(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
চিরুনির শোরুমে হরেক রকমের চিরুনি দেখছিলাম। দোকানের মালিক ভদ্রমহিলা নানা চিরুনির নানা গুনগান করছিলেন। কোন চিরুনি দিয়ে মাথা আঁচড়ালে কখনো মাথায় টাক পড়বে না সেই বর্ণনাও দিচ্ছিলেন। কিভাবে মাথা আঁচড়াবেন তারও হিসেবে নিকেশ রয়েছে। ভদ্রমহিলা শিল্পপতি সোহেল শাহাদাতকে সেলুনের চেয়ারের মতো চেয়ারটিতে বসিয়ে বেশ সুন্দর করে চুল আঁচড়ে দিলেন। শুধু চুলই নয়, একই সাথে তিনি মাথায় বেশ সুন্দর করে টিপে টুপে বানিয়ে দিলেন। আমরা পেছন থেকে আয়নার প্রতিবিম্বে সোহেল শাহাদাতের চোখ বুজে আসা দেখে বুঝতে পারলাম যে, তিনি বেশ আরাম পাচ্ছেন। ছোট্ট একটি চিরুনির এতো আরাম! হাতির দাঁতের চিরুনি যেমন আছে তেমনি বিভিন্ন কাঠ দিয়ে তৈরি চিরুনিও আছে। চিরুনির বক্সগুলোও দেখার মতো। একটির চেয়ে একটি সুন্দর। আবার দরদাম যখন শুনলাম তখন আমাদের আক্কেল গুড়ুম হতে শুরু করলো। চীনা মুদ্রা ইউয়ানের সাথে বাংলাদেশী মুদ্রার বিনিময় হার হিসেব কষে আমাদের গুড়ুম হওয়া আক্কেল আরো বেদিশা হয়ে উঠতে লাগলো। এক একটি চিরুনির দাম ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত! কোন দরাদরি নেই, ফিক্সড প্রাইজ। এতো দাম দিয়ে চিরুনি কারা কিনেন!
শিল্পপতি সোহেল শাহাদাত প্রায় ৭ হাজার টাকায় একটি চিরুনি কিনলেন। অতি সাধারণ চিরুনি। কিন্তু এটির এতো দামের নিশ্চয় কোন বিশেষত্ব আছে। সোহেল ভাই চিরুনিটি কেনার সাথে সাথে আমি একবার ভালো করে চুল আঁচড়ে নিলাম। এতো দামি চিরুনি আমি জীবনেও ব্যবহার করিনি। সোহেল শাহাদাত ভাই কোন দুঃখে পড়ে যে এই চিরুনি কিনলেন কে জানে!
লায়ন ফজলে করিম ভাই এবং ডালিয়া ভাবী জোর করে আমাকেও চেয়ারটিতে বসিয়ে দিলেন। কোন ধরণের বিকার ছাড়া ভদ্রমহিলা এবার আমার মাথা নিয়ে লাগলেন। বেশ কিছুক্ষন টেপাটেপি করে সুন্দর করে চুল আঁচড়ে দিলেন। আসলেই আরাম। ঘুম চলে আসার মতো আরাম পাচ্ছিলাম। তবে এই আরাম ঘরে গেলে থাকবে কিনা তা নিশ্চিত না হয়ে এতো দামের চিরুনি কেনার সাহস হলো না আমার। তাছাড়া এতো দাম দিয়ে চিরুনি কিনে এনেছি শুনলে চুল যেগুলো আছে সেগুলোও আস্ত থাকে কিনা তা নিয়ে সন্দিহান হয়ে আমি সবার আগেই দোকান থেকে বেরিয়ে আসলাম। ডালিয়া ভাবী পেছনে টিপ্পনি কাটছিলেন।
আমরা সামনে হাঁটছিলাম। ফুটপাত ধরে এগুচ্ছিলাম বিভিন্ন দোকানপাট দেখে দেখে। কিছুদূর আসার পর আবারো একটি এনসাইয়েন্ট সিটির সাইনবোর্ড দেখা গেলো। আবারো এনসাইয়েন্ট সিটি, পুরানো শহর!
মূল সড়ক থেকে ভিতরের দিকে ঢুকে পড়া সরু একটি রাস্তায় ঢুকে পড়লাম আমরা। রাস্তার দুই ধারেই শত শত বছর আগেকার বাড়িঘর, দোকানপাট। নানা ধরনের পণ্যের বিকিকিনি চলছে দোকানে দোকানে। পুরানো দিনের পণ্যের আদলে তৈরি আধুনিক পণ্য। তবে দোকান এবং বাড়িঘরগুলো সবই পুরানো। চীনের দুই আড়াই হাজার বছর আগেকার সংস্কৃতি ধরে রাখা হয়েছে।
হ্যাংঝো শহরের এই এনসাইয়েন্ট সিটিতেও প্রচুর পর্যটক। হাজার হাজার মানুষ গিজগিজ করছেন। রাস্তার দুই ধারে অনেকগুলো খাবারের দোকানও দেখা গেলো। স্থানীয় খাবার। চীনারা আগে যেসব খাবার খেতো সম্ভবত সেগুলো এখানে তৈরি করে বিক্রি করা হচ্ছে। তবে এসব খাবার দাবার চেকে দেখার ইচ্ছে আমাদের কারোরই হলো না। আমরা শুধু হেঁটে হেঁটে অতীত ঘাটতে লাগলাম।
এনসাইয়েন্ট সিটি এলাকাটি তেমন বড় নয়। একটি রাস্তার দু’পাশকেই সংরক্ষন করা হয়েছে। রাস্তাটি এক কিলোমিটারেরও কম লম্বা। রাস্তাটির দুইদিকই যুক্ত হয়েছে আধুনিক চীনে, শুধু মাঝের জায়গাটি এনসাইয়েন্ট সিটি। সংস্কৃতি রক্ষায় একটি দারুণ উদ্যোগ বলেও আমার মনে হলো। চীনা বুদ্ধির কি জয় জয়কার। এনসাইয়েন্ট সিটিতে গিজগিজ করছে পর্যটক। এখানের দোকানগুলোতে বেচাবিক্রি বাইরের দোকানপাটের তুলনায় অনেক বেশি বলেও মনে হলো। কত ধরনের কত জাতের মানুষ যে এনসাইয়েন্ট সিটির রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছেন তার ইয়ত্তা নেই। আমাদের অনেক হাঁটাহাঁটি হলো। দেখাও হলো অনেককিছু। মানুষ দেখলাম, পণ্য দেখলাম। বর্তমান এবং অতীত দেখলাম। আমরা হোটেলে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফিরতি পথ ধরলাম।
হোটেলে পৌঁছাতে হলে গাড়ি নিতে হবে। এনসাইয়েন্ট সিটির রাস্তার সামনেই আমরা একটি গাড়ি পেয়ে গেলাম। হোটেলের বিজনেস কার্ড দিয়ে বাকি কাজ বডি ল্যাঙ্গুজে সারতে হলো। সুবিধা হচ্ছে, এখানের গাড়িগুলোতে মিটার আছে। মিটারে যা উঠবে তা পরিশোধ করে নেমে গেলেই হলো। দরাদরির কোন ঝামেলা নেই। পথ চেনার বালাই নেই। তবে তারা বাড়তি পথ ঘুরিয়ে বেশি ভাড়া উঠায় কিনা কে জানে!
আলীশান হোটেলটির লবিতে পৌঁছে শাসা ও ফ্রাঞ্চিকে সোফায় বসে কাজ করতে দেখা গেলো। কী যে উদ্যম এই দুই তরুণীর! রাতে দিনে ছুটছে, আর কাজ করছে। জ্যাক কোম্পানির অতিথিদের সবকিছু সহজ এবং ছন্দময় করতে তাদের চেষ্টার কমতি নেই। আমাদের ফিরতে দেখে শাসা এবং ফ্রাঞ্চি দুজনই এগিয়ে এলো। বললো, ডিনার টাইম ৭টায়। রেস্টুরেন্টে যেনো সময়মতো চলে আসি। আমি ঘড়ি দেখলাম, বেশিক্ষন সময় নেই। ফ্রেশ হয়েই নামতে হবে। আমি ঘন্টা খানেক রেস্ট নিয়ে নামতে চেয়েছিলাম।
সন্ধ্যা ৭টার সময় ডিনার করা একটি কঠিন ব্যাপার। অথচ চীনের মানুষ ৮টার মধ্যেই ডিনার শেষ করে। অবশ্য পৃথিবীর বহুদেশের মানুষই সন্ধ্যায় ডিনার শেষ করেন। আমাদের মতো মাঝরাতে ডিনার সারা পাবলিক দুনিয়াতে খুব বেশি নেই।
