দুটি স্কুলই হচ্ছে পতেঙ্গায়

সরকারি মাধ্যমিক স্কুল প্রকল্প ।। ভূমি জটিলতায় আটকে ছিল পাঁচ বছর ।। কিছুদিনের মধ্যে একটির নির্মাণ কাজ শুরু হবে : প্রকল্প পরিচালক

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৩:৪৭ পূর্বাহ্ণ

চারটি বিভাগীয় শহরসহ সারা দেশে ৯টি নতুন সরকারি মাধ্যমিক স্কুল স্থাপন প্রকল্প গ্রহণ করে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। ২০১৮ সালে নেয়া এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ৪৩৫ কোটি টাকা। আর প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সময়সীমা ধরা হয় ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত। ওই প্রকল্পের আওতায় চট্টগ্রাম মহানগরে সরকারি দুটি মাধ্যমিক স্কুল স্থাপনের সিদ্ধান্ত রয়েছে। তবে প্রকল্প গ্রহণের ৫ বছরেও চট্টগ্রামে নতুন এ দুটি স্কুলের নির্মাণ কাজ শুরু হয়নি। এর মাঝে এক বছর আগেই (২০২১ সালের জুনে) এ প্রকল্পের সময়সীমা শেষ হয়েছে। বলতে গেলে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও স্কুলের নির্মাণ কাজ শুরু করা যায়নি। যদিও এর মধ্যে আরো দু’বছর বাড়িয়ে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্পটির পরিচালক রায়হানা তসলিম। আর ভূমি অধিগ্রহণসহ দাফতরিক প্রক্রিয়া শেষ জানিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই (চলতি মাসেই) একটি স্কুলের নির্মাণ কাজ শুরু হবে বলে দাবি করেছেন তিনি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভূমি জটিলতায় দীর্ঘ দিন এ প্রকল্প আটকে ছিল। নতুন দুটি স্কুলের জন্য মহানগরে জমি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। দীর্ঘ সময় ধরে অনেক খোঁজাখুঁজির পর অবশেষে জমি চিহ্নিত করতে সক্ষম হয় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। তবে স্কুল দুটির জন্য জমি চিহ্নিত করা হয় পতেঙ্গা এলাকাতেই। প্রস্তাবিত দুটি স্কুলের স্থান হিসেবে একটি উত্তর পতেঙ্গা এলাকায় এবং অপরটি পূর্ব পতেঙ্গা এলাকা নির্বাচন করা হয়েছে। প্রস্তাবিত এ দুটি স্থানের মধ্যকার দূরত্ব বড় জোর ৩ থেকে ৪ কিলোমিটার বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। অর্থাৎ ভূমি জটিলতায় দীর্ঘদিন আটকে থাকার পর এখন নতুন দুটি স্কুলই হচ্ছে পতেঙ্গা এলাকায়।
যদিও কাছাকাছি বা একই এলাকায় দুটি স্কুল স্থাপনের চাইতে অপরিহার্যতা বিবেচনায় নিয়ে শহরের দুই প্রান্তে স্কুল দুটি স্থাপন করা হলে চট্টগ্রামবাসী উপকৃত হতো বলে অভিমত শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের। চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর শাহেদা ইসলাম মনে করেন- যেহেতু দীর্ঘ সময় পর চট্টগ্রাম শহরে দুটি নতুন স্কুল হচ্ছে, সেহেতু চাহিদা ও অপরিহার্যতাসহ সব দিক বিবেচনায় নিয়েই স্থান নির্বাচন করা উচিত। দুটি স্কুল শহরের দুই প্রান্তে অর্থাৎ পতেঙ্গা এলাকায় একটি হলে অপরটি চান্দগাঁও, মোহরা বা অক্সিজেন এলাকায় স্থাপন করতে পারলে সবচেয়ে ভালো হতো। তবে অনেক চেষ্টা করেও অক্সিজেন বা মোহরা এলাকায় জমি সংস্থান করা যায়নি বলে জানিয়েছিলেন চট্টগ্রামের বিদায়ী জেলাপ্রশাসক মো. ইলিয়াস হোসেন। ২০২০ সালের ১৯ নভেম্বর দৈনিক আজাদীর প্রথম পাতায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জেলাপ্রশাসক বলেন, আমরা অনেক খুঁজেছি। কিন্তু উপযুক্ত জমি পাইনি। অনেক চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত পতেঙ্গার দিকে জমি খুঁজে পেয়েছি।
