একজন মধ্যবয়সী সফল মানুষের কথা তার মুখেই পাঠকের জন্য। সংগত কারণে নামটা উহ্য রাখা হলো।
আমি খুব ভালো করেই জানি আমাকে নিয়ে অনেক ধরণের গসিপ আছে বাজারে। অনেক চটকদার কথা আছে, নানা রঙের মসলা দেয়া পানের মতো। আমার সামনে যারা তোষামোদে ব্যতিব্যস্ত থাকে চোখের আড়ালে গেলে তারাই আমাকে ‘বাজে মহিলা’ বলে গালি দেয়।
প্রথম প্রথম খুব অস্বস্তি হতো। এখন গা সয়ে গেছে। আমি শুনেও শুনি না। দেখেও দেখি না। এমন অন্ধ, বধির হওয়ার মধ্যে শান্তিও আছে। নিন্দাচার, অপবাদ, কুৎসা এগুলো আমি এখন থোড়াই কেয়ার করি। বাচ্চাদের জন্য মাঝে-মাঝে খারাপ লাগত। কারণ আমাকে নিয়ে যার যেমন ইচ্ছা মতো নিন্দাচার করা মানুষগুলোর কাছে আমি কেবলই এক নারী, যার স্বামীর সাথে জটিলতা আছে, সে একা থাকে না দোকা থাকে, স্বামীপরিত্যক্তা হয়েছি কিনা নিশ্চিত নয়, অন্য পুরুষে আসক্ত কিনা, কর্মক্ষেত্রে আমার উত্থানের পেছনে আমার যোগ্যতার চেয়েও বসদের খুশি করার কথা, বসদের সাথে দহরমমহরম করার কথাই থাকে সবার মুখে মুখে, এবং ঈর্ষান্বিত চোখে কামুকের দৃষ্টিও আড়াল না হওয়া সেই অনেকের কাছে আমি একজন বাজে মহিলা হলেও আমার সন্তানদের চোখে আমি কেবলই মা।
তাই তাদের কানে যদি কখনো, কোনো এক মুহূর্তে কারো সামান্যতম অসাবধানতায় কিংবা অতি মাত্রার কৌতূহলতায় আমার সম্পর্কে কোনো নেতিবাচক কথা কেউ মুখ ফসকে বলে ফেলে আমার সন্তানদের হৃদয়ে যে ক্ষরণ হতে থাকে তা আমি টের পাই। আর তাই একদিন সাহস করেই সন্তানদের মুখোমুখি হয়েছিলাম। মনে হয়েছিল যাদের জন্য একটা জীবন শুধুই কমেপ্রামাইজ করতে চেয়ে এ পর্যন্ত পথ হেঁটে এসেছি, পথের বাঁকে-বাঁকে ফেলে রাখা কাঁটার স্তুপ মাড়াতে গিয়ে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছি, বুকের ভেতরে চিনচিনে ব্যথা লুকাতে লুকাতে হৃদয়টাকে নানা ব্যাধিতে পূর্ণ করে রেখেছি তাদের কাছে তো অন্তত নিজেকে মেলে ধরা যায়।
মায়ের আকুলতা যেমন শাশ্বত, সন্তানের আকুলতা তেমনই শাশ্বত। আহ! কি যে প্রশান্তি ছুঁয়ে গিয়েছিল সেদিন আমাকে! সন্তান সে-যেন জীবনের আরেক নোঙর!
বাবার বাড়ির অতি শৃংখলিত জীবনের আড়ালে গভীর সমুদ্রে নিমজ্জমান ছিল আমার একজন মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার বাসনা। বন্ধুরা পিকনিক করবে, বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়াবে, হৈ-চৈ করতে করবে, আমি থাকতাম দর্শক হয়ে, আমার ঘরে বন্ধুদের সাথে পিকনিকে যাবার অনুমতি ছিল না। বন্ধুরা পিকনিক শেষে ফিরে আসলে আমি হয়ে যেতাম শ্রোতা। সেইসব পিকনিক কিংবা আনন্দ আয়োজনে অনেক ছেলে বন্ধুর সাথে আরও অনেক মেয়ে বন্ধুও ছিল। তবু শৃঙ্খলতার দোহাই মাড়াতে পারিনি কখনো। খুব মন খারাপ হতো! গোপনে চোখের পানি মুছেছি কত! ভাবতাম হয়তো একদিন সব শৃঙ্খল পায়ে মাড়িয়ে কেউ একজন আমাকে আমার স্বপ্নময় গন্তব্যে ঠিক পৌঁছে দিবে।
অনেকটা স্বপ্নের মতোই জীবনে এসেছিল একসাথে পথ চলার মানুষটি। এবার আর ভয় পাইনি শৃঙ্খল ভাঙতে। আহা! আজও স্বপ্নের মতোই বেঁচে আছে দিনগুলি। তারপর, হ্যাঁ, কেমন করে যেন সুর কেটে গেল, তাল কেটে গেল। বেসুরো কন্ঠের গানের মতো বেসামাল জীবন। ততদিনে জীবন শুধু ‘তোমার আমার’ পেরিয়ে পৌঁছে গেছে ‘আমাদের’ পর্যায়ে।
কত রাত কেটে গেছে দূর আকাশ পানে চেয়ে-চেয়ে। ‘ইনসমনিয়া’ও ততদিনে নিশ্চিত ঠিকানা একটা খূুঁজে নিয়েছে। নিত্য অশান্তি, কোলাহল, খিস্তি, খেউর কোনোকিছুই বাদ যায়নি জোড়াতালির সংসারে।
হেরে যাওয়ার কষ্ট কি ভয়ংকর!! আহ! শৃঙ্খলিত জীবন! আহ! স্বপ্নীল জীবন!
