বিগত সরকার চট্টগ্রামের উন্নয়নে ফ্লাইওভার, টানেল, দোহাজারি থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন সম্প্রসারণ, মাতারবাড়ি এলএনজি টার্মিনাল ইত্যাদি বেশ কিছু মেগা প্রকল্পের কাজ করেছে। ফ্লাইওভার, টানেল, কক্সবাজার রেললাইন, মাতারবাড়ি এলএনজি টার্মিনাল হয়ে গেছে; গভীর সমুদ্র বন্দর চলমান। কিন্তু তিনটি প্রধান সমস্যার নিরসন করতে পারেনি আওয়ামী লীগ সরকার। এই সমস্যাগুলি হচ্ছে–কর্ণফুলী নদীর ওপর কালুরঘাট রেলওয়ে সেতুর পাশে বোয়ালখালীর জনগণের যাতায়াতের জন্য আর একটি সেতু নির্মাণ, বন্দরে বে টার্মিনাল নির্মাণ এবং রেলপথে ঢাকার সাথে চট্টগ্রামের দূরত্ব কমিয়ে আনার জন্য লাকসাম–নারায়ণগঞ্জ কর্ড লাইন নির্মাণ।
কর্ণফুলীতে তৃতীয় সেতু নির্মাণের জন্য বোয়ালখালীর জনগণ দীর্ঘদিন আন্দোলন–সংগ্রাম করেছেন। বোয়ালখালীর আওয়ামী লীগ দলীয় দু’জন প্রাক্তন এমপি মঈনুদ্দিন খান বাদল ও মোছলেমউদ্দিন আহমদ সংসদে ও সংসদের বাইরে উক্ত নির্মাণের সপক্ষে বিভিন্ন সময়ে প্রদত্ত তাঁদের বক্তব্যে সেতু নির্মাণের যৌক্তিকতা প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছেন। সেতু নির্মাণের জন্য উদ্যোগ–আয়োজন দেখার পূর্বেই দু’এমপিই মৃত্যুমুখে পতিত হয়ে চলে গেছেন জীবনের পরপারে।
বঙ্গোপসাগরের মুখ থেকে কর্ণফুলী নদী এঁকে বেঁকে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের মধ্য দিয়ে উৎপত্তিস্থল ভারতের মিজোরাম রাজ্যে চলে গেছে। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়ের কবল থেকে আত্মরক্ষার জন্য সেকালের সরের জাহাজগুলি কর্ণফুলীতে ঢূকে আশ্রয় নিতে নিতে প্রাকৃতিক পোতাশ্রয়ের জন্ম হয়েছে এবং তা থেকেই পরবর্তীকালে চট্টগ্রাম বন্দর নির্মিত হয়েছে। কিন্তু বড় বড় মাদার ট্যাংকার অগভীরতার জন্য কর্ণফুলীতে ঢুকতে পারে না। ফলে মাদার ট্যাংকারগুলি অনেক দূরে গভীর সমুদ্রে নোঙর ফেলে বসে থাকে আর বন্দর থেকে ছোট ছোট লাইটারেজ জাহাজ গিয়ে মাল খালাস করে তীরে এনে নামিয়ে দেয়। মাদার ট্যাংকারগুলি যাতে বন্দরের কাছাকাছি এসে সাগরে নোঙর করে মাল খালাস করতে পারে সে জন্য বে টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বে টার্মিনাল নিয়ে অনেক কথাবার্তা হলেও নির্মাণ অর্থাৎ আসল কাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি। ঠিক একথাগুলিরই প্রতিধ্বনি করে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. মঈনুল ইসলাম কোন পত্রিকায় তাঁর কলামে বলেছেন, চট্টগ্রাম বন্দর এখন লাইটারেজ বন্দরে পরিণত হয়েছে। তিনি বাড়িয়ে বা বন্দরকে ছোট করে কিছু বলেননি। হক কথাই বলেছেন।
এখন চট্টগ্রামের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের ক্ষমতায় আছে। অতীতে পটিয়ার বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম এবং হাটহাজারীর জেনারেল হারুন অর রশিদ সেনাপ্রধান হওয়া ছাড়া আর কোনো চট্টল–কুল–উদ্ভব চট্টগ্রামী রাষ্ট্রপ্রধান বা দেশের প্রধানমন্ত্রী কখনো হননি। এই প্রথম ড. ইউনূস হলেন। তাঁর কাছেই দুঃখের ‘বারমাস্যা’ নিবেদন করছি।
নারায়ণগঞ্জ–লাকসাম কর্ড লাইন একটি প্রস্তাবিত ৯০ কিলোমিটার দীর্ঘ ডুয়েল গেজ রেলপথ। এটি বাংলাদেশ সরকারের রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অধীনে নির্মিত হবে। লাইনটি নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ ও কুমিল্লা জেলার মধ্য দিয়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামকে সরাসরি সংযুক্ত করবে। ঢাকা স্টেট রেলওয়ে ১৮৮৪–১৮৮৫ খ্রি. নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা হয়ে ময়মনসিংহ পর্যন্ত ১৪৪ কিলোমিটার (৮৯ মাইল) দীর্ঘ মিটারগেজ রেলপথ চালু করে। এই লাইনটি মূলত পাট সংগ্রহ ও কলকাতায় প্রেরণের জন্য করা হয়েছিল। চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে একটি রেলপথ সংযোগের জন্য আসামের চা বাগানকারীদের দাবির প্রতিক্রিয়ায়, আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে ১৮৯১ খ্রি. বাংলার পূর্ব দিকে একটি রেলপথ নির্মাণ শুরু করে। এ ১৫০ –কিলোমিটার দীর্ঘ (৯৩ মাইল) চট্টগ্রাম এবং কুমিল্লার মধ্যে ট্র্যাকটি ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছিল। মেঘনার পূর্ব তীরে চলমান এই লাইনটিকে নদীর পশ্চিম তীরে, টঙ্গী–আখাউড়ার রেল ব্যবস্থার সাথে সংযুক্ত করার প্রচেষ্টায়। লাইনটি ১৯১০ এবং ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এসেছিল।
ঢাকা থেকে ট্রেনে চট্টগ্রাম কিংবা চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা যেতে হলে নারায়ণগঞ্জ–বাহাদুরাবাদ ঘাট, টঙ্গী–ভৈরব–আখাউড়া এবং আখাউড়া–লাকসাম–চট্টগ্রাম রেললাইন দিয়ে যেতে হয়, তাই রেলপথে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের দূরত্ব ৩২৪ কিমি। বিদ্যমান রুটে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যেতে কমপক্ষে ৬ ঘণ্টা সময় লাগে। তাই এই পথের দূরত্ব কমাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার দুই বছর আগে একটি কর্ড লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। পরিকল্পনা অনুসারে পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী ঢাকা থেকে লাকসাম পর্যন্ত পরিকল্পিত কর্ড লাইন নির্মাণ করা হলে রেলপথে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের দূরত্ব কমে ২১৪ কিলোমিটার হয়ে যাবে বলে। পাকিস্তান সরকারের বাজেট ছিল রুপিতে। প্রস্তাবিত কর্ড লাইন নির্মাণের জন্য ২৬ কোটি রূপী প্রয়োজন হতো। (২০২১ খ্রি. ১,৩২৩ কোটি রুপি বা US ৳৪.৬ মিলিয়নের সমতুল্য)। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়াসহ অন্যান্য সমস্যার কারণে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।
দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রায় পাঁচ বছর পরে কর্ড লাইনের একটি ট্রাফিক জরিপ প্রস্তুত করা হয়েছিল। সেই জরিপে কর্ড লাইনের জন্য দুটি রুট প্রস্তাব করা হয়েছিল। প্রথম প্রস্তাবিত রুটের দৈর্ঘ্য ছিল ১১০ কিলোমিটার এবং দ্বিতীয় রুটের দৈর্ঘ্য ৯০ কিলোমিটার। বাংলাদেশ সরকার এর নির্মাণের জন্য বাজেট করেছে ৳২৭.৬৩৮ কোটি টাকা। সরকার ১৯৮০–এর দশকে কর্ড লাইনের জন্য একটি সম্ভাব্যতা সমীক্ষা পরিচালনা করে, কিন্তু বাংলাদেশে ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর প্রকল্পটি স্থগিত হয়ে যায়। তারপর প্রথম শেখ হাসিনা সরকারের সময় গঠিত রেলওয়ে পুনর্গঠন সংস্কার প্রণয়ন কমিটি ১৯৯৮–১৯৯৯ আর্থিক বছরে কর্ড লাইনের জন্য ৳ ৯০০ কোটি (২০২৩ সালে ৳ 43 বিলিয়ন বা US$370 মিলিয়নের সমতুল্য) বরাদ্দের সুপারিশ করেছিল। ২০০৬ খ্রিস্টাব্দের দ্বিতীয়বার খালেদা জিয়ার মন্ত্রিত্বের সময়, সরকার SM AMEC ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট লিমিটেডকে কর্ড লাইনের জন্য আরেকটি জরিপ করার জন্য কমিশন দেয়। সেই সমীক্ষায়, এর বাজেট ছিল ৳25,800 (২০২৩ সালে ৳82,890 এর সমতুল্য)।
২০১৫ খ্রিস্টাব্দে, দেশের তৎকালীন রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক কর্ড লাইনের জন্য পূর্ব নির্ধারিত রুটের পরিবর্তে নারায়ণগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশন থেকে কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি হয়ে কুমিল্লা রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত একটি নতুন লাইন নির্মাণের ঘোষণা দেন, যা নির্ধারিত ছিল। পরের বছর শুরু হওয়ার কথা থাকলেও শুরু হয়নি। ২০১৮ সালে, তৃতীয় হাসিনা সরকারের রেল মন্ত্রণালয় কর্ড লাইনের প্রস্তাবিত রুটে ঢাকা–চট্টগ্রাম হাই–স্পিড রেলপথ নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করে, যা পরিবহন বিশেষজ্ঞদের দ্বারা সমালোচিত হয়েছিল। কিন্তু অত্যধিক ব্যয় বিবেচনা করে, প্রকল্পটি স্থগিত করা হয়েছিল এবং কর্ড লাইনের উপর জোর দিয়ে একটি নতুন সম্ভাব্যতা অধ্যয়ন শুরু করা হয়েছিল। ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১ তারিখে, তৎকালীন রেলমন্ত্রী মোঃ নুরুল ইসলাম সুজন কর্ড লাইন নির্মাণের জন্য একটি নতুন পরিকল্পনার প্রতিশ্রুতি দেন, যা ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের রেলপথের দূরত্ব ৭০ কিলোমিটার কমিয়ে দেবে। ১১ জানুয়ারি, ২০২৩–এ, পাবলিক প্রকিউরমেন্ট সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি কর্ড লাইন নির্মাণ প্রকল্পের একটি সম্ভাব্যতা অধ্যয়ন এবং বিশদ নকশা করার জন্য রেলপথ মন্ত্রণালয়কে অনুমতি দেয়। কিন্তু ওদিকে পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত প্রকল্প দুটির বিশদ নকশা প্রণয়নসহ সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষার কার্যক্রম স্থগিত রাখতে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে সুবিধাদি প্রস্তুতিমূলক কারিগরি সহায়তা (আরসিআইপিএফ) প্রকল্পের পরিচালককে গত ১২ মার্চ চিঠি দেয় রেলপথ মন্ত্রণালয়। এ প্রকল্পের অধীনে ১১টি উপপ্রকল্পের সমীক্ষা করছিল রেল।
১ নম্বর উপপ্রকল্পে কর্ড লাইনের নকশা ও বিস্তারিত সমীক্ষা করা হচ্ছিল। ৬ নম্বর উপপ্রকল্পের অধীনে পদ্মায় হার্ডিঞ্জ ব্রিজের সমান্তরালে রেল সেতু নির্মাণে নকশা ও সমীক্ষা চলছিল। রেল সূত্র জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশে উপপ্রকল্প দুটির কার্যক্রম স্থগিতের চিঠি দেওয়া হয়। ব্যয় সংকোচন নীতি এবং ভূরাজনীতির কারণে সরকার প্রকল্প দুটি থেকে পিছিয়ে আসে বলে রেল কর্মকর্তাদের ধারণা। তবে তাদের ভাষ্য, রেলকে লাভজনক করতে ‘কর্ড লাইন’ নির্মাণ জরুরি। চলমান যে কোনো প্রকল্পের চেয়ে কর্ড লাইন গুরুত্বপূর্ণ।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণে ২৩৫ কোটি টাকা ব্যয়ে আরসিআইপিএফ প্রকল্পের অধীনে ১১টি উপপ্রকল্পের বিশদ নকশা ও সমীক্ষা করা হচ্ছে। প্রকল্পটি রেলের চলমান তিনটি কারিগরি সহায়তা প্রকল্পের একটি। এর আগে বাস্তবায়ন করা কারিগরি সহায়তা প্রকল্প ঢাকা–চট্টগ্রাম–কক্সবাজার রেলপথ উন্নয়ন প্রস্তুতির অধীনে কর্ড লাইনে বিশদ নকশা ও সমীক্ষা করার পরিকল্পনা ছিল। পরে তা আরসিআইপিএফ প্রকল্পে স্থানান্তর করা হয়।
এদিকে, আগামী অক্টোবর মাসেই কালুরঘাট রেল কাম সড়ক সেতু একনেকে অনুমোদন হবে বলে জানিয়েছেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুল বাকী। অনুমোদন হয়ে গেলে কিছু অফিসিয়াল কাজ সম্পন্ন করে সরকার টেন্ডার প্রক্রিয়াতে যাবে। এরপর সেতুর কাজ শুরু করতে হবে। প্রকল্প মেয়াদকাল ২০৩০ সালের জুন মাস পর্যন্ত বলে জানান রেল সচিব।
তিনি বলেন, কালুরঘাট রেলকাম সড়ক সেতুর বিষয়ে কোরিয়ার সাথে আমাদের নতুন চুক্তি হয়েছে। প্রকল্পটি অনুমোদনের চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। এ সরকার আসার পরে একটি একনেক সভা হয়েছে। ওই সভায় প্রকল্পটি অনুমোদন হয়নি। আমরা আশা করি পরবর্তী একনেকে এটি অনুমোদন হবে। সেতুটি বাস্তবায়ন হয়ে গেলে বোয়ালখালী তথা দক্ষিণ চট্টগ্রামের দুঃখ অনেকটা কেটে যাবে। শুধু বোয়ালখালীবাসী নয় এটির সেবা সারাদেশই পাবে এবং এ অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থায় ব্যাপক একটি পরিবর্তন আসবে। আমরা আশা করছি, অচিরেই এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন হবে।
লেখক : সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা, সংস্কৃতি সংগঠক।