দিব্যালোয় দীপ্ত দেবপ্রিয় : পাঠ ও অনুভবের বিহঙ্গম

জনি বড়ুয়া | শনিবার , ৪ জানুয়ারি, ২০২৫ at ৫:৪৮ পূর্বাহ্ণ

এটাকে ঠিক গ্রন্থালোচনা বলা চলে না। অনিমেষ আগ্রহে পূর্বগামী সমযাত্রীর প্রাণবন্ত জীবনপাঠ। জীবিতের সম্মুখে জীবনের জয়গানএই এক বিষ্ময় অধ্যয়ন হিসেবেই গ্রন্থিত হচ্ছে আমার মূঢ়মানসে। সম্পাদনা পরিষদ যেমন অপকটে উচ্চারণ করেছেব্যক্তিকে নিয়ে সমষ্টি, ঠিক সমচেতনায় আমিও শব্দে শব্দে অনুভব করেছি সমাজব্রতের বরপুত্র শ্রীযুক্ত দেবপ্রিয় বড়ুয়ার জীবনপত্র সাথে একটি উন্মেষী অধ্যায়।

বলছিলাম বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের তদানীন্তন যুগ্ম মহাসচিব ও বর্তমান সিনিয়র সহসভাপতি শ্রদ্ধাভাজনেষু দেবপ্রিয় বড়ুয়া’র আজীবন সম্মাননা গ্রন্থ ও জীবনের কথা। সময়ের অতল গহ্বরে সেই তরুণ দেবপ্রিয় প্রবীণ ধীমান নেতৃত্বে উপনীত হবার দীর্ঘ কথামালার সামান্য অংশের আলোকপাত এই গ্রন্থে অনুভব করেছি। তদীয় সহধর্মীণি শিক্ষিকা গৌরি বড়ুয়ার ত্যাগ কুঞ্চিকা এই গ্রন্থে পূর্ণরূপে উদ্ভাসিত হয়নি বলেই আমার ক্ষীণ অনুভব গ্রন্থের পূর্ণতা ছুঁতে পারেনি।

কলবর ছেড়ে মূল প্রসঙ্গে আসি। বাংলাদেশের অন্যতম বৌদ্ধবিদ্যাবিদ ড. দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান বড়ুয়া ও উদীয়মান সাহিত্যপ্রেমী শ্রীমতি মুনা বড়ুয়া চৌধুরীর নিবিড় প্রযত্নে দিব্যালোয় দীপ্ত দেবপ্রিয় স্মারক গ্রন্থ পাঠকের মুখোমুখী হয়। শৈলীপূর্ণ নামাঙ্করণ করেন প্রদীপ্ত বৌদ্ধ গবেষক ড.বরস্বোধি মহাথেরো। ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত স্মারকের জন্মস্থান রঞ্জন’স অ্যাডে। বাকি তথ্য নথিবদ্ধ করলাম না। শুরুটা ইতিহাস রোমন্থনের মতই বেশ দুর্লভ। হাজার বছর পরে বঙ্গের শ্রেষ্ঠতম সন্তারের দেহভষ্ম ফিরে এসেছিল এই মামাটির নিবিড়ে। সেও বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের নির্মল সদেচ্ছায়। সেই দেহভষ্ম ও রূপকল্পের অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের আলোকচিত্রে থেমে যাবে দেবপ্রিয় পাঠেচ্ছু পাঠকের মননশীলতা। উৎসর্গ পত্রাঙ্কে বাংলার বৌদ্ধ নবজাগরণের শ্রেষ্ঠতম কর্মবীর ত্রয় এবং জয়ন্তীনায়কের আদিগুরু পিতামাতার মুখ সন্দর্শনে গ্রন্থ পাঠের ব্যাকুলতা বাড়বে বৈকী!

ভেনেসা’র জীবনমুখী কবিতার পড়েই চোখ পড়বে দেবপ্রিয় বড়ুয়ার সহাস্যবদনের অভিমুখে। সংঘরাজসংঘনায়ক, বিশিষ্ট রাজনীতিক ও বৌদ্ধ দর্পনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের উচ্ছ্বাস বাণীতে মুখোরিত অংশ পেরুলেই সূচিপত্র। এর পরেই চেনাঅচেনা দেবপ্রিয় বড়ুয়ার সন্ধানে লেখকপাঠকের বহুমাত্রিক ভ্রমণ। আমি যখন পাঠপরিক্রমাটি সম্পন্ন করছি তখন হয়তো সূচিতে নামাঙ্কিত বহু লেখক কবিগুরুর ভাষায় গানের ওপাড়ে। যে বিষয়টি সূচিক্রমে শূন্য মনে করেছি তা হলো পর্যায় নির্ণয়। মোট চার পর্যায়ে মূল লেখকের লেখনী ও জয়ন্তী নায়কের অভিভাষণ ছাড়াও দায়িত্বশীলদের কথামালা নিবন্ধিত রয়েছে। কিন্তু একজন সমাজব্যক্তিত্বের সন্ধান বহুমাধ্যমে বহুমাত্রিকতায় সম্পন্ন করার কাজটি সূচিতে অনুপস্থিত। মূল জীবনালেখ্য নিপুণ চয়নে সম্পন্ন করেছেন যুব নেতৃত্বের দ্যুতি ড. সুব্রত বরণ বড়ুয়া। লেখক মহোদয় সময়ের ব্যতিব্যস্থতায় জয়ন্তীনায়কের সমশীলা গৌরী মহোদয়ার ত্যাগদীপ্তি অপেক্ষাকৃতভাবে কমই তুলে ধরার কথা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। এছাড়াও বিদগ্ধজনের দৃষ্টিতে দেবপ্রিয় বড়ুয়াএই অংশ কমপক্ষে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে বিভক্ত হলে উপর্যুক্ত ব্যক্তির আলোচনা প্রাণবন্ত হতো। ব্যক্তি দেবপ্রিয় বড়ুয়াকে তাঁর সাংগঠনিক অগ্রজরা যে দৃষ্টিকোণে পর্যালোচনা করবে, একই ভঙ্গিমা সতীর্থের মধ্যে থাকেনি। একইভাবে অনুজ কিংবা ঘনিষ্ঠ জনের পর্যালোচনার তারতম্যটুকু স্পষ্ট করার জন্য আরো উপপর্যায়ের অনুভব আমি বারবার করেছি। লেখকের ভিন্নতা থাকলেও কয়েকটি বিষয়ে সকল লেখক কেন্দ্রীয় মতামত প্রদান করেছেন। তা হলো সীমার মাঝে অসীম দেবপ্রিয় আজ পরিণত এবং পরিগণিত। কিন্তু সুনির্দিষ্ট স্মৃতিচারণ যেন ব্যক্তি দেবপ্রিয় মহোদয়ের অতীতের ব্যবচ্ছেদ করেই ক্ষান্ত হয়েছে। লেখকসূচির জৈষ্ঠ্যতম লেখক ড.প্রণব কুমার বড়ুয়ার অনুপম স্মৃতির আহ্বানে দিব্যমূর্তির বোধন ঘটেছে। শিশু থেকে পরিণত সংগঠক হবার যে সংগ্রাম তা সুললিতভাবে অভিনন্দিত হবার যোগ্য। সম্প্রতি লেখকও মহাকালের সন্ধানে নির্গত হয়ে বুঝিয়ে দিলেনআছে মৃত্যু আছে দুঃখ ..

মূলত যে চর্যার কল্যাণে দেবপ্রিয় বড়ুয়ার বিচরণ দেশ হতে দেশান্তরে সেই প্রচার সংঘে আত্মনিবেদনই প্রয়াত ড. বড়ুয়ার জীবন সায়াহ্নের লেখনীতে স্পষ্ট হয়েছে। একে একে সকল লেখকের সন্ধিৎসু শব্দমালা ছুটেছে তাঁর ব্যক্তিত্ব, পারিবারিক ঐতিহ্য, পারিবারিক বন্ধন ও সাংগঠনিক যোগসূত্রের দিকে। বজ্রযোগিনীর সুসন্তান ড.নূহউলআলম লেনিন মহোদয় লেখনীর উপসংহারে দু’টি শব্দে ব্যবহার করে নতুন এক দেবপ্রিয়ের সন্ধান দিলেন। সেই শব্দযুগল হলোবুদ্ধিবৃত্তিক জ্যোতির্ময়তা!

