দীর্ঘ নির্বাসন জীবন শেষে স্বদেশে তারেক রহমান

ঢাকায় ফিরেই যাবেন সংবর্ধনাস্থল তিনশ ফিট সড়কে । অভ্যর্থনার পর এভারকেয়ারে যাবেন মায়ের কাছে । একদিন আগেই রাজধানীতে নেতাকর্মীর ঢল

| বৃহস্পতিবার , ২৫ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ৬:১২ পূর্বাহ্ণ

অবর্ণনীয় নির্যাতন, কারাবাস আর নির্বাসনের দীর্ঘ ১৭ বছর পেরিয়ে আজ জন্মভূমিতে ফিরছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এই দীর্ঘ সময়ে প্রবাসে থেকেও নেতৃত্ব দিয়ে দলকে সংগঠিত করার পাশাপাশি ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সংগ্রাম এবং চব্বিশের জুলাই আন্দোলনেও ছিল তারেক রহমানের গুরুত্বপূর্ণ অবদান। তাঁর দেশে ফেরার ঘোষণার পর থেকেই বিএনপি নেতাকর্মী ও দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিরাজ করছে প্রাণচাঞ্চল্য। বহুল আলোচিত ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি তথা একএগারোয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে গ্রেপ্তারের পর তারেক রহমান নির্যাতনের শিকার হন। নির্যাতনের আঘাত আর মিথ্যা মামলা নিয়ে প্রায় দেড় যুগ আগে দেশ ছেড়েছিলেন যিনি, তিনিই বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন বহুল আকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিত্ব। যার অপেক্ষায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও সমগ্র বাংলাদেশ। খবর বাসসের।

একএগারোর পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় মইনুল রোডের বাসা থেকে ২০০৭ সালের ৭ মার্চ গ্রেপ্তার করা হয় বিএনপির তৎকালীন সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমানকে। এরপর অজ্ঞাত স্থানে আটকে রেখে চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। ওই বছর ২৮ নভেম্বর আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে নিপীড়নের বর্ণনা তুলে ধরেছিলেন তিনি। রিমান্ড, নির্যাতন, ৫৫৪ দিন বা ১৮ মাস কারাভোগের পর ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যান তারেক রহমান। লন্ডনে যাওয়ার পরও তার ওপর থামেনি মামলার খড়গ। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ১৩টি এবং আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তার বিরুদ্ধে ৭২টি মামলা হয়। এর মধ্যে অন্তত পাঁচটি মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয় তাকে। একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় আসামি মুফতি হান্নানকে দীর্ঘ দিন রিমান্ড নির্যাতন করে এক বিতর্কিত স্বীকারোক্তি নেওয়া হয়। ওই স্বীকারোক্তিকে আমলে নিয়ে একুশে আগস্ট মামলার বিচার শুরুর পর ফের সম্পূরক চার্জশিট দিয়ে সেখানে তারেক রহমানসহ আরো কয়েকজনকে জড়ানো হয়। এ মামলায় তারেক রহমানকে যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয়। পরে এ মামলায় আপিলে উচ্চ আদালতে খালাস পান তারেক রহমানসহ সকল আসামি।

রায়ের পর আসামিপক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, একইসঙ্গে মুফতি হান্নান দুটি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। আমরা বলেছিলাম, ৪০০ বছরের ইতিহাসে ভারতীয় উপমহাদেশে দ্বিতীয় জবানবন্দির ওপর ভিত্তি করে কাউকে সাজা দেওয়ার নজির নেই। রায়ে আদালত বললেন, দ্বিতীয় জবানবন্দি তিনি যেটি করেছিলেন, সেটিও পরে মুফতি হান্নান প্রত্যাহার করেন। এজন্য এ জবানবন্দির কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। এর ফলে উচ্চ আদালতে বিচারিক আদালতের রায় বাতিল করেন। এমনকি গণমাধ্যমেও উচ্চ আদালতের নির্দেশ দেখিয়ে দীর্ঘ সময় তারেক রহমানের বক্তব্য প্রচারে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।

