এ জনপদে লেখালেখির জগতে দীপালী ভট্টাচার্য অতি পরিচিত একটি নাম। নিজের শিক্ষকতা পেশার পাশাপাশি লেখালেখিকে জীবনের অন্যতম একটি অনুষঙ্গ হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন দীপালী ভট্টাচার্য। পারিবারিক সামাজিক নানা কর্মকাণ্ডে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখার পাশাপাশি লেখালেখিতে তিনি ছিলেন আপন মহিমায় সমুজ্জ্বল। লেখালেখি অনেকের কাছে নেয়ায়েৎ পেশার পাশাপাশি এক ধরনের নেশা। সে নেশার মোহ একবার যাকে পেয়ে বসে তা থেকে যতই দূরে সরে যেতে চান না কেন সে মোহ আবার লেখালেখিতেই ফিরে নিয়ে আসে। অনেক লেখকের জীবনে তা বাস্তবতা। লেখালেখি হচ্ছে মনের খোরাক। মনের ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য মানুষ সুকুমার বৃত্তি চর্চার অনেক বিষয়কে বেছে নেয়। লেখালেখি তার মধ্যে অন্যতম। লেখালেখির আবার বহুমাত্রিকতা আছে। মানুষ তার আপন পছন্দের বিষয়ে লেখালেখিতে নিজের গতিপথ রচনা করে। দীপালী ভট্টাচার্য এমন একজন লেখক যিনি নিজের মনের তাগিদে শিক্ষকতার পাশাপাশি লেখালেখিকে বেছে নিয়েছিলেন নিতান্তই কোনো জীবিকার তাগিদে নয়, বরং লেখালেখির প্রতি একধরনের ভালোবাসা বা অনুরাগের কারণেই। এক্ষেত্রে তাঁর পথচলা অত্যন্ত সফল ও সার্থক। বর্তমান প্রজন্মের অনেকের কাছে তাঁর নামটি পরিচিত নাও হতে পারে, কিন্তু সত্তর আশি কিংবা নব্বই দশকের সময়ে যাঁরা লেখালেখি করতেন তাঁদের কাছে তিনি অত্যন্ত পরিচিত এক মুখ। দীর্ঘদিন অসুস্থতার কারণে তাঁর লেখালেখিতে কিছুটা স্থবিরতা নেমে আসলেও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি অসুস্থতায়ও ছুটে আসার চেষ্টা করতেন। আমরা যাঁরা আশি নব্বই দশকের দিকে লেখালেখির চেষ্টা করছি এবং মাঝে মাঝে পত্রপত্রিকায় লেখা ছাপা হতো সে সময় দীপালী ভট্টাচার্য নামটি প্রতিনিয়ত পত্রিকাতে দেখার সুবাধে সেই যে হৃদয়ে গেঁথে গিয়েছিলো তা তাঁর মৃত্যু অবধি মনের মণিকোঠায় ছিল। সে সময়ে আজাদীর আগামীদের আসর ও নয়াবাংলার ছোটদের মজলিশের পাতায় নিয়মিত তাঁর লেখা ছাপা হতো। সাহিত্য পাতায়ও তাঁর চমৎকার সব গল্প ছাপা হতো। আমার মত অনেকেরই কাছে হয়তো তিনি ছিলেন অনুকরণীয় একজন লেখক। তাঁর লেখা দেখে মনে স্বপ্ন উঁকি দিতো সেরকম করে পত্রিকায় লেখার। সে সময় গ্রামে থাকতাম বলে কখনো তাঁকে স্বচক্ষে দেখা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু লেখালেখির সুবাধে তাঁর নামটি যেভাবে মনে স্থান করে নিয়েছিলো তা যেন তিনি আমাদের পরম আত্মারই একজন আত্মীয়। পরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁর সাথে দেখা হলেও কিন্তু সেভাবে পরিচয় ঘটেনি। খুব কাছাকাছি পরিচয়টা হয়েছিলো অনেক বছর আগে কবি অমিত বড়ুয়ার আয়োজনে বীর চট্টগ্রাম মঞ্চের এক সাহিত্য আড্ডায়। কী প্রাণ চঞ্চল সজীব সুন্দর প্রাণবন্ত এক মহিলা। লেখালেখিতে তিনি যেমন প্রাণচঞ্চল, চলন বলন কথা বার্তাতেও তিনি ছিলেন একদম সে রকমই। প্রায় পাঁচদশক ধরে সাহিত্য অঙ্গনে তাঁর বিচরণ ছিল। এতদাঞ্চলে নারী লেখকদের মধ্যে তিনি অগ্রগণ্য একজন লেখক। তিনি যে সময়ে লেখালেখি শুরু করেছেন সেসময় এ অঞ্চলে নারী লেখকদের সংখ্যা ছিল খুব কম। নারীদের নানা বাধা অতিক্রম করেই পথ চলতে হয়। সে বাধা এখনো কম নয়। সে সময়ে তা ছিল আরো অনেক বেশি। সে বাধাকে তুচ্ছ করে তার পথ চলাটা কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না, কিন্তু তিনি এগিয়ে গিয়েছেন সদর্পে। সে জন্য অনেক নারী লেখকসহ অনেকের কাছে তিনি অনুকরণীয় ও ভালোবাসার এক নাম। লেখালেখির যে বহুমাত্রিকতা আছে সে বহুমাত্রিকতার মধ্যে তাঁর পথচলা ছিল সাবলীল।
তিনি লিখে গেছেন একাধারে গল্প, কবিতা, ছড়া, রম্যলেখা, উপন্যাসসহ বহু বিচিত্রমুখী লেখা। এখানে বড়দের জন্য এবং ছোটদের জন্য তিনি লিখে গেছেন অকাতরে। সব কিছু ছাপিয়ে একজন শিশুসাহিত্যিক হিসাবে তাঁর গৌরবময় পথ চলা ছিল বর্ণিল। শিশুদের জন্য দরদ দিয়ে লেখা শিশুকিশোরদের তো বটেই সকল শ্রেণির পাঠকের কাছে তা ছিল সুখপাঠ্য। একসময় পত্র পত্রিকায় তাঁর প্রচুর লেখা পড়েছি। বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়লেও লেখালেখিতে তাঁর ছেদ পড়েনি। ধীরে ধীরে তিনি পত্রিকার লেখালেখিতে কিছুটা ধীর গতিতে আগালেও বই প্রকাশে বেশ মনোযোগী দেখা যায়। সেজন্য মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত বড়দেরসহ শিশুকিশোর উপযোগী প্রায় ২২টি বই প্রকাশের তথ্য পাওয়া যায়। অনেক লেখকের লেখক সত্তা বিকাশের প্রথম সোপান হিসাবে দেশের স্বনামধন্য প্রকাশন শৈলী প্রকাশনের নাম আসে। এ প্রকাশনের হাত ধরে অনেক লেখকের প্রথম বই প্রকাশিত হয়েছে, যাঁদের অনেকেই এখন সুপ্রতিষ্ঠিত লেখক। দীপালী ভট্টাচার্যও এ কাতারে সামিল হওয়া একজন। ১৯৯৬ সালে শৈলী প্রকাশন থেকে তাঁর প্রথম বই ‘স্বপ্নসুখ ভালোবাসা’ প্রকাশের মাধ্যমে তাঁর বই প্রকাশের যে অগ্রযাত্রা শুরু হয়– তারপর একে একে দেশের স্বনামধন্য অনেক প্রকাশন থেকে বের হয় তাঁর রাজকন্যা, গল্পে গল্পে উপদেশ, ছড়াসমগ্র, ছোটদের গল্পসমগ্র–১ ও ২, কবিতাসমগ্র, শিয়াল মামার বিয়ে, ইচ্ছেপরি ও তুতুন, যাপিত জীবনের রম্যগল্প, দৈত্যরাজ ও ফুলপরি, রাজকন্যা ও ভূতের গল্প, শিশুকিশোর সমগ্র, ভূতের দেশে রাজকন্যাসহ আরো অনেক বই। ছোটদের গল্পসমগ্র–২ বইটিতে ১০০টি মত গল্প স্থান পেয়েছে। এ জনপদের প্রবীণ লেখকদের মধ্যে দীপালী ভট্টাচার্য একজন। দীর্ঘদিন ধরে ছোটদের তিনি ছোটদের জন্য লিখেছেন অবারিত হাতে। একজন ধীমান শিক্ষক হিসেবে তাঁর গল্পে শিশুকিশোরদের মনস্তত্ত্ব বিবেচনায় নৈতিকতা, আদর্শ ও শিক্ষামূলক বক্তব্যকে তুলে ধরার প্রয়াস লক্ষ করা যায়। তাঁর গল্পের মধ্যে সমাজের নানা অসংগতির কথা যেমন খুঁজে পাওয়া যায়, তেমনি পাওয়া যায় তা থেকে উত্তরণের বার্তাও। ছোটদের জন্য লিখতে হলে একজন লেখককে সেই বয়সের সীমানায় নিজেকে সমর্পণ করতে হয়। দীপালী ভট্টাচার্যের গল্পগুলো পড়লে মনে হতো তিনি যখন ছোটদের জন্য গল্প লেখেন, তখন তিনি যেন নিজেই প্রকৃত এক শিশু হয়ে যান। এখানেই একজন লেখকের বিশেষত্ব। তাঁর গল্পের পরতে পরতে উঠে আসে দেশাত্ববোধ, মুক্তিযুদ্ধ, প্রকৃতি ও পরিবেশ, ভাষা আন্দোলন, নৈতিক চরিত্র গঠনের নানা উপদেশসহ তথ্য নির্ভর অনেক অনুষঙ্গ। তাঁর লেখা শুধু ছোটদের নয়, বড়দের আনন্দেরও খোরাক। খুব বেশি তাঁর লেখা পড়ার সুযোগ না হলেও যেটুকু পড়ার সুযোগ হয়েছে তাতে মনে হয়েছে তাঁর লেখা সাবলীল ও এক ধরনের আকর্ষণ জাগানিয়া। তাঁর গল্পের হাত ছিল চমৎকার। তাঁর লেখা পড়তে শুরু করলে গল্প শেষ না হওয়া পর্যন্ত যেন থেমে যেতে মন চাইতো না। পাঠকদের ধরে রাখার মতো এক ধরনের দক্ষতা তাঁর লেখাতে লক্ষ করা যেতো। শিশু–কিশোরদের জন্য তিনি অত্যন্ত সচেতন ও কৌশলী হয়ে লিখতেন। শিক্ষকতা করার সুবাধে শিশুকিশোরদের সাথে তাঁর প্রাত্যহিক পথচলা ছিল, সে কারণেই বোধ হয় লেখালেখিতে শিশুকিশোরদের বিষয়গুলো তিনি চমৎকারভাবে নিয়ে আসতে পারতেন। গত জানুয়ারিতে চট্টগ্রাম একাডেমির নির্বাচনের কারণে কবি মেহেরুননেসা রশীদ আপাকে আমি ফোন করেছিলাম। সে কথোপথনে তাঁর ভীষণ অসুস্থতার কথা উঠে আসে। দীপালী ভট্টাচার্যের শারীরিক অবস্থার অনেক কথাই তিনি বললেন। মনে মনে ভাবছিলাম কয়েকজনকে নিয়ে একদিন হয়তো দেখতে যাবো। আসলে যাওয়া যাওয়া করে আর যাওয়া হলো না। তাঁর মৃত্যু সংবাদ শুনে সত্যই বেদনাহত হয়েছি। যাপিত জীবনে অনেকের মৃত্যু এভাবেই হয়, কিন্তু ব্যস্ততায় হোক কিংবা অবহেলায় হোক শেষ দেখাটা হয় না। তিনি শুধু একজন লেখকই ছিলেন না, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সাথেও তাঁর সম্পৃক্ততা ছিল।
তিনি চট্টগ্রাম একাডেমি, চট্টগ্রাম লেখিকা সংঘ, নন্দিনী সাহিত্য ও পাঠচক্র, চাঁদের হাটসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন। সাহিত্য চর্চার স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি বাংলা সাহিত্য পদক, বাংলা কবিতা সংসদ পদক, পুণ্ড্রবর্ধন সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার, কবি শামসুর রাহমান পদকসহ আরো অনেক পুরস্কারে ভূষিত হন। একজন শ্রেষ্ঠ শিক্ষিকা হিসাবেও অনেক সংগঠন কর্তৃক তিনি সংবর্ধিত হন। সুদীর্ঘকাল একজন নারী হিসাবে সাহিত্য জগতে তাঁর যে গৌরবদীপ্ত বিচরণ সে কারণে তাঁর আরো সম্মানজনক মূল্যায়ন প্রয়োজন ছিল। তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম একাডেমির প্রতিষ্ঠাকালীন একজন পরিচালক এবং মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত একাডেমির উপদেষ্টা হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৪৯ সালের ১৮ অক্টোবর রাউজান উপজেলার নোয়াপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণকারী এ মহীয়সী নারীর জীবনাবসান ঘটে ৭৫ বছর বয়সে ১৮ এপ্রিল ২০২৫। শিক্ষকতা পেশা থেকে অবসর গ্রহণের পরও তিনি লেখালেখিকে আঁকড়ে ধরে রেখেছিলেন।
লেখক : প্রাবন্ধিক; সহকারী অধ্যাপক, বিএমসি কলেজ।