শব্দদ্বয়ের সূত্রধরে ড.সুকোমল বড়ুয়ার লেখনীতেই পেলাম ব্যতিক্রম দেবপ্রিয় বড়ুয়া সন্ধান। লেখকের বক্তব্য হলোআমি তাঁকে দেখেছি তাঁর ভেতরেবাইরে, সমাজউপলব্ধিতে, চিন্তাভাবনা ও নেতৃত্বের বিমেষত্ব। অবশ্য বাহ্যিক বিশেষত্ব হিসেবে প্রত্নতাত্ত্বিক ড. মোকাম্মেল এইচ ভূঁইয়া দেবপ্রিয় মহোদয়ের প্রাণবন্ত হাসির প্রশংসাও করেন। একই বক্তব্যের স্রোতে অনুভব করলাম প্রফেসর রীতা দত্ত মহোদয়ার একটি বাক্য। তিনি উল্লেখ করেছেনবর্তমান স্বার্থসর্বস্ব মানুষের মধ্যে তিনি একজন বিরল মানুষ। প্রফেসর (ডা.) প্রভাত চন্দ্র বড়ুয়া মহোদয় দেবপ্রিয় চর্চায় আন্দোলিত হয়ে উল্লেখ করলেনশ্রী দেবপ্রিয় বড়ুয়া আমাদের অনাগত সমাজকর্মীদের দুর্জয়ী প্রেরণা হবে।

স্মৃতির পদ্মপাড়ে হারানোর সংলাপে কেবল ভালোবাসার উচ্চারণ করলেন শিশুসাহিত্যিক রাশেদ রউফ। একই সুরে প্রেরণার আবাহন ঘটালেন তীক্ষ্ণ গবেষক অধ্যাপক শিমুল বড়ুয়া। এভাবে সত্তুরোর্ধ্ব এক প্রাণচঞ্চল ব্যক্তিতের সন্ধান করেছে আশি জনের মস্তিষ্ক। প্রফেসর ড. সুমন কান্তি বড়ুয়া মহোদয়ের একটি উচ্চারণ লেখকের বিমূর্ত সন্ধানের ফলকে পরিণত হয়। সেই বিষ্ময়কর শব্দটি হলো কর্মপিয়াসী! একই লেখক আলোচিত ব্যক্তিকে উচ্ছায়ী চৈতন্যের উদ্ভাসক হিসেবে আখ্যায়িত করেন। বস্তুত এখানেই সমস্ত সন্ধানের সমাপনী বার্তা লুকিয়ে রয়েছে। রূপকায়ের দেবপ্রিয় বড়ুয়ার সন্ধান একজীবনে ক’জন করবে? কিন্তু ঐ যে ডা. প্রভাত চন্দ্র বড়ুয়া মহোদয়ের একটি উচ্চারণ দৃষ্টিসীমায় ধরা দিলো! তিনি আমাদের সমাজব্রতীদের দুর্জয়ী প্রেরণার উৎস। এই উৎস সন্ধানের জন্য গ্রন্থের ভিতরেবাইরে অজস্র ইতিহাস নথিবদ্ধ হলো। কবিগুরুর মত এই স্মারকগ্রন্থ মঙ্গলময় অনাগতের উদ্দেশ্যে উচ্চারণ করবেআজি হতে শতবর্ষ পরে

বৌদ্ধ নিকায়গ্রন্থেও বলা হচ্ছে মানুষের কর্ম জরাপ্রাপ্ত হয় না। ব্যাধির নিগড়ে বন্দী হয় না। সমাজকর্মে প্রেরণার দিব্যবিগ্রহ দেবপ্রিয় বড়ুয়া’র জীবনস্রোতের ত্যাগ ও কর্ম সঞ্চয়েও তথাগত বুদ্ধের এই বাণী চিরন্তন। এই নির্মল হাসি চিরন্তন হবে না। এই কর্মপ্রিয়তাও জরার অধীনে নির্বাসিত হবে, যেভাবে কর্মগুণে শ্রীযুক্ত দেবপ্রিয় বড়ুয়া প্রদীপ্ত হয়েছিলেন। সময় স্রোতই তাঁকে নিরব করে দিবে। কিন্তু যে ত্যাগ, আত্মদান, সময়দানসবকিছুর অন্তরালে যে কিঞ্চিত প্রত্যাশা আমাদের প্রতি তাঁর থাকবে তা কেবল একটি উচ্চারণেই চিরতরে নিরুদ্দেশ হবে। আমরা যদি উচ্চারণ করতে পারিদেবপ্রিয়ের নাম এই বলে খ্যাত হোকতিনি আমাদেরই লোকতাঁর রয়েছে সমগ্র বিশ্বালোক।

লেখক

ছাত্র, পালি বিভাগ, চবি

পূর্ববর্তী নিবন্ধনতুন বছরে দেশের মানুষ থাকুক দুধে-ভাতে
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে