দুই-তিনটি ছিনতাইয়ের পর ওরা শহর ছেড়ে যায়

পুরনো কায়দায় সক্রিয় হামকা গ্রুপ ম দুটি টেক্সি নিয়ে চলে অপকর্ম, গ্রেপ্তার ৫

ঋত্বিক নয়ন | বুধবার , ২৪ জানুয়ারি, ২০২৪ at ৬:১২ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামে পুরনো কায়দায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে দুর্ধর্ষ ছিনতাইকারী চক্র ‘হামকা গ্রুপ’। দলনেতা নুর আলম কারাগারে থাকলেও সেকেন্ড ইন কমান্ড মোস্তাফিজুর রহমান মিঠুর নেতৃত্বে নতুন করে সংগঠিত গ্রুপটি কেড়ে নিচ্ছে সর্বস্ব। এবারও তাদের সম্বল দুটি সিএনজি টেক্সি। চালকের ছদ্মবেশে ছিনতাই করে বেড়ায় তারা। টার্গেট থাকে বিভিন্ন ব্যাংক, এটিএম বুথ থেকে টাকা উত্তোলন করা ব্যক্তিরা। সবশেষ ১৭ ডিসেম্বর বিকালে নগরীর চকবাজার থানার নার্সারি মোড়ে এক ব্যক্তির কাছ থেকে ছিনতাইয়ের ঘটনা অনুসন্ধানে নেমে গ্রুপটির ফের সক্রিয় হয়ে ওঠার তথ্য জানতে পারে পুলিশ। এরপর গত চার দিনে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে দলনেতা মিঠুসহ ৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের কাছ থেকে ছিনতাইয়ে ব্যবহৃত দুটি সিএনজি টেক্সি জব্দ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সিএমপির অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি দক্ষিণ) নোবেল চাকমা। গ্রেপ্তার পাঁচজন হলো মোস্তাফিজুর রহমান মিঠু (৪০), বাবুল (৪০), জসীম (৪২), দেলোয়ার (৩৭) ও রফিকুল ইসলাম (৪৫)

পুলিশ জানায়, ১৭ ডিসেম্বর বিকালে চকবাজার থানার নার্সারি মোড়ে ছিনতাইয়ের শিকার হন সিএনজি টেক্সি যাত্রী মিজানুর রহমান নামে এক ঠিকাদার। তিনি জিইসি মোড়ে আরববাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৫ লাখ টাকা তুলে টাইগারপাসে নগর ভবনে যাচ্ছিলেন। ছিনতাইয়ের ঘটনায় পরদিন তিনি চকবাজার থানায় মামলা করেন।

এডিসি নোবেল চাকমা জানান, মিজানুর রহমানকে বহনকারী টেক্সিটি নার্সারি মোড়ে গিয়ে হঠাৎ থেমে যায়। চালক নেমে গাড়ি মেরামতের জন্য টুলবক্স লাগবে জানিয়ে তাকে গ্রিলের দরজা খুলতে বলেন। মিজানুর দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে চালক দ্রুত উঠে তার পাশে বসে যান। পেছন থেকে আরও দুজন এসে একজন তার কোলের ওপর এবং আরেকজন পাশ বসে পড়েন। একপর্যায়ে চলন্ত গাড়িতে তাকে ভয়ভীতি দেখিয়ে ৫ লাখ টাকা কেড়ে নেন। এরপর তাকে আশপাশের বিভিন্ন এলাকা ঘুরিয়ে সিআরবিতে রেলওয়ে স্কুলের পাশে একটি নির্জন স্থানে নামিয়ে দেন। ঘটনার খবর পেয়ে চকবাজার থানা পুলিশ ঘটনাস্থল ও আশপাশের এলাকার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে দুটি সিএনজি টেক্সি শনাক্ত করে। এর সূত্র ধরে জড়িতদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করা হয়।

চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ ওয়ালী উদ্দিন আকবর জানান, গ্রেপ্তার ৫ জনের মধ্যে বাবুলকে ১৮ জানুয়ারি চান্দগাঁও থানার খাজা রোড থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে রাহাত্তারপুল থেকে একটি সিএনজি টেক্সি জব্দ করা হয়। বাবুলকে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মোস্তাফিজুর রহমান মিঠু ও জসীমকে বন্দর থানা এলাকা থেকে ২১ জানুয়ারি গভীর রাতে গ্রেপ্তার করা হয়। সোমবার বিকালে আদালতে হাজির করা হলে তারা জবানবন্দি দিয়ে ঘটনার দায় স্বীকার করে। এরপর তাদের তথ্যে রাত ১০টার দিকে নগরীর আগ্রাবাদ থেকে রফিকুল ও বায়েজিদ এলাকা থেকে দেলোয়ারকে গ্রেপ্তার করা হয়। রফিকুলের তথ্যে হালিশহর থেকে আরেকটি সিএনজি উদ্ধার করা হয়।

