা। একজন প্রগতিবাদী মানুষ তিনি। তাঁর কথাবার্তা আচার আচরণ কোথাও উগ্রতা নাই। এই পরিমিত সুভাষী মানুষটিকেও ছাড় দেয় নি হমালাবাজেরা। ভাগ্যক্রমে তিনি ও তাঁর পত্নী জানে বেঁচে গেলেও আমরা দেখেছি কি নির্মম মারাত্মক আক্রমণ করার চেষ্টা হয়েছিল। বলতে গেলে এটাই সমাজ। এটাই এখন বাস্তবতা। ন আক্রমণকারীরা বারবার জানতে চাচ্ছিল রতন সিদ্দিকী মালাউন কি না? এই প্রশ্নের সাথে আপনি সংখ্যালঘু আর ভারত বিদ্বেষের যোগসূত্র না পেলে আপনি অন্ধ বা জেনেশুনে বোবার ভূমিকায় অভিনয় করছেন। সমাজকে বহুমুখী আর উদার করতে না পারলে যে অন্ধত্ব ধেয়ে আসছে তা কাউকে ছাড় দেবে না ।
বলছিলাম সমাজ আর রাষ্ট্রের কথা। বলতে বাধ্য হচছি এক সময় আর্ধিক উন্নতি কম হলেও সমাজের উন্নতি ছিল চোখে পড়ার মতো। তখন নাটক গান বাজনা সংস্কৃতি লেখালেখি সমাজকে শাসন করতো। মানুষ ঘরে বাইরে বাঙালি হবার সাধনায় ছিল নিমজ্জিত। আজকে এর রেশ বা একটা চোরা স্রোত আছে বটে ধারা প্রায় বিলুপ্তির পথে। পদ পদক সম্মানের ঠেলায় সংস্কৃতি কোণঠাসা। সবচাইতে বড় লোকসান করছে স্তাবকতা। বাংলাদেশকে এর বাইরে আসতেই হবে। সমাজকে ঢালাও ভাবে দোষারোপ করার আগে বুদ্ধিজীবী বা অগ্রসর মানুষেরা যদি নিজেদের কাজের দিকে ফিরে তাকান তাহলে জবাব পেয়ে যাবেন। আজ সমাজ আর রাষ্ট্র একপথে চলছে না। মুখে সেক্যুলারিজম বা উদারতরা কথা বললেও অন্তরে তা লাললন করার মানুষ হাতে গোণা। সমাজ যদি রাষ্ট্রের পাশে দাঁড়াতে না পারে সে দেশ টাকা পয়সায় আমিরা হতে পারবে কিন্তু সভ্য ইউরোপের কোন দেশ হতে পারবে না। পারবে না মেধা দিয়ে দুনিয়াতে পরিচিত হতে । খুব বেশী দূরে যাবার দরকার নাই। আফগানিস্তান বা অধুনা পাকিস্তানের দিকে তাকালেই বোঝা সম্ভব। পাকিস্তানের বুদ্ধিবৃত্তি আজ শেষ হবার পথে। শেষ হয়ে আসছে তাদের মূলধারা। সারা বিশ্বে একটি ভয়জাগানো অকার্যকর রাষ্ট নামে পরিচিত এই দেশটি এমন ছিলো না। আমরা আমাদের নেতা বঙ্গবন্ধুরে কল্যাণে ত্যাগে তাদের ছেড়ে আসতে পেরেছি। কিন্তু তাদের ছায়া আমাদের ছাড়ছে না। এই ছায়া থেকে বের হতেই হবে।
রাষ্ট্র ও সমাজ একসাথে অসামপ্রদায়িক আর উদার না হলে কোন সমপ্রদায় যেমন শান্তিতে থাকতে পারবে না তেমনি দেশও এগুতে এগুতে আসলে এগুতে পারবে না। সময় এখনো ফুরিয়ে যায় নি। সংস্কৃতি ও বিদ্যাপ্রবণ মানুষের কি তাঁদের কাজটুকু করবেন না? দেশে বিদেশের বাংলাদেশীদের দায় দায়িত্ব ও কম না। তারা সবাই নিজেদের জায়গা থেকে না দাঁড়ালে হবে না। সবচেয়ে বড় কথা সরকার। তারা চাইলেই অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায় । কিন্তু তার জন্য চাই সদিচ্ছা আর মনোবল। সেটা আছে কি নাই তাই এখন প্রমাণ করার সময়।
লেখক : সিডনি প্রবাসী কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম্’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধসিএসইতে লেনদেন ১১.১১ কোটি টাকা