দুঃখ উৎপাদনের প্রক্সি

রুদালী

কানিজ ফাতেমা | শনিবার , ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ at ১০:৩৩ পূর্বাহ্ণ

“আমাদের রাজ পরিবারের কেউ মারা গেলে তো কান্নার জন্য একজন লোক চাই, তা-ই না? নারীদের মস্তিষ্ক বিধাতা বানিয়েছেনই এমন করে, যাতে তারা দুঃখ-কষ্টের অনুভূতিগুলো ভালো করে বুঝতে পারে। তাদের মন খুবই নরম। অন্দরমহলের মেয়েদের তো আমরা বাড়ির বাইরে বের হতে দিতে পারি না। পরপুরুষের সামনে গিয়ে তারা কাঁদলে আমাদের পরিবারের মাথা নিচু হয়ে যাবে। স্বামী মরুক আর বাবা মরুক, আগে তাদেরকে নিজেদের মর্যাদাটা বুঝতে হবে। কাজেই তাদের হয়ে কান্নার কাজটা করে দেয় নিচু জাতের মহিলারা, রুদালিরা। রুদালিদের কান্নায় পুরো গ্রাম বুঝতে পারে তাদের কত বড় ক্ষতি হয়ে গেছে। সবার দুঃখের প্রতিনিধিত্ব করতেই ডেকে আনা হয় রুদালিদের।”
কলকাতার সাংবাদিক এবং লেখক নিধি দুজ্ঞার কুন্দালিয়া তার ‘দ্য লস্ট জেনারেশন’, ক্রনিক্লিং ইন্ডিয়া’স ডায়িং প্রফেশন্স’ বইটিতে প্রায় বিলুপ্ত কিছু প্রথা বা পেশার কথা উল্লেখ করেছেন। অবধারিতভাবে সেখানে বাদ যায়নি রুদালিদের কথাও। রাজস্থানের এক তথাকথিত উঁচু শ্রেণির পুরুষ নিধিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে উপরের কথাগুলো বলেন।
‘রুদালী’ শব্দের অর্থ হচ্ছে যাঁরা কাঁদেন। এদের আবির্ভাব হয়েছিল মোটামুটি এক শতক আগে অবিভক্ত ভারতের উত্তর-পশ্চিমাংশে বিশেষ করে রাজস্থানে। সেকালের জমিদারদের আত্মীয়-স্বজন মারা গেলে, তিনি যে মারা গেছেন সেটা ঢাক-ঢোল পিটিয়ে গ্রামের সমস্ত অধিবাসীদের জানাতে আর সেই ঠাকুর কত মহান সেটা দেখাতেই ডেকে আনা হতো এই রুদালীদের। এরা এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে বুক চাপড়ে, আর্তনাদ করে এমন আবহ তৈরি করবেন যে গ্রামের লোকেরা তো ছুটে আসবেনই বরং তাঁদের বুক চাপড়ানো দেখে তাঁরা নিজেরাও একটু অশ্রুজল নিক্ষেপ করবেন, ব্যবস্থা ছিল মোটামুটি এইরকম।
যদি প্রশ্ন করা হয়, কেন এরাই কাঁদবেন কেন! যে মারা গেল তার কি কেউ নেই? এটাও আরেক ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। জমিদার বংশের স্ত্রী পরপুরুষের সামনে একজন ঠাকুর মারা যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করবেন এতে জমিদার বংশের অমর্যাদা হতো। যদিও বা চোখ থেকে জল বেরিয়েও যায় তাও তাঁদের ঘোমটার আড়ালে ঘরের মধ্যে বসেই ওই লাশ দেখে কাঁদতে হতো। তাই এই রুদালি বন্দোবস্ত।
তবে এঁরা যে নিজের ইচ্ছায় কাঁদতেন তা একেবারেই নয়, পেটের দায় সমাজের এক নীচু অবহেলিত জাতের মানুষরাই পরবর্তীকালে ‘রুদালী’ -নামক সমপ্রদায় তৈরি হয়। এদের পোশাক বলতে গেলে সবটাই কালো কাপড়ে ঢাকা, কারণ কালো নাকি যমের প্রিয় রং। এরা যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বুক চাপড়ে, মাটিতে গড়াগড়ি খেয়ে, শ্মশানে আছড়ে পড়ে, কান্নাকাটি করে খুব রোজকার করতেন তা না। এই বছর তিরিশ আগেও তাঁদের যা রোজগার ছিল তা নগণ্য মাত্র। যে যত ভালো কাঁদার পারফরম্যান্স দেখাবেন তাঁদের তত পুরস্কার দেওয়া হবে। আর কী ছিল সেই পুরস্কার না পাঁচ-ছয় রুপি! একটু সদয় জমিদার হলে বড়জোর কাপড়, দুটো বাঁশি রুটি আর পচা পেঁয়াজ জুটতো। শোনা যায় তাঁদের কাঁদার মাঝে বিরতি দেওয়া হতো। সেই সময় এরা কিছু পেলে খেতেন নাহলে…..। কিছু কিছু জমিদার বাড়িতে মৃত্যুর কাজ বারো দিন ধরে চলত। তখন এঁদের টানা বারো দিন কেঁদে যেতে হতো, নদীর ধারার মতো জল বয়ে যাচ্ছে তবুও এঁদের চোখের জল মোছার অনুমতি নেই, কেন? কারণ এঁদের এই কান্নাই প্রমাণ করবে যে সেই ব্যক্তিটি কতই না মহান ছিলেন।
মৃত ব্যক্তির বাড়িতে গিয়ে শোকের মাতম করা এই নারীরা সাধারণভাবে পরিচিত ‘রুদালি’ নামে। তাদেরকে বলা হয় ‘প্রফেশনাল মৌনার’ বা পেশাদার বিলাপকারী। বিলাপ করেই জীবিকা নির্বাহ করে তারা। পরনে থাকে কালো পোশাক, যমের পছন্দের রঙ নাকি কালো। তাই মৃত্যুদূতকে খুশি করতে তার পছন্দের সাজেই নিজেদের সজ্জিত করে তারা। সমাজের একেবারে নিচু জাত থেকে তুলে আনা এই রুদালিদের বেশ কিছু সমাজে বিয়ে করারও নিয়ম নেই। নিজের পরিবারের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লে লোকের মৃত্যুতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাঁদবে কে? চেনা নেই, জানা নেই, রক্তের সম্পর্ক নেই; কেবল অর্থের বিনিময়ে মানুষের বাড়িতে গিয়ে আক্ষরিক অর্থে লোক দেখিয়ে কাঁদার জন্যই যেন জন্ম হয়েছে তাদের।
রুদালিদের এই পেশা আমাদের কাছে অর্থহীন মনে হতেই পারে, কিন্তু রাজস্থানের পশ্চাৎপদ কিছু জনগোষ্ঠীর কাছে এটিই স্বাভাবিক, নির্মম সত্য। তাদের ঐতিহ্যের সাথে মিশে আছে রুদালিদের অস্তিত্ব। সমাজের উচ্চশ্রেণির নারীরা অর্থাৎ জমিদার বা ঠাকুর কন্যারা, বাড়ির বউরা বাইরের লোকের সামনে কাঁদবে বা নিজেদের আবেগ প্রকাশ করবে, সে আবার কেমন কথা? কাজেই তারা হাবেলির অন্দরমহলে বন্দী থেকে, লম্বা ঘোমটার আড়ালে দু’ফোঁটা চোখের পানি ফেলুক আর না ফেলুক তাতে মৃত ব্যক্তির কিছু আসে যায় না। কিন্তু সমাজের সামনে নিজের প্রভাব প্রতিপত্তি জাহির করতে গেলেও তো মরার সময় কান্নাকাটি করার জন্য কয়েকজন লোক লাগে। বড়লোকের সেই চাহিদা থেকে জন্ম নেয়া একটি সমাজের নাম ‘রুদালি’।
নিজেদের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে বিসর্জন দিয়ে, কেবলমাত্র চাহিদামাফিক চোখের পানি ঝরানো এই নারীদের সমাজে কিন্তু তেমন কোনো দাম নেই। অনেক সময়, অন্নদাতার জবরদস্তিতে অবৈধ সন্তানের জন্ম দিতে হয় তাদের। তাই হাবেলিতে প্রবেশ করা রুদালিদের দিকে বাঁকা চোখে তাকাতে কার্পণ্যবোধ করে না সে সমাজ। আর সেই সন্তান যদি হয় মেয়ে, তাহলে বন্ধ হয়ে যায় তাদের সামান্য আয়-রোজগারের পথটুকুও। কেননা রাজস্থানের মানুষের অন্ধবিশ্বাস অনুযায়ী, মেয়ে সন্তানের জন্ম দেয়া রুদালি পরিবার আর সমাজের জন্য অভিশাপ বয়ে আনে। তাই রুদালিদের মধ্যে বেশ বিখ্যাত একটি প্রবচন প্রচলিত আছে-
‘পান্দো ভালো না কসকো, বেটি ভালি নায়েক’
কথাটির বাংলা করলে দাঁড়াবে- খালি পায়ে মাইলের পর মাইল হেঁটে যেতে বললেও কষ্ট পাব না, কিন্তু একটি মেয়েসন্তানও যেন ঘরে না আসে। পুত্র সন্তানের জন্ম দিলেও সেই সন্তান কখনো বাবার নাম ব্যবহার করতে পারে না। কাজেই সমাজের কাছে তারা অচ্ছুত বলেই পরিচিতি লাভ করে। জোরপূর্বক প্রান্তিক করে রাখা এই সমপ্রদায় তাদের যাবতীয় ফরিয়াদ জানায় ‘ভেরুজি’ ভগবানের কাছে। অবশ্য কামপ্রবণ কুমার হয়ে অসংখ্য নারীর ক্ষতি করেছেন ভেরুজি, এই কাহিনী রাজস্থানের প্রায় সবার মুখে মুখেই প্রচলিত আছে। তার শিকারও ছিল সমাজের নিচু জাতের নারীরা। উঁচু জাতের প্রতিনিধিত্বকারী এই দেবতাকে তাই রুদালিরা নিজেদের ভাগ্য বলেই মেনে নিয়েছে।
কখনো কখনো রুদালিদের টানা বারোদিনও কাঁদতে হয়। যত দীর্ঘদিনব্যাপী শোকের মাতম চলবে, ততই লোকজন ঐ পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতা নিয়ে কানাঘুষা করবে। পারফরম্যান্স ভালো করতে তাই পেশাদার রুদালিরা নিজেদের জীবনের দুঃখ-কষ্টের কথা মনে করার চেষ্টা করে। সবসময় কিন্তু চাইলেই চোখের জল পড়ে না, তখন শুধু মুখের বিলাপই ভরসা। তবে যারা পুরোপুরি পেশাদার, তাদের নিজস্ব কিছু কৌশল আছে চোখে পানি আনার। কেউ কেউ থুতু লাগিয়ে মুখে জলের রেখা তৈরি করেন, কেউবা এক ধরনের গাছের শেকড় ব্যবহার করেন যা অনেকটা গ্লিসারিনের মতো কাজ করে। কাজলের মতো এক ধরনের কালিও পাওয়া যায়, যা চোখে লাগানোর সাথে সাথে তীব্র জ্বলুনি শুরু হয় আর চোখের জল পড়তে থাকে, এটি গ্লিসারিনের মতো কাজ করে।
হিন্দু সমাজের জাত বিদ্বেষের অভিশাপকে আঘাত করে মহাশ্বেতা দেবী লিখেছিলেন ‘রুদালি’ গল্পটি। এ গল্পটিকে সেলুলয়েডে রূপ দেন কল্পনা লাজমি। ডিম্পল কাবাডিয়া অভিনীত ‘রুদালি’ একটি অসাধারণ সিনেমা। রাজস্থানের পটভূমিতে গড়ে উঠেছে এর কাহিনী। এই ছবির একটি অসামান্য দিক হলো, শত বঞ্চনা ও যন্ত্রণা সত্ত্বেও প্রান্তিক অবস্থানের নারীসঞ্চারির (ডিম্পল) চোখে কোন অশ্রু নেই। কেন্দ্রীয় চরিত্রে মানবিক এক অভিনয় দিয়ে সেবার ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতেছিলেন অভিনেত্রী ডিম্পল কাপাডিয়া।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাংলা বাঁচাও
পরবর্তী নিবন্ধ‘ভাষা আন্দোলন প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের শিক্ষা দেয়’