কিন্তু জীবন তো ততদিনে আমাদের!
তারপর একদিন অবশেষে দুজনের দুটি পথ দুটি দিকে গেছে বেঁকে। কিন্তু মাতৃত্ব! সে-তো জীবনের পরতে-পরতে আষ্টেপৃষ্ঠে মায়ার বাঁধনে বেঁধে রাখে সকল অভাগা’রে। তা না হলে এ-জীবন কবেই হয়ে যেত দোয়েলের, ফড়িং- এর কিংবা ডানা মেলা সোনালি চিলের….।
সন্তানেরা বড় হচ্ছে। নিজের জীবন নিয়ে স্বপ্ন দেখার সময় হচ্ছে। নিজেকে কেমন যেন একা একা লাগে। মনে হয় দিন শেষে কারো সাথে সারাদিনের গল্পগুলি করি। নির্ঘুম রাত কাটানোর সময় মনে হয় কেউ যদি পাশে থাকত! একা একা কেমন হাঁসফাঁস লাগে। ছুটির বিকালগুলোতে একচিলতে বারান্দায় বসে কফি খাওয়ার একজন সঙ্গী খুব মিস করি। মিস করি নিজের একজন মানুষকে। এসব মিস করার কথা আবার সাহস করে কাউকে বলা যায় না। বললেই তো আমার চরিত্রের বাজার খুলে বসবে সবাই। শত হলেও আমি একলা থাকা নারী কিনা। স্বামীর বাহুলগ্না বাধ্য স্ত্রী তো নই। তাই আমার হাপিত্যেশ শোনার জন্য হয়তো প্রস্তুত নয় সমাজ এবং সমাজসেবীগণ। বিধবাদের জন্য তবু কিছুটা জায়গা আছে এ-সমাজে, একা কিংবা দোদুল্যমান জীবন নিয়ে চলা নারীর জন্য কোনো জায়গাই নেই।
অনেকটা পথ পেরিয়ে এসে উপলদ্ধি: দিনশেষে প্রতিটা মানুষই একজন আলাদা মানুষ। পৃথিবীর তাবৎ সম্পর্কের বন্ধন ছাপিয়ে প্রতিটা মানুষই একজন একা মানুষ। সেই একা মানুষটাকে কেন কেউ বোঝে না? কেন তার নিজের কথাগুলো নিরবে এক একটা দীর্ঘশ্বাসের দিকে এগিয়ে যায়? এমন একটা জীবন কি চেয়েছিলাম কখনো? কোনো এক অসাবধানী মুহূর্তে?
পুনশ্চ: একজন মধ্যবয়স্ক সফল কর্মজীবী মানুষের কথা। ইচ্ছে করেই পরিচয়টা এড়িয়ে গেলাম। জীবনের অনেক চড়াই-উৎরাই তিনি পেরিয়েছেন। মুখোমুখি হয়েছেন নানারকম প্রতিকূলতার। কিন্তু হাল ছাড়েননি। জানেন, সামনে আরো অনেক পথ বাকি। তারপরও ইদানীং বড্ড ক্লান্তি অনুভব করেন তিনি। প্রায় ভাবেন, একটাই তো জীবন, তবু কেন এত বাঁক! কেন ক্ষণেক্ষণে বাঁক বদলের এত দুর্বার চেষ্টা! একটু জিরোতে ইচ্ছে করে। ছায়াবৃক্ষের নীচে একটু বসতে ইচ্ছে করে। নির্ভার একটা ঘুমের কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে ইচ্ছে করে।