(পর্ব ২)
হোটেল রুপসী রায়েন্দার ব্যবহার্য পানি নিকটস্থ বলেশ্বর নদীর পানির চেয়েও ঘোলা। ঘোলা পানিতে মাছ শিকারে অভ্যস্ত আমাদের কাছে সেসব অবশ্য তেমন বড় ব্যাপার নয়! সেই পানিতেই প্রাতঃকৃত্য সেরে বেরিয়ে পড়লাম সাতটা নাগাদ। আগের সন্ধ্যায় হাঁটতে গিয়ে যে ভ্যানের সামনে দিয়েই অতিক্রম করছিলাম, সেই ভ্যানওয়ালাই জিজ্ঞেস করছিল তাফালবাড়ি যাব কিনা। নাম শুনেই সানির এই বাজার নিয়ে বেশ আগ্রহ জন্মে গেছে। আমাদের পথ সেই তাফালবাড়ি হয়েই। রায়েন্দা থেকে পিচঢালা এই পথই আমাদের নিয়ে যাবে তাফালবাড়ি হয়ে শরণখোলা বাজারে। বাগেরহাটের এই উপজেলার নাম শরণখোলা হলেও উপজেলা সদরের বাজারের নাম রায়েন্দা। আর শরণখোলা নামক বাজারটা ভোলা নদীর লাগোয়া। একেবারে সুন্দরবন ঘেঁষে। বাজারের ওপারে নদীর অন্য পাড় থেকেই সুন্দরবন শুরু। অল্প কিছুদূর প্যাডেল করতেই কদমতলা নামক ছোট্ট একটা বাজার। এই সকালে এখনো কর্মব্যস্ততা শুরু হয়নি। লাকুড়তলার পরের বাজারটা বেশ বড়-সড়। সানির অতি আকাঙ্ক্ষিত তাফালবাড়ি বাজার! বেশকিছু স্কুল-কলেজ নিয়ে জমজমাট বাজার। অনেকগুলো এনজিওর অফিসও চোখে পড়ল বাজারের শেষদিকে। সুন্দরবন ঘেঁষা এইসব অঞ্চলে এনজিওগুলোর কার্যক্রম চোখে পড়ার মতোই। দুই পাশে ধানক্ষেতকে সাথে নিয়ে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই খুইরেখালী হয়ে শরণখোলা বাজারে।
সোজা নৌকার ঘাটে গিয়ে সাইকেল থামালাম। ভোলা নদীর ঠিক ওপারেই সুন্দরবন। এই সকালে বেশকিছু নৌকা আগামী কদিনের জন্য সুন্দরবনের নদী-খালে মাছ ধরতে যাবার প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত। স্থানীয় লোকেরা এই বনকে অবশ্য সুন্দরবন বলে না। তাদের ভাষায়, বনের নাম ‘জঙ্গল’। ভোলা নদীর পাশঘেঁষা ছোট্ট একটা দোকানে তেলছাড়া পরোটা ভাজা হচ্ছে দেখে আমরা দুইজন সামনের বারান্দামতো জায়গাটায় বসে পড়লাম। ডিম-ডালসমেত তৃপ্তি করে পরোটা খেতে খেতেই লক্ষ্য করলাম, পাশের টেবিলের কয়েকজন লোক আমাদের নিয়েই কথা বলছে। এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক খানিকটা আমতা-আমতা করেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনারা কি সাইকেল ভ্রমণে বেরিয়েছেন?’ আমরা হ্যাঁ বাচক উত্তর দিতেই বেরিয়ে পড়ল গল্পের ঝুলি। ওই ভদ্রলোক নিজের স্মৃতি হাতড়ে জানালেন, তিনি শরণখোলা থেকে মংলা হয়ে যশোর পর্যন্ত সাইকেলে গিয়েছিলেন যৌবনে। তখন অবশ্য পাকা রাস্তা ছিল না। সাইকেলে নিজে যতটা না চেপেছেন, কাদার কারণে তারচেয়ে বেশি সময় সাইকেলকে নিজের কাঁধে চাপাতে হয়েছে। উনি হাপিত্যেশ করে বললেন, ‘যখন প্রয়োজন ছিল, সাইকেলে দূর-দুরান্তে গিয়েছি। তখন রাস্তা ছিল না। এখন রাস্তা হয়েছে। কিন্তু প্রয়োজন ফুরিয়েছে।’
আরো খানিকক্ষণ গল্প করে আবার প্যাডেল ঘোরালাম। এবারের পথটুকু মাটির রাস্তা ধরে। রাস্তার বামেই নদীর ওপারে সুন্দরবন। আহা! এই লোভেই তো আসা। যাত্রাপথের বিশাল অংশজুড়েই হাতের বামে সবসময় যাতে বাদাবনটা থাকে, পরিকল্পনাটা এভাবেই করা। দু’পাশে আকাশমণির সারি। মাঝে মাঝে রাস্তার একদিকেই দু’তিন সারি করে লাগানো। এখনো গড়নে ছোট বলে দৃষ্টিসীমায় খুব একটা বাধা হতে পারছে না যদিও। রাস্তায় হঠাৎ হঠাৎ ধূলো উড়িয়ে উদয় হচ্ছে স্থানীয় ‘পাঠাও’ সার্ভিসের মোটরসাইকেলগুলো। এছাড়া লোকজন খুব একটা নেই। সোনাতলা পার হয়ে পড়ল রাজাপুর। মাঝে মাঝেই উঁকি দিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে কিছু পাকা দালান। মূলত এগুলো প্রাইমারি স্কুলই। তবে এই অঞ্চলে এর অন্য ব্যবহার আছে। দুর্যোগের সময়ে এরা ব্যবহৃত হয় এ অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর মাথা গোঁজার ঠাঁই তথা সাইক্লোন সেন্টার হিসেবে।
বটতলা নামক বাজারে একটা বটগাছকে ঘিরে বেশকিছু ছাপড়া দোকান। জায়গাটা দেখে লোভ হওয়াতেই ছোট্ট একটা চা বিরতি নিয়ে নিলাম। রঙ-চায়ের জন্য বলতেই টি ব্যাগ সমেত চা ধরিয়ে দিল। এই ব্যাপারটা আমার মোটেও পছন্দ না। চায়ের দোকানে গিয়ে টি ব্যাগের চা পান করতে কেন জানি আমার প্রচন্ড বিরক্তির উদ্রেক হয়। চায়ে চুমুক দিতে দিতেই লক্ষ্য করলাম, আমাদেরকে ঘিরে হালকা একটা ভিড়। আমাদের চা পানই তারা বেশ আগ্রহ নিয়ে দেখছে। একজন এর মধ্যে আমাদের আদ্যোপান্ত জিজ্ঞেস করতে শুরু করে দিল। ফকিরহাট থেকে সাইকেল চালিয়ে এসেছি শুনে তার চোখ কপালে। ভিড়ের মধ্যেই ছিল একদল কিশোর। পাশের পাড়ার সাথে ফুটবল ম্যাচের অপেক্ষায় ছিল তারা। বাজিতে ম্যাচ খেলা হবে। ঠিক কি কারণে জানি না, নাম-ঠিকুজি জিজ্ঞেস করা সেই তরুণ ফুটবল খেলার অপেক্ষায় থাকা কিশোরদের সাথে আমাদের নিয়ে ফুটবল খেলায় বাজি ধরে বসল! এমনকি আমাদের দুইজনের বিপক্ষে ওদের চারজন খেলার মতো অতি ভয়ংকর চ্যালেঞ্জ দিতেও কার্পণ্য করল না। আমি আর সানি তখন সসম্মানে ইজ্জত নিয়ে ওই জায়গা থেকে কেটে পড়তে পারলেই বাঁচি আর কি! ওই তরুণের আমাদের নিয়ে অতি উৎসাহের কারণ সম্ভবত ফকিরহাট থেকে সাইকেল চালিয়ে এদ্দুর আসা!
আজ সকাল থেকে নেভিগেশনের ক্ষেত্রে আমরা বেশ ঝামেলায় পড়ে গেছি। দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ফলস্বরুপ ইন্টারনেট সার্ভিস বন্ধ। মোবাইল ডাটা দিয়ে রাস্তা খোঁজার উপায়ের দরজায় আপাতত খিল আঁটা। গুগল ম্যাপ পূর্ববর্তী যুগের মতো লোকজনই ভরসা। এর মাঝেই তীব্র গরমে হাঁসফাঁস করতে করতে কোক বিরতি নিলাম এক জায়গায়। অথচ ট্রিপে বেরুবার আগে রাস্তার ধারের ছোট্টসব টংয়ে চা বিরতির আগ্রহ ছিল। গরমে চায়ের পরিবর্তে কোকই প্রার্থিত বস্তু হিসেবে দাঁড়িয়ে গেল। যদিও জানি, তীব্র গরমে এইসব কোমল পানীয় বেশ ক্ষতিকর। শরীরের কোষে পানি যোগ করার বদলে, এরা কোষ থেকে পানি করে নিয়ে আসে। এরকমই এক কোক বিরতিতে আবিষ্কার করলাম, আমরা কিছুটা পথ ভুল করেছি। হাতের বামে এক জায়গায় মোড় নেয়ার কথা ছিল। সেটা না করে আমরা সোজা এগিয়ে এসেছি। স্থানীয় এক লোক মোড় নেয়ার জায়গাটা ভালোমতো চিনিয়ে দিল। এমনকি কাঠের সিঁড়ির ল্যান্ডমার্কসহ বলে দিল। ওই ভদ্রলোকের বাতলিয়ে দেওয়া রাস্তায় গিয়েই খালের ওপরে সেই সিঁড়ির দেখা পেয়ে গেলাম। অল্প এগিয়েই ধানসাগর ফরেস্ট স্টেশন। সুন্দরবনের বাকিসব ফরেস্ট স্টেশনের মতোই বেশ সাজানো-গোছানো।
ধানসাগর পেরোতেই হাতের ডানে আক্ষরিক অর্থেই ধানগাছের সাগর প্রচুর ধান চাষ হয়েছে এদিকটায়। আর হাতের বামে সুন্দরবনের খাল। মাটির এই রাস্তার স্থানে স্থানে অবশ্য বেশ কাদা। কয়েক জায়গায় নেমে সাইকেল ঠেলতেও হল। দুই পাশে ঘন গাছের ছাউনি ভেদ করে খুব একটা সূর্যর আলো এই কাঁচা রাস্তায় পৌঁছায় না। সুন্দরবনের গা ঘেঁষে চলতে চলতেই একসময় সুন্দরবন নামক বাজারে। এইখান থেকে মাটির রাস্তা ছেড়ে পিচের রাস্তা মিলল। কিছুদূর বেশ মসৃণ। গুলিশাখালী ফরেস্ট অফিসের কাছ থেকে রাস্তা আবার খারাপ। এটা মূলত পিচের রাস্তাই ছিল। এখন উপরের পিচ উঠে গিয়ে খোয়া বেরিয়ে গেছে। দেখে মনে হয়, কেউ বেদম পিটিয়ে এর ছাল-চামড়া উঠিয়ে নিয়েছে! বাংলাদেশের ঠিকাদারির এক উজ্জ্বল উদাহরণ! রাস্তার ছাল-চামড়ায় সাইকেলের প্যাডল ঘষা খেয়ে খেয়ে নিজের পশ্চাতদেশের ছাল-চামড়া খসে পড়ার দশা। এই অবস্থাতেই পৌঁছালাম জিউধরা বাজারে। গরম জিলাপী দেখে তীব্র গরমেও লোভ সামলানো গেল না। পেটে নতুন কিছু প্যাঁচ যোগ করার জন্য জিলাপীর ন্যায় ভালো খাবার আর কিছুই হতে পারে না! পাশের টেবিলে বসা এক পিচ্চির সাথে জিলাপী মুখে পুরতে পুরতেই বাতচিত চলছিল। আমাদের পরের গন্তব্য মংলা শুনে সে বেশ অবাক হয়ে বলল, ‘আমি এই জীবনে সাইকেল চালায়ে মংলায় যেতে পারব না।’ কথায় কথায় বেরিয়ে এল, সে গতকালই মংলা থেকে ফিরেছে। ফেরার মাধ্যম হাঁটা! তার দিকে অবিশ্বাস্য একটা দৃষ্টি হেনে আবার সাইকেলে।
খানিক বাদেই রাস্তার বেহাল দশা দেখে জিলাপীখেকো পিচ্চির কথা মনে পড়ে গেল। এই এবড়োখেবড়ো রাস্তায় সাইকেল চালানোর চেয়ে হাঁটা অনেকগুণে সহজতর। পিচ্চি বিন্দুমাত্র মিথ্যা বলেনি। ভয়ানক রাস্তা ধরে মালগাজী বাজার। এইখান থেকে আবার পিচ রাস্তা। ভালো রাস্তা পেয়ে ধুমসে চালিয়ে মংলা। আমাদের আজ থেকে আরেকজন সঙ্গী বাড়ার কথা। তানভীর ভাই এখান থেকেই বাকি কদিনের জন্য পথের সাথী হবেন। উনার জন্য অপেক্ষা করার ফাঁকেই ভালো একটা পুকুর দেখে গোসলটা সেরে নেয়ার ধান্দায় এদিক-ওদিক উঁকি দিতে লাগলাম। পুকুর না মিললেও মিলে গেল রসালো জাম্বুরা। এবড়োখেবড়ো রাস্তা শরীর থেকে রস নামক পদার্থটি কিছুটা হলেও শুষে নিয়েছে। রসালো জাম্বুরা দিয়ে শরীরের রস প্রতিস্থাপন করার ভাবনা থেকেই কলেজের বিপরীতের ছাপড়া দোকানটায় ঢুকে পড়লাম। জাম্বুরার খোসা ছাড়াতে ছাড়াতেই আলোচনা করছিলাম, হালকা লবণ, সরিষার তেল আর চিলি ফ্লেঙ হলে ব্যাপারটা জমে যেত। কথার ফাঁকেই দোকানের মালকিন নিচের তাক থেকে একে একে আমাদের উচ্চারিত সব জিনিসই বের করে দিলেন। শেষে কাসুন্দির বোতল দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ওখান থেকেও কিছু চাই কিনা! আনন্দে চোখে আর জিবে দুই জায়গাতেই পানি চলে এলো!
গুলিশাখালী ফরেস্ট অফিসের কাছ থেকে রাস্তা আবার খারাপ। এটা মূলত পিচের রাস্তাই ছিল। এখন উপরের পিচ উঠে গিয়ে খোয়া বেরিয়ে গেছে। দেখে মনে হয়, কেউ বেদম পিটিয়ে এর ছাল-চামড়া উঠিয়ে নিয়েছে! বাংলাদেশের ঠিকাদারির এক উজ্জ্বল উদাহরণ!