চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডের (সিইউএফএল) উৎপাদন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। পাশাপাশি বহুজাতিক সার কারখানা কাফকো থেকে সার পরিবহনে ধস নামায় দেশে সারের সংকট দেখা দেয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। কাফকো থেকে দৈনিক আড়াই হাজার টন সার পরিবহন হওয়ার কথা থাকলেও সংঘবদ্ধ চক্রের অপতৎপরতায় তা ১৭শ টনে নেমে এসেছে। চড়া দামে কেনা কাফকোর উৎপাদিত সার সিইউএফএলের গুদাম হয়ে পরিবাহিত হওয়ায় সংকট প্রকট হচ্ছে। সংকটের সুরাহা করতে ঢাকা থেকে উচ্চ পর্যায়ের দুটি টিম গতকাল চট্টগ্রামে এসেছে। বিসিআইসি, কাফকো, সিইউএফএল, পরিবহন ঠিকাদারসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে আজ রোববার সকালে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক হবে। বৈঠকে সার পরিবহন সংকট সুরাহায় অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করা হবে।
জানা যায়, ইউরিয়া সার দেশীয় কারখানাগুলোতে উৎপাদনের পাশাপাশি বিদেশ থেকেও চড়া দামে আমদানি করা হয়। আমদানিকৃত সার ভর্তুকি দিয়ে কৃষকদের মাঝে সরবরাহ করা হয়। ইউরিয়া সারের পুরোটাই সরকার নিয়ন্ত্রিত। দেশে প্রায় ৫৭ লাখ ৫০ হাজার টন বিভিন্ন ধরনের সারের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে ইউরিয়ার চাহিদা প্রায় সাড়ে ২৬ লাখ টন। বিভিন্ন কারখানায় উৎপাদিত এবং বিদেশ থেকে আমদানিকৃত সার বিসিআইসির তালিকাভুক্ত ঠিকাদারদের মাধ্যমে বিভিন্ন অঞ্চলের ২৫টি সরকারি গুদামে (বাফার গুদাম) পরিবহন করা হয়। বিসিআইসির নিয়োজিত ১৫টি পরিবহন ঠিকাদারিসহ বিপুল সংখ্যক ডিলার এই সার পরিবহন ও বাজারজাতের সাথে জড়িত।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, আমদানি করা বস্তাভর্তি ইউরিয়া সার বন্দর থেকে সরাসরি গুদামে নিয়ে যাওয়া হয়। আবার খোলা অবস্থায় আমদানিকৃত সার সংশ্লিষ্ট কোনো সার কারখানায় নিয়ে বস্তাভর্তি করা হয়। উভয় ক্ষেত্রে সার পরিবহন ঠিকাদারের মাধ্যমে পরিবহন করা হয়। বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশনের (বিসিআইসি) সাথে ঠিকাদারদের সম্পাদিত পরিবহন চুক্তির ৪(বি) ধারা অনুযায়ী, ডেলিভারি চালান ইস্যুর পর ৫০ দিনের মধ্যে বাল্ক ইউরিয়া ও ৪০ দিনের মধ্যে বস্তাভর্তি ইউরিয়া সার নির্দিষ্ট গুদামে বা ফ্যাক্টরিতে পৌঁছে দেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
চট্টগ্রামের দুটি ইউরিয়া সার কারখানায় উৎপাদিত সার দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ২৫টি বাফার গুদামে পাঠানো হয়। এর মধ্যে সিইউএফএলের সারের পাশাপাশি সরকার বহুজাতিক সার কারখানা কাফকো থেকেও আন্তর্জাতিক বাজারদরে সার কিনে নেয়। প্রায় তিন মাস আগে বিস্ফোরণের পর রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানা সিইউএফএলের উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে চট্টগ্রামে শুধুমাত্র কাফকোতে ইউরিয়া উৎপাদিত হচ্ছে। বিসিআইসির সাথে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী কাফকো থেকে সরকার প্রতিদিন তাদের উৎপাদিত সব সার কিনে নেয়ার কথা। আন্তর্জাতিক বাজারদরে এবং বৈদেশিক মুদ্রায় এই সার কেনা হয়। কাফকোর উৎপাদিত দৈনিক প্রায় আড়াই হাজার টন সারের বিপরীতে সরকারকে শত শত কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হয়। আন্তর্জাতিক বাজারদরে কেনা এই সার দেশীয় মূল্যে পৌঁছানো হয় কৃষকের হাতে। পৌঁছানোর ব্যাপারটি নিয়ে নানা অভিযোগ রয়েছে।
কাফকো থেকে সার সরাসরি বাফার গুদামে পাঠানোর ব্যবস্থা থাকলেও অজ্ঞাত কারণে বিপুল পরিমাণ সার নিয়ে আসা হয় সিইউএফএলের গুদামে। সিইউএফএল থেকে ওই সার আবার পাঠানো হয় বাফার গুদামে। একই সার দুইবার পরিবহন করে দুই বারে কোটি কোটি টাকার বিল নেয়ার ঘটনা ঘটছে বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে।
এক্ষেত্রে সংকট তৈরি হয়েছে দেশব্যাপী সার পরিবহনে। নানাভাবে ষড়যন্ত্র করে সার পরিবহন প্রায় অর্ধেকে নামিয়ে আনা হয়েছে। কাফকো থেকে দৈনিক দুই হাজার পাঁচশ টন সার পরিবহন করার কথা থাকলেও তা নেমে এসেছে ১৭শ টনে। প্রতিদিন ৮শ টন বা ১৬ হাজার বস্তা কম ইউরিয়া সরবরাহ হওয়ায় কৃষিখাতে সারের কৃত্রিম সংকট তৈরির আশঙ্কা প্রকট হয়ে উঠেছে।
এদিকে গতকাল বিকালে বিসিআইসি ও কাফকোর উচ্চ পর্যায়ের দুটি টিম চট্টগ্রামে পৌঁছেছে। আজ সকাল ১১টায় সিইউএফএলের সম্মেলন কক্ষে দুটি টিম স্থানীয় শীর্ষ কর্মকর্তা এবং পরিবহন ঠিকাদারদের সাথে বৈঠক আহ্বান করেছে। বৈঠকে কাফকো থেকে কী করে দৈনিক আড়াই হাজার টন সার বাজারে পাঠানো যায় তার অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিসিআইসির পদস্থ একজন কর্মকর্তা বলেন, কৃষির ভর মৌসুম চলছে। স্পর্শকাতর একটি সময়। এমন সময়ে সার নিয়ে কাউকে ছিনিমিনি খেলতে দেয়া হবে না। এখানে নানা ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত থাকতে পারে। বিসিআইসি, কাফকো, সিইউএফএল এবং পরিবহন ঠিকাদারসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে আলোচনা করে সার সরবরাহ বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।