লায়ন ফজলে করিম ভাই চট্টগ্রামেই সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে ডিনার সেরে ৯টায় ঘুমিয়ে যান। আর রাত ৯টায় আমাদের সন্ধ্যা নামে! সুতরাং ওনার সাথে কি করে যে আমার এতোদিনের বন্ধুত্ব টিকে রয়েছে কে জানে! ফজলে করিম ভাইকে বললাম, আপনারা যান, আমি গরম পানি দিয়ে দারুণ একটি শাওয়ার নিই। পায়ের উপর কিছুক্ষণ গরম পানি ঢালি, ব্যাথা করছে। ডিনারের শেষ দিকে এসে আপনাদের সাথে যোগ দেবো। আগেভাগে ডিনারে যাওয়ার ইচ্ছে যেমন আমার হচ্ছে না, তাছাড়া আগের কাজগুলোর সাথেও আমার কোন সম্পর্ক নেই। তিনি হাসলেন, বললেন, সুন্দর দেখাবে না। তাড়াতাড়ি শেষ করে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যাবেন। রাতে দারুণ একটি ঘুম দিলে শরীর ফ্রেশ হয়ে যাবে। সকালে আবার আর্লি উঠে পথে নামতে হবে।
হুম, পরদিন সকালের কথা মনে পড়তে চাঙ্গা মনটি কেমন যেনো দমে গেলো। ৮টার মধ্যে গাড়ি ছাড়বে। এর আগে নাস্তা সেরে গাড়িতে উঠতে হবে। ফাইভ স্টার হোটেলের সকালের নাস্তার মজাই আলাদা। অথচ হুড়োহুড়িতে সেই নাস্তার পর্বটি বেসুরো হয়ে যায়। নিজেদের বাস, একটু দেরি করে ছাড়লে কী এমন ক্ষতি হয়!
ওয়াশরুমটি দারুণ। ঠিক হোটেলটির মতোই সুন্দর, নান্দনিক। তোয়ালেগুলোও তুলোর মতো নরোম। ওয়াশরুমেই সবকিছু দেয়া আছে। হাত বাড়ালেই সাবান, শ্যাম্পু, জেল, ক্রিম পর্যন্ত সবই। এখানে গিজার দিয়ে অপেক্ষা করতে হয় না। সারাদিনই ঠান্ডা এবং গরম পানি কলে থাকে। অনেকক্ষন ধরে শাওয়ার নিলাম। ইচ্ছেমতো গরম পানি ঢাললাম শরীরে, মাথায়। পায়ের উপরও ঢাললাম অনেকক্ষণ ধরে। এতো দীর্ঘসময় নিয়ে শাওয়ার নেয়া আমার ধাচে সয় না, তবে আজ কেমন যেনো ভালো লাগছিল। ফুরফুরে মেজাজে রবি ঠাকুরের গান আওড়াতে আওড়াতে আমি গরম পানি নিঃশেষ করছিলাম। ওয়াশরুম থেকে যখন রুমে ফিরলাম তখন নিজেকে বেশ ঝরঝরে লাগছিল।
মোবাইলে চোখ পড়তেই কলজে ধক করে উঠলো। লায়ন ফজলে করিম ভাই উইচ্যাটে তিন বার কল করেছেন। কলব্যাক করার আগেই করিম ভাইয়ের চতুর্থ ফোন। হ্যালো বলতেই অনেকটা অস্থির হয়ে তিনি আমাকে দ্রুত রেস্টুরেন্টে নামার তাগাদা দিলেন।
রেস্টুরেন্টে দারুণ একটি টেবিলে বসেছেন আমাদের সবাই। করিম ভাই পাশের চেয়ারটি আমার জন্য রেখে দিয়েছিলেন। অতএব আমার বসতে সমস্যা হলো না। টেবিলে গ্লাসের উৎসব। সাথে নানা ধরণের খাবার। চোখ বুলিয়ে বুঝলাম যে, মেইন ডিস এখনো দেয়া শুরু হয়নি। অ্যাপেটাইজার চলছে। টেবিল ভর্তি নানা অচেনা খাবার। ঘোরানো টেবিল ঘুরিয়ে সবগুলো খাবারেই চোখ বুলালাম। কিন্তু কোনটি নেয়া যায় বুঝতে পারছিলাম না। টেবিল ঘুরাতে ঘুরাতে আমি এবং করিম ভাই পাকোডার মতো একটি খাবার প্লেটে তুলে নিলাম। দেখি ফ্রেঞ্চ ফ্রাইও আছে। সেটিও নিলাম। একটি সালাদ আইটেমের লেটুস পাতা হাতছানি দিচ্ছিলো। লেটুসসহ তুলে নিলাম। চীনা মরিচের কড়া ঝালের সস দিয়ে পাকোডা এবং ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খেতে দারুণ লাগছিল। সাথের সালাদ যেনো আরো একটু বেশি উপাদেয় ছিল। (চলবে)
লেখকঃ চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।