দীলতাজ রহমানের ‘দ্বিতীয় শ্রাবণের প্রথম কদম’

মোহাম্মদ আলী | শনিবার , ১৭ জুন, ২০২৩ at ৫:৩৪ পূর্বাহ্ণ

হৃদকুসুম কখন যে ফুটবে কার, কোন সময়কে জানে! বাঙালিমনোহরা কদম বছরে কয়েকবার ফোটে। গরমে ফোটে, আষাঢ়ে ফোটে; ফোটে শীতেওতার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। মানুষমনেরও কোনো আগামাথা নেই, নিশ্চয়তা নেই। মাঝবয়সি আকলিমা খানমেরও সেই দশা দীলতাজ রহমানের দ্বিতীয় শ্রাবণের প্রথম কদমউপন্যাসে। ছোট্ট মানুষ বুবলি, যে কিনা আকলিমার ছোট ছেলে তন্ময়ের আগ্রাসী প্রেমিকা, তারই দেয়া ছোট্ট নাম ‘লীমা’ তাঁকে জীবনের পথ চেনাতে শিখিয়েছে। জীবনবৎসরের শীতেও (লেখকভাষ্যে ‘দ্বিতীয় শ্রাবণের প্রথম কদম) হৃদকদম যে ফুটতে পারে, তাঁর অভিজ্ঞতার বস্তায় সেটা ছিল না, উপন্যাসশেষের আগপর্যন্ত তিনি বুঝতে পারেন নি আমরা তো দূরের কথা। এই উনিশবিশ বছরের স্বচ্ছন্দ জীবনবোধের মেয়েটি তাঁকে শিখিয়েছে : মা হলেও তাঁর জীবন সম্পূর্ণ আলাদা সন্তানদের কাছ থেকে। শুধু আমরা জন্ম দিই একেকটা জীবনকে। তারপর আলাদা আলাদা সত্তায় জীবন চলি। একটা কথা মনে রাখতে হবে, দীলতাজ রহমানের গল্পউপন্যাসে একটা বিষয় খুব সুন্দরভাবে উঠে আসে, সেটা হল নারীর সাথে নারীর সংযোগ। তাঁর ‘গল্পসমগ্র ১’ ও অন্যান্য কথাসাহিত্য পাঠে আমার এ অভিধা তাঁর অপরাপর পাঠকের কাছেও স্বীকৃতি পাবে বলে বিশ্বাস করি। আকলিমার অভিজ্ঞতাবস্তায় ছিল সমাজসংসার বিচ্ছিন্ন হওয়ার ক্রমসুর। তিন ছেলের মধ্যে বড় দুই বিবাহিত ছেলে মায়ের জমি থেকে হয় বিচ্ছিন্ন, মায়ের মন থেকেও ঠিক তাই। মেনে নেন তিনি এই ভাঙন কিন্তু মন থেকে তো আর মুছে ফেলা যায় না বিচ্ছিন্নতার ছলাকলা। ছোট ছেলের পড়াশোনা ঠিকমতো চলত না, বড় দু’ভাইয়ের খরচ যোগাতে। আর সেই ভাইদুটোই কিনা নিজেদের ভাগ্য বদলাবার আশায় বিধবা মা আর বেকার, অল্পশিক্ষিত ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে যার যার আখের গোছাতে পড়ল ব্যস্ত হয়ে। বাঙালি মধ্যবিত্তের যা হয় আর কী! এদের আটপৌরে হঠাৎই ঢুকে পড়ল ধনীকন্যা নবকদম্ব বুবলি। আখ্যানশেষের আগপর্যন্ত এই বুবলিই অনুঘটক শীতে ফোটা কদমের আকস্মিক মিলনের।

আকলিমার ছেলের প্রেমিকা বুবলির প্রেম আঁকশিতে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যায় ছেলে তন্ময় আর মা আকলিমা দুজনেই। নাটকীয় পরম্পরায় তন্ময়ের বিদেশ যাওয়ার আগমুহূর্তের তন্ময়বুবলির শরীরি প্রেমও যথেষ্ট হয়নি তাদের সম্পর্ককে চিরকালীন করার। বেশি প্রেম বুঝি সহ্য হয় না ধরিত্রীর। অচিরেই অতিমারিমহামারি এসে মঞ্চ থেকে তুলে নেয় বুবলিকে। দরকারও ছিল ঘটনাটা ঘটাবার। নইলে দ্বিতীয় শ্রাবণের প্রথম কদম যে দুরস্থ হয়ে যায়! ভাগ্যদুয়ার খুলে যায় আখ্যানের টিমটিম করে জ্বলা চরিত্র বুবলির একাকী বাবারও। যেখানে মিলন অসম্ভব, সেখানেই যেন এর রক্তবীজ অঙ্কুর ফোটায়। বুবলি মৃত্যুকবলিত, বিদেশস্থিত তন্ময়ের কী হবে, সেও আমাদের মনে তেমন একটা রেখাপাত করে না। কারণ ঐ যে বলেছিলাম : নারীর সাথে নারীর সংযোগ দীলতাজের লেখার অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। বুবলিআকলিমার মামেয়েতুল্য সম্পর্কই দীলতাজের এ আখ্যানের কেন্দ্রীয় সুর। ‘আগে দর্শনধারী পরে গুণবিচারী’। বাংলা আপ্তবাক্যের শিকার হয়েই বইটা হাতে ধরা দিল। যতবারই এর প্রচ্ছদ দেখেছি, মন থেকে ততবারই উদয় হয়েছে প্রচ্ছদটা খুব সুন্দর। এ সূত্রে শিল্পী তৌহিন হাসানের প্রতি ভালোবাসা রইল। কথাশিল্পীজীবনস্রষ্টা দীলতাজ রহমানের প্রতি ভালোবাসা রইল কিছু জীবনকে কালিকলমে ফুটিয়ে তোলার জন্য।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশকুন
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে