সৃজনশীল মানুষরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অবহেলা ও অনুপ্রেরণাবিহীন পরিবেশে বেড়ে উঠেছে। না ফেরার দেশে যাওয়ার পর অনেকে গুণিজনকে সম্মান দেখাতে যায়। কেন জীবদ্দশায় নয় ? অনেক সময় দেখা যায় সৃষ্টিশীল মানুষগুলো একসময় তাঁর জিয়নকাঠির আলো ছড়িয়ে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। সাহিত্য–সংস্কৃতিকে স্বীকার করে নিলে তাঁদের ভালোবাসা ও সম্মান করাই উচিতকর্ম। অজানা বিস্মৃত অধ্যায় স্বজাতির সাহিত্য–সংস্কৃতির অতীত ইতিহাসকে স্মরণে আনতে হয়।
অধ্যয়ন জীবন থেকে লেখক আহমদ ছফার নাম শুনেছি, দুর্ভাগ্য সাক্ষাৎ হয়নি। সামনে থেকে কখনো দেখিনি।
একদিন এই দীপ্তিমান মানুষটার স্মৃতিবিজড়িত চন্দনাইশ উপজেলার গাছবাড়িয়া গ্রামের সাহিত্য পাড়ায় পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। আঁকাবাঁকা রাস্তা। সবুজ শ্যামল পাখিডাকা ছায়া–ঘেরা ছবির মতো সুনিবিড় গ্রাম। রাস্তার দুপাশে সবজি খেত, মরিচ, বেগুন, শিমের লতায় থোকা থোকা শিমের নাচন। বাগানের মাঝখানে কাকতাড়ুয়া। পাকুড় গাছে দোয়েল পাখি শিস তুলছে। একটু সামনে গিয়ে দক্ষিণ গাছবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই ইশকুলে জীবনের প্রথম পাঠ নিয়েছিলেন লেখক আহমদ ছফা, পরবর্তীতে গাছবাড়িয়া নিত্যানন্দ গৌরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দুটি লেখক আহমদ ছফা স্মৃতিবিজড়িত। পরিতাপের বিষয় দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই লেখক আহমদ ছফার কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই। লেখকের পরিবার কিংবা বন্ধুবান্ধবরাও কেউ এগিয়ে আসেনি। একজন লেখক হচ্ছেন সমাজের তথা দেশের সবচেয়ে উঁচুকাতারের সম্মানী মানুষ। একজন আন্তর্জাতিকমানের বুদ্ধিজীবী ও লেখকের স্মৃতি না থাকা লজ্জার।
সাহিত্য পাড়ায় বাপ–দাদার ভিটে ও লেখকের ভাইপোদের জরাজীর্ণ বাড়িটি আছে। একসময় আহমদ ছফার মাটির ঘর ছিল সেটিও বিলুপ্ত। লেখকের খুব কাছের প্রতিবেশী নাতিসম্পর্কীয় তারেক বলল, “ছফা দাদুর একটা মাটির ঘর ছিল বর্তমানে নেই।” লেখকের বাড়ি ঘেঁষে ধীরগতিতে এঁকেবেঁকে বয়ে গেছে “বরুমতি খাল” আঞ্চলিক ভাষায় বলে “বৈরগনি খাল” দেখতে ছোটো নদীর মতো। এই খাল নিয়ে ছপার একটা বইও আছে “বরুমতির আঁকেবাঁকে”।
কথাশিল্পী আহমদ ছফা ১৯৪৩ সালের ৩০ জুন চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ উপজেলার গাছবাড়িয়া গ্রামের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি দক্ষিণ গাছবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে সমাপনী সম্পন্ন করে গাছবাড়িয়া নিত্যানন্দ গৌরচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৫৭ সালে মাধ্যমিক এবং ১৯৬২ সালে চট্টগ্রামের নাজিরহাট কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে বোয়ালখালী কানুনগো পাড়া স্যার আশুতোষ কলেজে কিছুদিন পড়াশুনা করেন। ১৯৬৭ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ থেকে স্নাতক পাশ করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে পড়াশুনা শুরু করেন, সেটা অব্যাহত ছিল না। ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর করে পরবর্তীতে জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের তত্ত্বাবধানে পিএইচডি গবেষণা শুরু করেন। গবেষণার বিষয় ছিল “১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব বিকাশ এবং বাংলার সাহিত্য–সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে তার প্রভাব।” জার্মান ভাষার উপর গ্যাটে ইনস্টিটিউটের ডিপ্লোমা ডিগ্রিও লাভ করেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বল্পকালের জন্য অধ্যাপনা করেন।
ছাত্রজীবন থেকে লেখালেখি শুরু। ছাত্র ইউনিয়ন ও কৃষকসমিতি ও কমিউনিস্ট পার্টির একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন। কৃষক আন্দোলন সংগঠনে থাকাকালীন সময়ে কারাবরণও করেছিলেন। দৈনিক গণকণ্ঠ ও সাপ্তাহিক উত্তরণ, উত্থান পর্বে নিয়মিত লিখতেন। উত্থান পর্বের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন লেখক নিজেই। উত্তরণের প্রধান সম্পাদক ছিলেন। লেখালেখি ও সম্পাদনায় স্বচ্ছতা ও সাহসী ও স্পষ্টবাদিতায় সাংবাদিক মহলে বাংলাদেশের উজ্জ্বল এক দীপ্তিমান মেধাবী লেখক আহমদ ছফা। আহমদ ছফা যে শুধু লেখক দার্শনিক কথাসাহিত্যিক ছিলেন তা নয়, তিনি ছিলেন মহৎ ও পরোপকারী মানুষ। তিনি প্রায়শ নিষ্পেষিত মানুষের প্রতি ভালোবাসার হাত প্রসারিত করতেন। ১৯৯১ সালে ২৯ এপ্রিল প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে অনেকের বাড়িঘর বিলীন হয়েছিল। আহমদ ছফা বাংলা–জার্মান সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠানের অর্ার্থিক সহায়তায় প্রায় একশত ঘর পুনর্নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। এছাড়াও গ্রামের দরিদ্র ও গরিব ছাত্র এবং আত্মীয়স্বজনের জন্য তিনি মাসে মাসে টাকা পাঠাতেন। এমনকি অনেক লেখক কবি সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদেরকেও তিনি নানা সময়ে আর্থিক সহযোগিতা করেছেন।
তিনি বাংলাদেশ লেখক শিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও বাংলা জার্মান সম্প্রীতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। লেখক ছফার অনবদ্য রচনাবলী কালের সাক্ষী হয়ে অনন্তকাল বেঁচে থাকবে।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম গ্রন্থ হিসেবে মুক্তধারা থেকে প্রকাশ পায় প্রবন্ধের বই “জাগ্রত বাংলাদেশ।” ১৯৭২–এ প্রকাশিত পায় “বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস”। ১৯৭৯–এ “সিপাহী বিদ্রোহের ইতিহাস” এবং ১৯৮১– তে বাঙালি মুসলমানের মন” গ্রন্থটি প্রকাশ পায়। ছফার জীবনীধর্মী রচনার মধ্যে রয়েছে যদ্যপি আমার গুরু (১৯৯৮, বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের প্রসঙ্গে রচিত স্মৃতিচারণ), ও অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী (১৯৯৬,আত্মজৈবনিক প্রেমের উপন্যাস), পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গপুরাণ (১৯৯৬, আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস)। চারটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেছেন, গ্যাটের ফাউস্ট অনুবাদ প্রকাশিত হয় মুক্তধারা থেকে ১৯৮৬ সালে। গল্প, গান, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, অনুবাদ, ভ্রমণকাহিনি মিলিয়ে ত্রিশটির বেশি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর রচনাবলী ৯ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে।
কিছুদিন আগে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস অলাতচক্র অবলম্বনে হাবিবুর রহমান পরিচালিত “অলাতচক্র” নামে একটি থ্রিডি চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছে।
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লিখে গেছেন। মৃত্যু নিয়ে তিনি বলেছিলেন, “মৃত্যু হলো শোকের চেয়েও প্রয়োজনীয়, মৃত্যু জীবিতদের জন্যে স্পেস সৃষ্টি করে। মৃত্যু সৃষ্ট জীবের কলুষ কালিমা হরণ করে, মৃত্যু জীবনকে শুদ্ধ এবং পবিত্র করে।” জীবনের প্রতি কোন মায়া ছিল না। নিয়মকানুন মানতেন না, খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো করতেন না, গানের কথায়ও লিখেছেন, “ঘর করলাম নারে আমি সংসার করলাম না /আউল বাউল ফকির সেজে আমি কোনো ভেক নিলাম না।”
২০০১ সালে ২৮ জুলাই বাংলাদেশের সক্রেটিস খ্যাত কথাসাহিত্যিক আহমদ ছফা সবাইকে কাঁদিয়ে চিরতরে প্রস্থান নেন। সাহিত্য জগতের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র, প্রাজ্ঞ এই দার্শনিকের শেষ ঠিকানা হলো মিরপুর কবরস্থানে। ব্লক ক, ২৮ লাইন ১০৮৫ নম্বর সাড়ে তিন হাত মাটির কুটিরে শুয়ে আছেন। প্রিয় লেখকের শেষের ঠিকানা দেখতে গিয়েছিলাম। মসজিদের ঠিক পেছনে শুয়ে আছেন। কবরটি লাল টালি ইটের ঘেরা, মাঝখানে সবুজ দুর্বাঘাসের চাদর, পাশে কামিনি ফুলের গাছ দেখে মুগ্ধ হলাম। ভাবলাম দেশের মানুষ প্রকৃতিপ্রেমী স্পষ্টভাষী লেখক ও বু্দ্িধজীবীকে যথাযথ মর্যাদা দিতে না পারলেও প্রকৃতি ঠিকই চিনে নিয়েছে। প্রকৃতি তার নিজস্ব তুলি দিয়ে সমাধিটি যেন সাজিয়েছে। এপিটাফে ঝাপসা চোখে পড়ছিলাম–
“আমার কথা কইবে পাখি করুণ করুণ ভাষে
আমার দুঃখ রইবে লেখা শিশির ভেজা ঘাসে
আমার গান গাইবে দুঃখে পথ হারানো হাওয়া
আমার নাম বলবে মুখে মেঘের আসা যাওয়া
ইন্দ্রধনু লিখবে লিখন কেমন ভালোবাসে
দীঘল নদী করবে রোদন সমাধিটির পাশে”
লেখকের ৮১তম জন্মবার্ষিকীতে প্রত্যাশা “আহমদ ছফা” নামে গাছবাড়িয়া গ্রামে তাঁর স্মৃতিবিজড়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখকের নামে পাঠাগার, ভবন ও সড়কের নামকরণসহ “আহমদ ছফা একাডেমি” স্থাপন করার জন্য চন্দনাইশের সম্মানিত জনপ্রতিনিধিদের সুদৃষ্টি কামনা করছি।