নানা প্রতিকূলতা মোকাবিলা করেই সুদূর লন্ডনে থেকেই পরিচালনা করেন সংগঠন। ওয়ার্ড থেকে শুরু করে কেন্দ্র পর্যন্ত সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে ভার্চুয়ালই রক্ষা করে গেছেন যোগাযোগ। এরই মধ্যে তার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ ও উজ্জীবিত হয়েছে বিএনপি। তার নেতৃত্বেই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াইসংগ্রামে নামে বিএনপি। ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানেও ছিল তারেক রহমানের অবদান। দলটির নেতাকর্মীরা তার দিকনির্দেশনাতেই ছাত্রজনতার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে সর্বশক্তি নিয়ে। তার বিরুদ্ধে আনা সকল মামলায় চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে আইনি লড়াইয়ে মুক্ত হন তারেক রহমান।

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি নিয়মিত ফ্লাইটে যুক্তরাজ্য থেকে দেশে ফিরছেন তারেক রহমান। ফ্লাইটটি বুধবার যুক্তরাজ্যের স্থানীয় সময় সন্ধ্যা সোয়া ৬টায় (বাংলাদেশ সময় রাত ১২টায়) লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দর থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা হওয়ার কথা রয়েছে। তারেক রহমানের সঙ্গে সফরসঙ্গী হিসেবে একই বিমানে তার সহধর্মিণী ডা. জুবাইদা রহমান ও কন্যা ব্যারিস্টার জাইমা রহমানও আসছেন।

সব ঠিক থাকলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে বহনকারী উড়োজাহাজটি আজ বেলা ১১টা ৪৫ মিনিটে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছাবে। অবতরণের পরপরই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে নিরাপত্তা ও প্রটোকল ব্যবস্থাপনা কার্যকর করা হবে। ঢাকায় অবতরণের আগে তারেক রহমানকে বহন করা উড়োজাহাজটি সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এক ঘণ্টার যাত্রা বিরতি করবে। ঢাকা বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানাবেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যরা। উচ্ছ্বসিত নেতাকর্মীরা বিমানবন্দরের বাইরে অপেক্ষায় থাকবেন।

বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তারেক রহমানের প্রথম ও প্রধান অগ্রাধিকার হলসরাসরি এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তার গুরুতর অসুস্থ মা বেগম খালেদা জিয়াকে দেখতে যাওয়া। তবে বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী, সমর্থক ও সাধারণ মানুষের উপস্থিতির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে, জনগণের প্রত্যাশার প্রতি সম্মান জানিয়ে, যাত্রাপথের মাঝামাঝি রাজধানীর ‘জুলাই ৩৬ এঙপ্রেসওয়ে’ (তিনশ ফিট) এলাকায় দলের পক্ষ থেকে তৈরি করা সংক্ষিপ্ত গণঅভ্যর্থনা মঞ্চে তিনি অতি সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করবেন। সেখান থেকে তিনি এভারকেয়ার হাসপাতালে মায়ের কাছে যাবেন।

গতকাল বুধবার গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, বাংলাদেশ বিমানের একটি নিয়মিত ফ্লাইটে বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা ৪৫ মিনিটে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করবেন তারেক রহমান। দেশে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি তিনশ ফিট এলাকায় গণঅভ্যর্থনা অনুষ্ঠানে নেতাকর্মী ও দেশবাসীর উদ্দেশে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেবেন। এরপর সেখান থেকে এভারকেয়ার হাসপাতালে মাকে দেখতে যাবেন। সেখানে তিনি মায়ের পাশে একান্তে কিছু সময় কাটাবেন। পরে এভারকেয়ার হাসপাতাল থেকে গুলশান অ্যাভিনিউর ১৯৬ নম্বর বাসায় উঠবেন তারেক রহমান।

রাজধানীর তিনশ ফিটে নেতাকর্মীদের উচ্ছ্বাস : বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে ঘিরে সংবর্ধনাস্থল রাজধানীর তিনশ ফিটে উচ্ছ্বসিত নেতাকর্মীরা। তারেক রহমানকে বরণ করতে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়েছে বিএনপি। গতকাল থেকেই ঢাকার বিশ্বরোড তিনশ ফিটে অবস্থান নিয়েছেন হাজারও জনতা। সারাদেশ থেকে বিএনপি নেতাকর্মীরা ঢাকায় ছুটছেন প্রিয় নেতাকে দেখার জন্য। বাস, লঞ্চ, ট্রেন ও মাইক্রোবাসে রওয়ানা দিয়েছেন লাখো জনতা।

