অপরাজেয় বাংলাদেশ অপরাজিত জয় বাংলা
বাংলাদেশের অর্জন ব্যাপক । নানা কারণে সরকারের প্রচার ব্যর্থতায় তা স্পষ্ট বোঝা যায় না। সাথে আছে অপপ্রচার। যেমন এই লেখাটা ছাপা হবার পর আমার কপালেও নিন্দার তিলক পরিয়ে দেবার আনন্দে ভাসবেন অনেকে। বলবেন সরকার বা আওয়ামী দালাল। এর কোন জবাব দেবার দরকার বোধ করি না। কারণ বর্তমান সময়ের বাস্তবতা আর দেশ বিরোধী সবকিছুর পেছনে আছে সরকার তথা রাজনীতির ব্যর্থতা। এককেন্দ্রিক সবকিছুতে হতাশ মানুষজন । তাদের সামনে উন্নয়ন ও অগ্রগতির সবকিছু দৃশ্যমান হবার পরও তারা তা মানতে পারছে না। বা মানলেও স্বীকার করছে না। কারণ অপপ্রচার অনেক শক্তিশালী। আর সে জায়গায় এখন যুক্ত হয়েছে ধর্মের ব্যবহার। সংবেদনশীল স্পর্শকাতর করে মানুষের মনে ভয় ঢুকিয়ে মুখে তুলি কানে তালা লাগানোর কাজ প্রায় শেষ।
এই বাংলাদেশ আমাদের অগ্রগতিকে দেখতে দেয় না। আপনি হয়তো জানেন পাকিস্তান এখন কতোটা পেছনে। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এখন ২০৬৪ ডলার। আর পাকিস্তানের ১১৩০। আমাদের রিজার্ভ ৪২ বিলিয়ন পাকিদের ২০.৮ বিলিয়ন। আমাদের দেশে প্রাথমিক শিক্ষার হার ৯৮% পাকিস্তানের ৭২%। আমাদের শিশু মৃত্যুর চাইতে তাদের শিশু মৃত্যুর হার দু:খজনক ভাবে দ্বিগুণ। সবচাইতে জরুরি বিষয়াদি জানুন। আমাদের গড় আয়ু ৭২ বছর পাকিস্তানের ৬৭ বছর। প্রায়ই দেখবেন আমরা বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতকে ছাড়িয়ে সামনে চলেছি। এতোকিছুর পরও আমাদের তৃপ্তি নাই। আসলে কি চাই আমরা? কি আমাদের খায়েশ?
স্বাধীনতা কিংবা বিজয়ের ৫০ বছরে বাংলাদেশ কি প্রমাণ করেছে? আমরা যারা এখন ষাট পেরুনো বাঙালি আমরা তো চোখে দেখেছি কানে শুনেছি আমেরিকা চীন পাকিস্তান কি বলতো কি ভাবতো আমাদের নিয়ে। তখনকার দুনিয়ার মোড়ল এক নাম্বার দেশ নামে পরিচিত আমেরিকার ধুরন্ধর কিসিঙ্গার বলতেন, বাংলাদেশ একটি তলাবিহীন ঝুড়ি। তার মতে এর ভেতর যাই দেন যাই ঢালেন তলা দিয়ে বেরিয়ে যাবে। যার আসল অর্থ এই সদ্য স্বাধীন দেশটির কোন ভবিষ্যত নাই:। আমেরিকার এই বাজে কথাকে মনে প্রাণে সমর্থন করতো চীন। আর পাকিস্তান তো ধরেই নিয়েছিল সেদিন খুব বেশি দূরে না যেদিন বাংলাদেশ মাথা নুইয়ে তাদের কাছে মাফ চাইবে। হয়তো হাতে পায়ে ধরবে তাদের আবার এক হবার জন্য। পাকিস্তানের সেই রাগ সে জোশ ভুট্টো সাহেবের আমলে ছিল তুঙ্গে। পরে আস্তে আস্তে তা মিইয়ে গিয়ে এখন তারা প্রলাপ বকা ছাড়া আর কিছুই করতে পারছে না।
কিন্তু আমাদের জাতির একাংশ আজ আবার পাকি ধ্যান ধারণায় মশগুল। জানি না কি করে কোন শক্তিতে ভর করে এমন দু:সাহসী হয়ে উঠছে তারা। আমরা বিএনপি জোট সরকারের আমল দেখেছি। এরশাদের অনাচার দেখেছি। তখনো এরা এতোটা বেপরোয়া হতে পারে নি। তাদের সাথে সমানে সমানে টেক্কা দিতো বুদ্ধিবৃত্তি। বরং বলা উচিত আমারা যাদের দলে সে প্রগতিশীলতাই তখন এগিয়ে। আর আজ তারা মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। ৫০ বছর পর কেন এই দুর্দশা? এর কারণ খুঁজে পেতে হলে ইতিহাস বিকৃতি যেমন তেমনি নিজেদের কৃতকর্মের কথা বিবেচনা করাও জরুরি। এতোবেশী লুটপাট আর কোন আমলে হয়েছে? এতো দুর্নীতিও দেখা যায় নি। এসব কারণে মানুষ আজ ভালো বিষয়গুলোও বিবেচনায় রাখে না।
আওয়ামী লীগ সরকারে থাকুক এটা আমরা যৌবন থেকে চাচ্ছিলাম। ইতিহাস বিকৃতি বন্ধ করে দেশকে অসামপ্রদায়িক করার জন্য আওয়ামী লীগের দরকার ছিলো। কিন্তু তারা সে কাজ নিষ্ঠার সাথে করে নি। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে বাদ দিলে কারো ভূমিকাই না স্পষ্ট না জোরালো। দেশের রাজনীতিতে একটি শক্তিশালী বিরোধীদল সবসময় দরকার। আজকে সেটা উধাও। আমি একবার ও আগুন সন্ত্রাসী বা বোমা হামলাকারীদের কথা বলি না। সবকিছু মিলিয়ে একটা রাজনৈতিক শক্তি না থাকলে যে শূন্যতা তা পূরণ করার জন্য আমরা আসলে কাউকে পাচ্ছি না। আবার এ অভিযোগও অসত্য নয় যে কাউকে মাঠে থাকতে দেয়া হচ্ছে না। এর ফলে কি হচ্ছে? বাংলাদেশের অর্জন ও অগ্রগতির দুশমন হয়ে দাঁড়াচ্ছে ধর্মান্ধ শক্তি। তাদের ক্যাসেটবন্দী বয়ান এখন ইউ টিউব আর সামাজিক মিডিয়ায় আনন্দ জোশ আর উল্লাসের উপাদান। বাংলাদেশ এমন বাস্তবতা কোনকালে আশা করে নি। ধর্ম মানুষের মৌলিক বিষয় । আমাদের দেশের মানুষজন চিরকালের ধার্মিক। তাদের হঠাৎ করে এতো বয়ানের কি দরকার পড়লো জানি না।
আজ এই ডিসেম্বরে আমাদের সাথে একদিকে যেমন আশাবাদ আরেকদিকে আছে চরম হতাশার কালো মেঘ। আর্থিক উন্নয়ন সবকিছু হতে পারে না। সবাই মানি এবং জানি দুনিয়ার বহুদেশ ইউরোপের তুলনায় আর্থিক ভাবে ধনী। কেউ কেউ চরম ধনীও বটে। কিন্তু সভ্যতা সংস্কৃতি আর জীবন মানে ইউরোপ এখনো সেরা। তার সাথে বিজ্ঞানের সম্পর্ক মধুর। আর আমরা? বিজ্ঞান এখন ভয়ের বিষয়। চরম আস্তিকতার নামে বিজ্ঞানকে সামনে আসতে না দেয়ার চক্রান্ত জেনেও সরকার নীরব। আমি বলবো উন্নয়ন বিজ্ঞান আর সংস্কৃতি যদি একসাথে চলতে না পারে সে সমাজ মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য।
আর একটা কথা বলা জরুরি। অর্ধশত বছরের দ্বারপ্রান্তে এসেও অখন্ড উপমহাদেশের সেই ভারত আর স্বাধীনতা যুদ্ধের দুশমন পাকিস্তান গেলো না। না গেলো মাথা থেকে না চিন্তা থেকে। এ দুই দেশের কে যে দালাল আর কে দালাল না এ সম্পর্ক ঠিক করতে করতে ই দেশ পৌঁছে গেলো ৫০ এর পাদদেশে। অথচ বাংলাদেশের দালাল তৈরি হলো না।
কী নাই আমাদের? দেশ বিদেশে নামকরা খেলোয়াড় মেধাবী কবি লেখক পোশাক বাজার কৃষি গান কি নাই? তারপর ও আমরা কেন ভারত পাকিস্তান নিয়ে লড়াই করবো? আমি বাংলাদেশ ক্রিকেটের খেলাগুলো দেখতে অস্ট্রেলিয়ার নানা শহরে গেছি। ভারত বা পাকিস্তানের সাপোর্টারদের সামনে কেমন যেন ম্রিয়মান আমরা? এই মানসিক ভয় বা দুর্বলতা তো তারুণ্যে থাকার কথা না। তারা তো তাদের দেশ জননীকে কারো অধীনে দাসী হয়ে থাকতে দেখে নি।
এই তারুণ্যই পারবে আগামী দিনে বাংলাদেশকে একটা বড় ও উঁচু অবস্থানে নিয়ে যেতে। বঙ্গবন্ধু চার জাতীয় নেতা সহ এদেশের বহু দল ও মতের ত্যাগী নেতা মেধাবী মানুষেরা যে পথ যে সোপান তৈরী করে দিয়ে গেছেন আজ তার অনেকটাই জয় করেছি আমরা। বাকীটাও পারতে হবে। কিছু উদ্ভট আজগুবী চিন্তার মানুষজন আর বিভ্রান্ত বুদ্ধিজীবী বুদবুদের মতো। তাদের মিলিয়ে যাওয়া সময়ের ব্যাপার। রবীন্দ্রনাথ নজরুল লালন হাসন রাজা কিংবা মুক্তিযোদ্ধাদের এই দেশ সহজে পরাজয় মানে না। পরাজিত হতে জানে না। এখন তার দেশ ও দেশের বাইরে কোটি সন্তান তাকে আগলে রাখে রাখবেও। এই বাংলাদেশের জয়ধ্বনি ছিলো জয় বাংলা। তার কোন ভয় নাই। সে বিজয়ী হবেই। এ আমাদের আশাবাদ।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক