দুঃখের ছায়া সন্তানের ওপর পড়তে না দেওয়ার নাম বাবা

চৌধুরী আহছান খুররম | রবিবার , ১৯ জুন, ২০২২ at ১১:১২ পূর্বাহ্ণ

বাবা নেই, বাবা আছেন। বাবা বিহনে দু’বছর গত। প্রতিনিয়ত চোখে ভাসে বাবার মুখাবয়ব। বাবা শফিকুল আলম চৌধুরী। তাঁকে নিয়ে কলম ধরতেই চোখ ঝাপসা হয়ে পানি গড়ায়। লেখা আর হয়ে ওঠে না। বাবা আমাদের শেখাতেন জাতি-ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে সালাম-শ্রদ্ধা সম্মান করতে। দু’হাত নেড়ে হাঁটা, চায়ের কাপে চুমুক দেওয়া থেকে শুরু করে অনুষ্ঠানে খাওয়ার নিয়মও। বাবাকে কখনও দেখিনি একজন রিকশাচালককে তুই-তোকারি ব্যবহার করতে।

আমার বন্ধুদের সাথেও বাবার আচরণ ছিল অনুরূপ। ছোট-বড় সকলের সাথে খোশগল্পে মেতে থাকতেন। বইপড়াসহ তাঁর জানার আগ্রহ ছিল প্রবল। বাবা মিথ্যা বলা পছন্দ করতেন না। বয়স দোষে দুষ্টু ছিলাম বলে, হাইস্কুলে পড়াকালীন বন্ধুদের সাথে সিনেমা দেখতে গেলে বের হতেই দেখি সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। ভয়ে বুক দুরুদুরু। ফিরতেতো হবেই। গেইটে উঁকি দিতেই দেখি, বাবা বেত হাতে সদর দরজায়। ভয়ে শরীর হিম হয়ে আসে। বাবা সত্যকে গুরুত্ব দেন এ ভরসায় ধীর পায়ে এগোতে থাকি। কোথায় ছিলাম, জানতে চাইলেন, উত্তরে, সিনেমা হলে। টিকিটের বাকি অংশ দেখতে চাইলেন।

যথারীতি, দেখে বলেন, যাও সত্য বলার জন্য ছেড়ে দিলাম। পৃথিবীতে বাবা এমন এক ব্যক্তি, যিনি নিজের চেয়েও সন্তান এগিয়ে যাওয়া পছন্দ করেন। শ্রদ্ধাবনতচিত্তে চোখে জল আসে যখন বাবাকে নিয়ে মানুষ বলেন, আপনার বাবা পরোপকারি ভালো মানুষ ছিলেন। নম্রতা, ভদ্রতা, নিয়মানুবর্তিতা, শৃঙ্খলা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, সৌখিনতা বাবার খুব পছন্দের। আসবাবপত্র, বাসন-কোসন, খাবার-দাবার সবকিছুতে পরিপাটি হওয়া চায়। সন্তানদের প্রতি তাঁর এতটাই নজরদারি ও ভালোবাসা ছিল, অফিস কিংবা অন্য কোথাও গেলে সেল ফোনে বারবার খোঁজ নিতেন। বাইরে থেকে ফিরতে একটু দেরি হলে ফোন দিতেন, বলতেন- ‘অপুত তুঁই হডে, হটা বাজের, জলদি আইয়ু’ ভাবতেই চোখ বেয়ে পানি আসে। যার যায় সে বুঝে। বোবা কান্নায় বুকের মাঝে রক্তক্ষরণ হয়, যা বুঝিয়ে বলা সম্ভব নয়। ইম্পেরিয়াল হাসপাতালে আমি আর বাবা, কত কথাইনা হতো।

বাবা একদিন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘অপুত আঁরে মাফ (ক্ষমা) গরি দিও। তুঁই আঁর বড় পোয়া, আঁই যা কিছু বকাঝকা গইত্তাম, মুখুত্তুন, মনত্তুন ন-গরি’। বাবার দরদমাখা মিষ্টি কথাগুলো কষ্ট হয়ে বুকে লালন করতে হবে আমৃত্যু। বাবার কথাগুলো কানে বাজে, হাস্যেজ্জ্বল বদনে স্বপ্নে আসেন বাবা মাঝে মাঝে। যত দুঃখই আসুক, দুঃখের ছায়া সন্তানের ওপর পড়তে না দেওয়ার নাম বাবা। অল্প বয়সে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ায় দেশের উত্তাল সময়গুলোতে বাবা আমার নিরাপত্তা নিয়ে সদা উদ্বিগ্ন থাকতেন। দিন যত যায় তত টের পাই, বাবা মানুষটা কী ছিলেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধতুমিই তো আমার বাবা
পরবর্তী নিবন্ধবাবা ছাড়া জীবন