জেলাপ্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, প্রস্তাবিত দুটি স্কুলের জন্য পতেঙ্গা থানাধীন পূর্ব পতেঙ্গা মৌজায় একটি এবং অপরটি উত্তর পতেঙ্গা মৌজা এলাকায় স্থান নির্বাচন করা হয়েছে। এর মধ্যে উত্তর পতেঙ্গা মৌজায় প্রস্তাবিত স্কুলের জন্য দুই একর জমি পাওয়া গেলেও পূর্ব পতেঙ্গা এলাকার স্কুলটির জন্য জমি মিলেছে প্রায় এক একর।
এদিকে, প্রস্তাবিত স্কুল দুটি চট্টগ্রাম শাহ-আমানত বিমানবন্দরের কাছাকাছি এলাকায় হওয়ায় ভূমি ব্যবহারের সম্মতির পাশাপাশি বহুতল স্থাপনা নির্মাণের ক্ষেত্রেও সিভিল এভিয়েশনের অনাপত্তি নেয়ার নিয়ম রয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। যদিও অনুমতিসহ আনুষ্ঠানিক সব প্রক্রিয়া এরই মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে বলে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
মাউশির নতুন এই স্কুল স্থাপন প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে রয়েছেন রায়হানা তসলিম। তিনি আজাদীকে বলেন, প্রথমে একটি স্কুলের জন্য জমি নির্বাচন করা গেলেও অপরটির জন্য জমি পাওয়া যাচ্ছিল না। ২য় স্কুলের জন্য শেষ পর্যন্ত পতেঙ্গা এলাকাতেই জমি চিহ্নিত করা হয়েছে। অনেক চেষ্টা করে জেলাপ্রশাসন এ জমি খুঁজে দিয়েছে। যদিও প্রয়োজনের তুলনায় সেখানে জমির পরিমাণও কম। এরপরও মন্ত্রণালয় সেটি অনুমোদন দিয়েছে। বর্তমানে দুটি স্কুলের জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে জানিয়ে রায়হানা তসলিম বলেন, আমাদের সবচেয়ে জটিল যে কাজটি ছিল, তা শেষ হয়েছে। দুটির মধ্যে উত্তর পতেঙ্গা এলাকার স্কুলটির টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষে কার্যাদেশও (ওয়ার্কঅর্ডার) দেয়া হয়ে গেছে। কিছুদিনের মধ্যেই (চলতি মাসে) এ স্কুলটির নির্মাণ কাজ শুরু করতে পারবো বলে আমরা আশা করছি। আর পূর্ব পতেঙ্গা এলাকার স্কুলটির টেন্ডার আহ্বান এখন প্রক্রিয়াধীন। প্রকল্পের মেয়াদের বিষয়ে রায়হানা তসলিম বলেন, ২০১৮ সাল থেকে প্রকল্পের কাজ শুরুর কথা থাকলেও প্রকৃতপক্ষে এটি ২০১৯ সালে শুরু হয়েছে। আর ভূমি জটিলতায় দীর্ঘ সময় কাজ আটকে ছিল। এর মধ্যে প্রকল্পের সময়সীমা শেষ হলেও আরো দু’বছর বাড়িয়ে এখন ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছে বলে জানান প্রকল্প পরিচালক।
মাউশি সূত্রে জানা গেছে, মোট ৯টি স্কুলের মধ্যে চট্টগ্রাম মহানগরে ২টি ছাড়াও রাজশাহীর বিভাগীয় শহরে ২টি ও জয়পুরহাটে ১টি, রংপুরে ২টি, ময়মনসিংহে ১টি ও সিলেট বিভাগের শ্রীমঙ্গলের চা বাগান এলাকায় ১টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হচ্ছে। এ সব বিদ্যালয়ে থাকবে আধুনিক ভৌত অবকাঠামো সুবিধা ও যুগপোযোগী শিক্ষা সামগ্রী। বিভাগীয় শহরের ৭টি স্কুল হবে ১০ তলাবিশিষ্ট এবং জেলা-উপজেলা শহরের ২টি হবে ৬ তলাবিশিষ্ট। এ সব স্কুলে পর্যাপ্ত সংখ্যক শ্রেণি কক্ষের পাশাপাশি আইসিটি ল্যাব, বিজ্ঞানাগার, লাইব্রেরি, মাল্টিপারপাস হল রুম, প্রধান শিক্ষকের কক্ষ, সহকারী প্রধান শিক্ষকের কক্ষ, অফিস কক্ষ, শিক্ষক কমনরুম, নামাজের ঘর, দর্শনার্থী কক্ষ, বিএনসিসি, গার্লস গাইড কক্ষ, প্রাথমিক চিকিৎসা কক্ষ, মিড ডে মিল কক্ষ ও সেমিনার কক্ষ থাকবে। এ ছাড়া ইন্টারনেট সুবিধাসহ ল্যাপটপ, কম্পিউটার ও কম্পিউটার সামগ্রী, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, বই-পুস্তক, খেলাধুলার সরঞ্জাম, বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ও আসবাবপত্রও থাকবে।
মাউশির তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম মহানগরে প্রস্তাবিত দুটি স্কুলের প্রতিটির জন্য মহানগরের অভ্যন্তরেই ন্যূনতম ২ একর করে জমি প্রয়োজন। কিন্তু একটির জন্য জমি চিহ্নিত হলেও দীর্ঘ চেষ্টার পরও অপর একটির জন্য জমি পাওয়া যাচ্ছিল না চট্টগ্রাম মহানগরে। শেষমেষ একটি স্কুলের জমি নির্বাচন ছাড়াই প্রকল্পটির ডিপিপি (ডিটেইল প্রজেক্ট প্রোফাইল) সাবমিট করা হয়। অনেক খোঁজাখুঁিজর পরও মহানগরে ২ একর জমি বের করতে না পারায় অনেকটা হাল ছেড়ে দেন মাউশি চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয়ের কর্মকর্তারাও। জমির সংস্থান না হওয়ায় প্রস্তাবিত দুটি স্কুলের একটি হারানোর শঙ্কা দেখা দেয়। এ নিয়ে ২০১৮ সালের ১৫ ডিসেম্বর দৈনিক আজাদীর প্রথম পাতায় ‘জমির অভাবে নতুন স্কুল পেয়েও হারাবে চট্টগ্রাম?’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। মহানগরে কোনো ভাবেই জমির সংস্থান না হলে সরকার প্রস্তাবিত স্কুল চট্টগ্রাম থেকে অন্যত্র (অন্য কোন বিভাগীয় শহর বা জেলায়) সরিয়ে নিতে পারে মর্মে আশঙ্কার কথা তুলে ধরা হয় প্রতিবেদনে।
ওই সময় তত্ত্ববধায়ক সরকারের সাবেক শিক্ষা ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান আজাদীকে বলেন, চট্টগ্রাম মহানগরে জমি পাওয়াটা কঠিন সেটা ঠিক। কিন্তু আমাদের প্রয়োজনের বিষয়টি অগ্রাধিকার দেয়া উচিত। একই সাথে ২ একর জমি কিনতে পাওয়া না গেলেও বিকল্প উপায়ের কথা ভাবতে হবে। যেমন সরকারি জমি হয়তো কারো দখলে আছে, সেটাও দেখা যেতে পারে। আবার (সরকারি জমি) নিম্নমানের কোনো কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে, তাও দেখা যেতে পারে। মোটকথা, হাল ছেড়ে দেয়াটা সমাধান না। সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো এ বিষয়ে আরো আন্তরিক হলে, আরো বেশি সচেষ্ট হলে জমি বের করাটা খুব কঠিন কিছু বলে মনে করেন না ড. হোসেন জিল্লুর রহমান।
পরবর্তীতে চট্টগ্রাম মহানগরে একই সাথে দুই একরের স্থলে আরো কম পরিমাণ জমিতেও নতুন স্কুল স্থাপনে অনুমোদন দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এর প্রেক্ষিতে ২য় স্কুলটির জন্য পতেঙ্গা এলাকাতেই প্রায় এক একর জমি চিহ্নিত করে চট্টগ্রাম জেলাপ্রশাসন। এতে করে প্রস্তাবিত নতুন দুটি স্কুলই শহরের এক পাশে (পতেঙ্গা এলাকায়) স্থাপনের প্রক্রিয়া এগিয়ে চলছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধফখরুল সাহেবদের হৃদয়ে পাকিস্তান, সেটিই বেরিয়ে এসেছে
পরবর্তী নিবন্ধলেবু চাষে লাভ বেশি