দুই ভাগ হচ্ছে এনবিআর

রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা নামে নতুন বিভাগ, থাকবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ।। অধ্যাদেশ জারি কয়েকদিনের মধ্যে

হাসান আকবর | রবিবার , ২৭ এপ্রিল, ২০২৫ at ৪:২১ পূর্বাহ্ণ

রাজস্ব আয় বৃদ্ধি, বিনিয়োগ বৃদ্ধি, ট্যাক্স নেট সম্প্রসারণ, শুল্ক ফাঁকি রোধ, হয়রানি বন্ধসহ জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআরকে গণমুখী করতে দুই ভাগে ভাগ করা হচ্ছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের পরিবর্তে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা নামে নতুন বিভাগ চালু করা হচ্ছে। দুই বিভাগের নেতৃত্ব দেবেন দুজন সচিব। বিভাগ দুটির কার্যপরিধি ভাগ করে আলাদা আলাদা দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে একটি বিভাগ রাজস্ব নীতি প্রণয়ন করবে, অপর বিভাগ রাজস্ব আদায়ে কাজ করবে। খসড়া অধ্যাদেশ প্রস্তুত করা হয়েছে। এ অধ্যাদেশ উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদনও পেয়েছে। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারির কথা রয়েছে। অধ্যাদেশ জারি হলে রাজস্ব বোর্ড বিলুপ্ত করে দেশের রাজস্ব খাতকে নতুন দুটি বিভাগের হাতে তুলে দেওয়া হবে। আগামী পহেলা জুলাই থেকে নতুন দুটি বিভাগ কাজ শুরু করতে পারবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর মাধ্যমে দেশের রাজস্ব প্রশাসনের শীর্ষ সংস্থাটির পাঁচ দশকের বেশি সময়ের পুরনো কাঠামো নতুন রূপ পাবে।

দেশের রাজস্ব আয় পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন এনবিআর। বর্তমানে এনবিআর আয়কর, শুল্ক বিভাগ, জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর, কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট আপিলেট ট্রাইব্যুনাল এবং ট্যাঙেস আপিলেট ট্রাইব্যুনাল নিয়ন্ত্রণ করে।

আইআরডির সচিব বা সিনিয়র সচিব হিসেবে যিনি থাকেন তিনি পদাধিকারবলে বিভাগগুলোর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এখন এনবিআরকে দুই ভাগ করে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম পৃথক করে দুটি স্বতন্ত্র বিভাগ সৃষ্টি ও কার্যকর করতে বিদ্যমান জাতীয় রাজস্ব বোর্ড আদেশ ১৯৭২ রহিত করে অধ্যাদেশ জারি করতে হবে। এই অধ্যাদেশের খসড়া ইতোমধ্যে প্রস্তুত করা হয়েছে। আগামী দিন কয়েকের মধ্যে উপদেষ্টা পরিষদের চূড়ান্ত অনুমোদনের পর রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ জারি করবেন জানিয়ে সূত্র বলেছে, রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তারাই মূলত নতুন দুটি বিভাগের নেতৃত্ব দেবেন বলে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

অধ্যাদেশের খসড়ায় দেখা গেছে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে দুটি বিভাগ কাজ করবে। দুই বিভাগের সচিব হবেন আয়কর ও কাস্টমস ক্যাডারের ন্যূনতম ২০ বছর কাজের অভিজ্ঞতা থাকা কর্মকর্তারা। পালাক্রমে দুই বিভাগে দুই ক্যাডারের শীর্ষ কর্মকর্তারা এ দায়িত্ব পালন করবেন। অধ্যাদেশ উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদিত হলে নীতি ও ব্যবস্থাপনা বিভাগ সৃষ্টি করতে রুলস অব বিজনেস (অ্যালোকেশন অব বিজনেস), উভয় ক্যাডারের ক্যাডার রুলস সংশোধন এবং বিভাগ দুটির সাংগঠনিক কাঠামো প্রণয়ন করতে হবে।

এতে বলা হয়েছে, এনবিআরের বর্তমান কাঠামো রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ নামে কার্যক্রম চালাবে। এই বিভাগ রাজস্ব নীতি বিভাগ প্রণীত আয়কর, ভ্রমণ কর, দান কর, সম্পদ কর, শুল্ক, মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট), সম্পূরক শুল্ক, আবগারি শুল্ক, সারচার্জ আইন ও বিধি প্রয়োগের মাধ্যমে রাজস্ব আদায় করবে। পাশাপাশি রাজস্ব ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত পদ্ধতিগত বিধিমালা প্রণয়ন, ব্যবস্থাপনা বিভাগের বাজেট প্রণয়ন, বাজেট বাস্তবায়ন ও লজিস্টিকস সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনা করবে।

এছাড়া আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও শুল্ক সংক্রান্ত চুক্তি আলোচনা, সম্পাদন ও মতামত দেওয়ার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক দ্বৈত কর পরিহার চুক্তি সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব এই বিভাগ পালন করবে। এছাড়া আয়কর ও কাস্টমস ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বদলি ও পদায়ন, রাজস্ব ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত কার্যক্রমের দক্ষতা, কার্যকারিতা ও গতিশীলতা বৃদ্ধি এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সব দায়িত্বে থাকবে ব্যবস্থাপনা বিভাগ। আয়কর আপিল এবং কাস্টমস, এঙাইজ ও ভ্যাট আপিল অফিস এ বিভাগের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণাধীন থাকবে।

অপরদিকে রাজস্ব নীতি বিভাগ আয়কর, ভ্রমণ কর, দান কর, সম্পদ কর, শুল্ক, মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট), সম্পূরক শুল্ক, আবগারি শুল্ক, সারচার্জ এবং শুল্ক কর সংশ্লিষ্ট অন্যান্য আইন ও বিধি প্রণয়ন, সংশোধন ও এসবের ব্যাখ্যা প্রদান করবে। এছাড়া শুল্ক কর আরোপ ও অব্যাহতি সংক্রান্ত কার্যক্রম, রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী অন্য কার্যক্রম এবং সরকারের দেওয়া অন্য যেকোনো দায়িত্ব এই বিভাগ পালন করবে বলে খসড়ায় উল্লেখ করা হয়।

এতে বলা হয়, রাজস্ব নীতি প্রণয়নে রাজস্ব নীতি বিভাগকে পরামর্শ দিতে অর্থনীতিবিদ, রাজস্ব বিশেষজ্ঞ, ব্যবসায়ী ও পেশাজীবী প্রতিনিধি এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, দপ্তর ও অংশীজনদের প্রতিনিধিত্বে একটি উপদেষ্টা কমিটি গঠিত হবে। এই কমিটির কার্যপরিধি রাজস্ব নীতি বিভাগ নির্ধারণ করবে। এছাড়া কাস্টমস, এঙাইজ এবং ভ্যাট আপিল ট্রাইব্যুনাল এবং আয়কর আপিল ট্রাইব্যুনাল রাজস্ব নীতি বিভাগে সংযুক্ত দপ্তর হবে।

সূত্র বলেছে, রাজস্ব প্রশাসন সংস্কারের বিষয়টি নব্বইয়ের দশক থেকে আলোচনায় রয়েছে। তাবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এনবিআরকে বিদ্যমান মডেল থেকে সরে আসার তাগিদ দিচ্ছিলেন বিশেষজ্ঞ, বিদেশি উন্নয়ন সহযোগী এবং দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীরা। রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনাকে আলাদা করার এই তাগিদ দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি।

৫ আগস্ট ছাত্র গণঅভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর অন্তবর্তীকালীন সরকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যবস্থা সংস্কারের যে উদ্যোগ নেয় তারই অংশ হিসেবে এনবিআর সংস্কারে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি) পাঁচ সদস্যের একটি পরামর্শক কমিটি গঠন করে। প্রশাসন ক্যাডার থেকে আসা এনবিআরের সাবেক দুই চেয়ারম্যান, শুল্ক ও আয়কর ক্যাডারের সাবেক দুজন মেম্বারসহ কয়েকজনকে এই কমিটিতে রাখা হয়।

গত ডিসেম্বরে রাজস্ব খাত সংস্কার বিষয়ক ওই কমিটি অর্থ উপদেষ্টার কাছে ‘রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা’ নামে আলাদা বিভাগ করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে প্রতিবেদন জমা দেয়। এতে বলা হয়, স্বচ্ছ ও উন্নয়নবান্ধব রাজস্ব নীতি প্রণয়ন ও প্রত্যাশিত রাজস্ব আদায়ে ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির আদেশ পুনঃপরিবর্তন করে এনবিআর ও আইআরডি পুনর্গঠন প্রয়োজন। উপদেষ্টা পরিষদ বিষয়টি নীতিগতভাবে অনুমোদন দিয়েছে জানিয়ে সূত্র বলেছে, আগামী কয়েকদিনের মধ্যে রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ জারি করতে পারেন।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এটি অত্যন্ত ভালো একটি কাজ হতে যাচ্ছে। এতে রাজস্ব আয়ের কার্যক্রমে গতি আসবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এই সিদ্ধান্ত অত্যন্ত গণমুখী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকৌতুক কণিকা
পরবর্তী নিবন্ধনাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে মাইন বিস্ফোরণে যুবকের পা বিচ্ছিন্ন