(পর্ব ৩)
জাম্বুরা খেয়ে শরীর এলিয়ে দেয়ার খানিক বাদেই হাজির হলেন তানভীর ভাই। যথারীতি চার দিনের ট্রিপের জন্য চল্লিশ দিনের উপযোগী মালপত্র নিয়ে! প্যানিয়ার, ফ্রেম ব্যাগ এবং টপ টিউব ব্যাগ উপচে পড়ছে জিনিসপত্রে। তাতেও সব মালপত্তরের জায়গা মেলেনি। কাঁধের ডে প্যাকেও একগাদা জিনিসপত্র। এসেই ফিরিস্তি দিতে লাগলেন, ভুলে আরো কি কি জানি নিয়ে আসা হয়নি। সাধে কি আর লোকটাকে গিয়ার মাফিয়া ডাকি আমরা! আমাদের পরের গন্তব্য মামুর ঘাট। সেখান থেকেই বাণীশান্তা ঘাট যাবার খেয়া মিলবে। লোকজনকে জিজ্ঞেস করে মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই মামুর ঘাটে। সামনেই মংলা নদী। অল্প এগিয়ে সেটা মিশেছে পশুর নদীর সাথে। পশুরের ওপারেই আমাদের গন্তব্য। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেও বাণীশান্তা ঘাটের খেয়া না পেয়ে ক্যাম্পের ঘাট চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। নোঙর করা জাহাজের ফাঁকফোকর গলে দুইটা নদী পেরিয়ে ওপারে যেতে খুব বেশি সময় লাগল না। ক্যাম্পের ঘাট থেকে মাটির রাস্তা শুরু। এটাই এগিয়েছে বাণীশান্তা হয়ে ঢাংমারীর দিকে। একটু বাদেই বাণীশান্তা। সারবাঁধা টিনের ঘর নদী ঘেঁষে। বাণীশান্তার বিশাল পতিতা পল্লীটা এখানেই। মংলা বন্দর চালু হবার পরেই যাত্রা শুরু করে এই পল্লী। এখানের বেশিরভাগ ঘরই টিনের তৈরি।
সময় গড়িয়ে প্রায় বিকেল বলে ঢাংমারীর আশেপাশেই কোথাও রাত্রিযাপনের ইচ্ছা। কই থাকব, সেটা অবশ্য জানি না। পথটা মাটির হলেও বেশ সমতল। এমনকী মাটির রাস্তার দু’পাশজুড়ে ঘন ঘাসও আছে। মাঝে মাঝেই ঘাসের উপর দিয়ে চালাচ্ছি। রাস্তার দুই পাশে বাবলা গাছ। আকাশমণি আর ইউক্যালিপটাসের দৌরাত্ম্য দেখতে হচ্ছে না, এতেই খুশি আমরা। যদিও বাবলা গাছগুলোর উচ্চতা কম হওয়ায় মাঝেমাঝেই কাঁটার খোঁচা থেকে বাঁচতে মাথা নত করতে হচ্ছে। গাছগুলো ছায়া দিচ্ছে না ঠিকই, কিন্তু দিচ্ছে সাহচর্য। রাস্তার সাথেই খাল। আর ঠিক ওপারেই সুন্দরবন। একেবারে হাতছোঁয়া দূরত্বে। কি এক অমোঘ আকর্ষণে চোখটা রাস্তার চেয়ে বনেই আটকে থাকছে বেশি। অল্প যা কিছু জনবসতি আছে সেটা রাস্তার ডানদিকে। বাঁদিকে গেরস্থের ব্যক্তিগত নৌকা প্রকৃতির পাকির্ং লটে পার্ক করা আছে। ভাটার সময় হওয়াতে চোখে পড়ল সুন্দরবনের প্রখ্যাত ’প্রেম কাদা’র। এই কাদায় পা ফেলার সাথে সাথেই ফুটখানেক দেবে যায়। তার উপর একবার এই কাদায় পা ডুবলে সহজে নিস্তার নেই। কচ্ছপের কামড়ের মতো ছাড়তেই চায় না। স্থানীয় অনেকেই তাই একে ডাকে ‘প্রেম কাদা’ নামে! ছোটখাট দু–চারটা ছড়ানো–ছিটানো বাড়ি চোখে পড়ছে মাঝে মাঝে। আর বাড়ি থাকলে রাস্তার বিপরীত দিকে গবাদি পশুর ছোট ঘর। শেষ বিকেলে খালের পাশ ঘেঁষা ছোট্ট একটা দোকানে চা বিরতি। এক দফা চা খেয়ে দোকানীর কাছ থেকে আরেক দফা গরম পানি চাওয়া হলো। সাথে নিয়ে আসা কফি দিয়ে আরেক দফা পানপর্ব সারা। সময়টা শেষ বিকেল বলে এইবার রাত কাটানোর ব্যাপারটাকে এড়ানো গেল না। দোকানীর কাছ থেকেই জানলাম, সামনে পুজা উপলক্ষ্যে বড় মেলা বসেছে। এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয় জায়গাটা। তড়িঘড়ি প্যাডেল ঘোরালাম। লম্বা একটা পুকুরের পাড় ঘেঁষে টিনের ছাওয়া দেওয়া সারবাঁধা দোকান। এরই নাম বুড়ির ডাবর বাজার।
দূর্গাপূজা উপলক্ষ্যে বিশাল মেলা বসেছে। তবে দেশজুড়ে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক সহিংসতার আঁচ এখানেও এসে লেগেছে। লোকজনের চোখেমুখে আতংকের ভাবটা কাটেনি। পূজোর মূল প্যান্ডেলের পাশে এত দুর্গম জায়গাতেও পুলিশ প্রহরা। চলমান ঘটনাবলীতে প্রাপ্তবয়স্কদের মুখ ভার হলেও ছোটদের দেখে মনে হচ্ছে এসব অপ্রীতিকর ঘটনা তাদের একেবারেই ছোঁয়নি। বেশ কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করে একবার ঠিক করলাম এখানের স্কুলঘরের সামনে তাঁবু খাটিয়ে রাতটা কাটিয়ে দেব। তবে লোকসমাগম এড়াতে চাই বলে পরমুহূর্তেই তা নাকচ করে দিলাম। আরো কিছুদূর এগিয়ে দেখি, কিছু না কিছু ব্যবস্থা হবেই। ততক্ষণে অবশ্য সন্ধ্যার পাতলা চাদর গাঢ় হতে শুরু করেছে। সামনেই বন বিভাগের ছোট্ট একটা স্টেশন আছে। নাম–ধাম নেই। ওখানেই যাব বলে ঠিক করলাম। থাকার ব্যবস্থা হলেও নৌকায় সাইকেল পারাপারের নড়বড়ে ব্যবস্থা দেখে তানভীর ভাই রাজি হলেন না। অতএব, চালাও পানসি মাঝদরিয়ায় থুড়ি চালাও সাইকেল মাঝরাস্তায়!
বুড়ির ডাবরের পরের রাস্তাটুকু ভয়াবহ এবড়োখেবড়ো। একে মাটির রাস্তা, তার উপর এমন দশা! নিজের পশ্চাতদেশের জন্য নিজেরই মায়া হলো! সন্ধ্যার আধারের সাথে এবার যুক্ত হলো আকাশের কালো মেঘ। বৃষ্টি যেকোন মুহুর্তেই হুড়মুড় করে নামার এন্তেজাম করতে ব্যস্ত। একা একটা বাড়ি দেখে তানভীর ভাই গেলেন উনার কারিশমা দেখাতে। তার ধারণা ছিল, কোনোভাবে উনি ওই বাড়ির উঠানে তাঁবু ফেলার বন্দোবস্ত করে ফেলবেন। বাড়ির বয়ষ্ক দাদী থাকার ব্যাপারে নিজে কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারলেন না। পুত্র আর পুত্রবধূর সংসারে সম্ভবত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা হারিয়েছেন। যারা সিদ্ধান্ত দিতে পারতো, তারা গেছে পূজো দেখতে। তবে আশ্রয় দিয়ে সাহায্য করতে না পারলেও তথ্য দিয়ে সাহায্য করলেন বৃদ্ধা। কাছেই নাকি একটা সাইক্লোন সেন্টার আছে। বৃদ্ধাকে ধন্যবাদ দিয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যেই প্রকান্ড একটা সাইক্লোন সেন্টারের সামনে আমরা। মূলত প্রাথমিক বিদ্যালয় এটা। নাম কৈলাসগঞ্জ সুন্দরবন প্রাথমিক বিদ্যালয়।
এক মাঠ সবুজ ঘাস পেরিয়ে ফটকের সামনের চাতালটা দেখে বেশ পছন্দ হয়ে গেল। চাতালের অংশে বাড়তি ছাউনি আছে। তাঁবু আর সাইকেলগুলো ছাউনির নিচেই রাখা যাবে। ততক্ষণে চাঁদটা ঢাকা পড়েছে কালো মেঘের আড়ালে। টিপটিপ বৃষ্টিও শুরু হয়ে গিয়েছে। মাথা গোঁজার ঠাঁই মিলে গেল। এবার পেটে কিছু না গুজলেই নয়। খাদ্য–পানীয়ের একটা ব্যবস্থা করতে হবে। বৃষ্টি মাথায় নিয়েই বিদ্যালয় লাগোয়া বাড়িটায় কড়া নাড়লাম। বয়ষ্ক এক ভদ্রলোক বেরিয়ে আসলে পানীয় জলের ব্যাপারে সাহায্যের কথাটাই আগে মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়ল। কথায় কথায় বেরিয়ে এল, উনিই স্কুলের প্রধান শিক্ষক! পড়বি তো পড়ে, একেবারে মালির ঘাড়েই! উনিই আগ বাড়িয়ে বললেন, ‘এই ঝড়–বৃষ্টির রাতে বাইরে থেকে কাজ নেই। আমি ফটক খুলে দিচ্ছি। আপনারা ভেতরে থাকেন। ভেতরে খাবার জলের ব্যবস্থা আছে।’ এ যেন মেঘ না চাইতেই খাবার পানিসহ বৃষ্টি! ভালো কথা, এ অঞ্চলে সবাই বৃষ্টির পানি পান করে। বর্ষাকালে সারা বছরের জন্য পানি সংরক্ষণ করা হয়। সেটাই সারা বছরজুড়ে পান করা হয়। টিউবওয়েলের পানি অসম্ভব লবণাক্ত। মুখে তোলার জো নেই।
বছর চারেকের নাতিকে নিয়ে ফটক খুলতে খুলতে প্রধান শিক্ষক টর্চের আলোয় উপরের ছাউনিতে বিশাল দুটি মৌচাক দেখালেন। আশেপাশে বাওয়াল কেউ থাকলে সহজেই এখান থেকে কয়েক কেজি মধু আহরণ করে নিতে পারত। খুব বেশি আলো না জ্বালাতে বললেন উনি। আলোতে মৌমাছি আকৃষ্ট হতে পারে। পানীয় জল আর বাথরুম দেখিয়ে দিয়ে উনি বিদায় নেয়ার আগে রাতের খাবারের ব্যাপারে আলাপ সেরে নিলাম। আমাদের অবস্থান থেকে সামনের দিকে এগোলে অদূরেই একটা বাজার আছে। আয়তনে খুব বড় না হলেও সেখানে পূজা উপলক্ষ্যে অল্প কিছু অস্থায়ী দোকান বসেছে। সেদিকেও একবার ঘুরে আসা যায়। অবশ্য সবদিক বিবেচনা করে প্রধান শিক্ষক আমাদেরকে বুড়ির ডাবর বাজারের দিকেই যেতে পরামর্শ দিলেন। পুকুরের উপরের একটা অস্থায়ী দোকানে রাতের খাবার সারা হলো কুচো চিংড়ির সাথে বরবটি আর তেলাপিয়া মাছ সহযোগে। পূজো উপলক্ষ্যে এই বাজারে বেশ কিছু মিষ্টির দোকানের দেখা পাওয়া গেল। ‘আহারের পর মিষ্টিমুখ, ভুরিভোজের পরম সুখ’ –এই দর্শনে বিশ্বাসী আমরা এক দোকানে ঢুকে দই–মিষ্টির জন্য বলে দিলাম। দইটা মুখে তোলা গেলেও মিষ্টিটা একেবারে রদ্দি মাল। বিশুদ্ধ ময়দার গোলা। দুধ জিনিসটা সম্ভবত ছোঁয়ানোই হয়নি। আমি আর সানি এক টুকরা মুখে দিয়েই আর আগ্রহ দেখালাম না। তানভীর ভাই অধুনা বাম্পার ফলন হওয়া ফুড ব্লগারদের মতো এক টুকরা মুখে ফেলে খানিকক্ষণ চোখ বন্ধ করে ফেললেন। তারপরেই বিজ্ঞের মতো জানালেন, ‘হুম, বেশ ভালো। ভেতরটা নরম!’ আমি আর সানি তৎক্ষনাৎ একটা ব্যাপারে মতৈক্যে পৌঁছালাম। মিষ্টির ব্যাপারে আজীবন আমরা তানভীর ভাইকে এড়িয়ে চলব!