তদন্তে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ওসি জানান, যাত্রী মিজানুর রহমানকে বহনকারী টেক্সিটি চালাচ্ছিল মিঠু। পেছনে আরেকটি টেক্সিতে করে বাকি চারজন সেটিকে অনুসরণ করছিল, যেটি চালাচ্ছিল বাবুল। প্রথম টেক্সি থামানোর পর পেছনেরটিও থেমে যায়। যাত্রী দরজা খোলার পর চালক মিঠু দ্রুত উঠে তাকে জিম্মি করে। পেছনের গাড়ি থেকে দেলোয়ার ও জসীমও উঠে যাত্রীকে জিম্মি করে। রফিকুল গাড়ি চালিয়ে এগোতে থাকে। পেছনে ব্যাকআপ গাড়ি নিয়ে বাবুল তাদের অনুসরণ করে।

তিনি জানান, এ ছিনতাইকাণ্ডের মূল নেতৃত্বদাতা মিঠু। সে একসময় হামকা গ্রুপের সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিল। পাঁচ মাস আগে জেল থেকে বেরিয়ে গ্রুপের নিষ্ক্রিয় সদস্যদের সক্রিয় করে এবং আগের মতো ছিনতাই শুরু করে। গ্রেপ্তার প্রত্যেকের বিরুদ্ধে নগরী ও জেলার বিভিন্ন থানায় অস্ত্র আইনে ও ডাকাতিছিনতাইয়ের অভিযোগে একাধিক মামলা আছে।

পুলিশ হেফাজতে থাকা মিঠু ছিনতাইয়ের কৌশল সম্পর্কে জানিয়েছে, তাদের গ্রুপের প্রত্যেক সদস্যই সিএনজি টেক্সি চালাতে সক্ষম। গ্রেপ্তার ৫ জনের চারজনই টেক্সি চালক। তারা দুটি টেক্সি নিয়ে বের হয়। প্রথমটি খালি থাকে, দ্বিতীয়টিতে থাকে চালকসহ চার ছিনতাইকারী। খালি টেক্সি যেকোনো ব্যাংকের নিচে গিয়ে দাঁড়ায়। টাকা তুলে কেউ একাকী বের হলে তাকে গন্তব্যস্থানের জন্য অপেক্ষাকৃত কম ভাড়া হাঁকিয়ে তুলে নেয়। নির্জন কোনো স্থানে গিয়ে টেক্সি নষ্ট হওয়ার কথা বলে সড়কের পাশে সেটি রাখে। যাত্রীর সিটের পেছন থেকে যন্ত্রাংশ নেওয়ার কথা বলে পেছনের গ্রিলের দরজাটি খোলা হয়। তখন পেছনে আসা ব্যাকআপ টেক্সি থেকে তিনজন নেমে ওই টেক্সির ভেতরে ঢুকে ওই ব্যক্তিকে জিম্মি করে ফেলে। অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে অথবা চড়থাপ্পড় দিয়ে, শ্বাসরোধে মেরে ফেলার ভঙ্গি করে টাকা কেড়ে নেয়। তবে তারা কখনো মোবাইল নেয় না। মাঝে মাঝে তারা নিজেদের পুলিশ সদস্য পরিচয়ও দেয়।

নোবেল চাকমা আজাদীকে বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে ছিনতাইকারীরা জানিয়েছে, সাধারণত একদিন অথবা দুই দিনে ২৩টি ছিনতাইয়ের পর তারা চট্টগ্রাম শহর ছেড়ে পালিয়ে যায়। এদের বাড়ি রাজশাহী, গোপালগঞ্জ, নওগাঁ, নেত্রকোণাসহ বিভিন্ন জেলায়। ছিনতাইয়ের পর তারা বাড়িতে চলে যায় অথবা চট্টগ্রাম ছেড়ে অন্য কোনো জেলায়। এক মাস পর আবার ফিরে আসে। আবার কয়েকটি ছিনতাই করে এক মাসের জন্য পালিয়ে যায়। তারা যেসব সিএনজি টেক্সি ছিনতাইয়ের জন্য ব্যবহার করে সেগুলোর নম্বর প্লেটের একদম শেষের দুটি ডিজিট টেপ দিয়ে অথবা মুছে আড়াল করে দেয়। এর ফলে টেক্সি শনাক্ত করতে কষ্ট হয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরোজার আগে তেল, চিনি ও খেজুরের শুল্ক কমানোর উদ্যোগ
পরবর্তী নিবন্ধসিগারেটের আগুনে পুড়ল তুলাবাহী কাভার্ডভ্যান