বিশ্বরোড থেকে পূর্বাচলমুখী তিনশ ফিট সড়কের একটি অংশজুড়ে মঞ্চ তৈরির কাজ চলছে। বুধবার রাতের মধ্যে মঞ্চ তৈরির কাজ শেষ হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ৪৮ ফুট দীর্ঘ, ৩৬ ফুট প্রশস্ত ও সড়ক থেকে ৮ ফুট উঁচুতে এ মঞ্চ তৈরি হচ্ছে। প্রায় ৯০০ মাইক লাগানো হবে রাজধানীতে। এয়ারপোর্ট থেকে শুরু করে আবদুল্লাহপুর, বিশ্বরোড, বনানী হয়ে মহাখালী, যমুনা ফিউচার পার্ক, তিনশ ফিটের রাস্তা ধরে কাঞ্চন ব্রিজ পর্যন্ত লাগানো হচ্ছে এসব মাইক। পুরো এলাকা সিসি টিভির নিয়ন্ত্রণে থাকবে।

সংবর্ধনাস্থলের বাইরে নেতাকর্মীদের ঢল তিনশ ফিট ছাড়িয়ে বিমানবন্দর সড়কে উত্তরাবনানী পর্যন্ত যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই লক্ষ্যে দলটি সংবর্ধানস্থল ও আশপাশের সড়কে ৯ শতাধিক মাইকের ব্যবস্থা রাখছে। পাশাপাশি শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ডিজিটাল এলইডি ডিসপ্লে স্থাপন করবে।

তারেক রহমানের সংবর্ধনার মঞ্চে সঙ্গে থাকবেন তার সহধর্মিনী ডা. জুবাইদা রহমান, তার মেয়ে ব্যারিস্টার জাইমা রহমান, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যরা, যুগপৎ আন্দোলনের শীর্ষ নেতা ও দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা। মঞ্চের সামনে ও দুই সাইডের নিরাপত্তার জন্য ২৫ থেকে ৩০ ফুট পর্যন্ত বিশেষ ব্যারিকেড থাকবে। ব্যারিকেডের বাইরে উভয়পাশে নেতাকর্মীরা তারেক রহমানকে শুভেচ্ছা জানাবেন।

তারেক রহমান পুলিশ প্রটেকশনসহ বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা পাবেন। এছাড়া তারেক রহমানের বাসভবন ও অফিসেও থাকবে কয়েক স্তরের নিরাপত্তা। নিরাপত্তা ছাড়পত্র ছাড়া কাউকে তার কাছে ভিড়তে দেবে না পুলিশ। ইউনিফর্মধারী পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোশাকেও ছদ্মবেশে গোয়েন্দারা তারেক রহমানের নিরাপত্তার দিকটি দেখভাল করবেন।

পাশাপাশি বিমানবন্দর থেকে গুলশান পর্যন্ত দলের পক্ষ থেকে তারেক রহমানের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা হিসেবে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) . এ কে এম শামছুল ইসলামকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তার নেতৃত্বে চেয়ারপার্সন সিকিউরিটি ফোর্সসহ একাধিক টিম কাজ করবে। এছাড়া দলের বিশ্বস্ত নেতাকর্মীদের সমন্বয়েও একটি টিম গঠন করা হয়েছে।

জরুরি স্বাস্থ্যসেবার জন্য ৩০টি মোবাইল মেডিকেল টিম গঠন হয়েছে। বিমানবন্দর ও ৩০০ ফিট এলাকার আশেপাশের হাসপাতাল প্রস্তুত থাকবে। তারেক রহমানের আগমনে লাখ লাখ নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের ঢাকায় সমাগম হবে।

তিনদিনের কর্মসূচি : তারেক রহমানের কর্মসূচি নিয়ে কথা বলেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার বিমানবন্দর থেকে তিনশ ফিট সড়কে অভ্যর্থনার পর এভারকেয়ার হাসপাতালে মায়ের সঙ্গে দেখা করবেন। পরদিন ২৬ ডিসেম্বর বাদ জুম্মা জিয়াউর রহমানের মাজার জিয়ারত করবেন এবং জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন তারেক রহমান। ২৭ তারিখে এনআইডি কার্ড এবং ভোটার হওয়ার সব কাজ শেষ করবেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। এছাড়া শরীফ ওসমান হাদির কবর জিয়ারত এবং জুলাই অভ্যুত্থানে আহতদের দেখতে পঙ্গু হাসপাতালেও যাবেন তারেক রহমান।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনতুন রাজনীতির সূচনা
পরবর্তী নিবন্ধফটিকছড়িতে অস্তিত্ব বিপন্নের পথে হালদা নদী!