মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক–ই–আজম বীর প্রতীক বলেছেন, রাজনীতিবিদরা যেভাবে নীতি ও দিকনির্দেশনা প্রদান করেন, প্রশাসনের কর্মকর্তারা সেই নির্দেশনার আলোকে কাজ করেন। প্রশাসন বা সিভিল সার্ভিসই হলো রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রাণশক্তি, দেশের উন্নয়ন ও নীতি বাস্তবায়নের মূল চালিকা শক্তি। আমরা যদি প্রত্যেকে নিজ নিজ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করি, প্রকৃত পেশাদারিত্ব অর্জন করি, তবে দেশ পরিচালনা আরও কার্যকর, জবাবদিহিমূলক ও জনগণমুখী হবে। আমলাতন্ত্র, রাজনীতি ও নাগরিক সমাজ–সবাই মিলে একটি ন্যায্য, সুশাসিত ও উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারব। গতকাল নগরীর আগ্রাবাদে দি চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সম্মেলন কক্ষে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস এসোসিয়েশনের আয়োজিত ‘আমলাতন্ত্রের ফারুক–ই–আজম বীর প্রতীক
পেশাদারিত্ব : চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক এক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে উপদেষ্টা এ কথা বলেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার ও বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস এসোসিয়েশন, চট্টগ্রাম বিভাগের সভাপতি ড. মো. জিয়াউদ্দীন।
সেমিনারের শুরুতেই চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ও বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস এসোসিয়েশন, চট্টগ্রাম জেলার সভাপতি সাইফুল ইসলাম স্বাগত বক্তব্য রাখেন। এছাড়া সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের যুগ্ম সচিব ড. মো. মিজানুর রহমান। মুখ্য বিশ্লেষক ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মুহাম্মদ ইয়াহইয়া আকতার। আলোচক ছিলেন চবির লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক প্রফেসর ড. আমির মুহাম্মদ নসরুল্লাহ। সেমিনারে বিশেষ অতিথি ছিলেন ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার ও বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস এসোসিয়েশন, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি মহাসচিব শরফ উদ্দিন আহমদ চৌধুরী এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব ও বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস এসোসিয়েশন, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সভাপতি মো. নজরুল ইসলাম। এছাড়াও সারা বাংলাদেশ থেকে এসোসিয়েশনের সদস্যরা জুম প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন। উপস্থিত অতিথিরা আমলাতন্ত্রের পেশাদারিত্ব, চ্যালেঞ্জ, দেশের জনপ্রশাসনের গতিপ্রকৃতি ও প্রত্যাশা নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা উপস্থাপন করেন। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষার আলোকে আগামী দিনের জনপ্রত্যাশার জনপ্রশাসন নিয়ে অনেক ইতিবাচক, নেতিবাচক, আত্মসমালোচনা ও গঠনমূলক বক্তব্য, পরামর্শ ও প্রত্যাশা বক্তাদের বক্তব্যে উঠে আসে।
সেমিনারের মূল প্রবন্ধ উপস্থাপক ড. মো. মিজানুর রহমান তার বক্তব্যে বলেন, যেকোনো বিষয়ের গভীরে যেতে হলে তার উৎপত্তি বিশ্লেষণ করা জরুরি। যদি আমরা প্রকৃত অর্থে পেশাদারিত্ব অর্জন করতে পারি, তাহলে দুর্নীতি স্বাভাবিকভাবেই হ্রাস পাবে। দায়িত্ব পালনকালে আমাদের কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যা পেশাদারিত্বের মান ক্ষুণ্ন করে। এর মধ্যে রাজনৈতিক প্রভাব, দক্ষতার ঘাটতি, প্রশাসনিক দুর্নীতি এবং আমলাতান্ত্রিক জড়তা অন্যতম। এই বাধাগুলো অতিক্রম না করলে পেশাদারিত্বের আদর্শ পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, আমাদের পেশাদারিত্ব মূল্যায়নের ক্ষেত্রে কেবল পদ বা অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর না করে, পারফরম্যান্স বা কর্মফলভিত্তিক মূল্যায়ন প্রবর্তন করতে হবে। এতে প্রকৃত যোগ্যতা ও কর্মদক্ষতার স্বীকৃতি নিশ্চিত হবে।
প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার বক্তব্যে বলেন, সামপ্রতিক গণঅভ্যুত্থানের পর যে পরিবর্তনের স্রোত বইতে শুরু করেছে, তা দেখে আমি সত্যিই আনন্দিত। এখন দেশের প্রতিটি মানুষ, বিশেষ করে প্রশাসনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই, নতুন করে দেশের জন্য কিছু করার অনুপ্রেরণা অনুভব করছেন। এটি একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা। উত্তরণের পথ নিয়ে তিনি বলেন, পেশাদারিত্ব বৃদ্ধির জন্য মেধাভিত্তিক নিয়োগ, সঠিক প্রশিক্ষণ, দক্ষতা উন্নয়ন, পারফরম্যান্স ব্যবস্থাপনা, নৈতিক মূল্যবোধ চর্চা ও জবাবদিহিতামূলক প্রশাসনিক সংস্কৃতি গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি। একই সঙ্গে সুশাসন, ই–গভর্নেন্স, উদ্ভাবন ও নীতি–ভিত্তিক সিভিল সার্ভিস সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যদি আমরা এই মূল্যবোধগুলোকে প্রশাসনিক সংস্কৃতিতে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পারি, তবে বাংলাদেশে একটি আধুনিক, দক্ষ ও নীতিনিষ্ঠ আমলাতন্ত্র গড়ে উঠবে, যা নাগরিকের আস্থা অর্জন করবে এবং দেশের টেকসই উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
মো. নজরুল ইসলাম বলেন, আমরা যারা সিভিল সার্ভেন্ট, আমরা সবাই আইনের শাসন ও নিয়মের কাঠামোর মধ্যে থেকেই কাজ করতে চাই। কিছু বিচ্ছিন্ন উদাহরণ বাদ দিলে, অধিকাংশ সরকারি কর্মকর্তা সততা, দায়িত্ববোধ ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, প্রশাসনের কার্যকরিতা ও পেশাদারিত্ব বৃদ্ধিতে রাজনৈতিক নেতৃত্বের দিকনির্দেশনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাজনীতিবিদদের সদিচ্ছা ও সহায়তা থাকলে আমরা আরও ভালোভাবে কাজ করতে পারব, জনগণের কল্যাণে আরও বেশি অবদান রাখতে পারব। তিনি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেন, আমরা যদি আমাদের দায়িত্ব সততা, নিষ্ঠা ও দক্ষতার সঙ্গে পালন করি, তবে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও জাতীয় উন্নয়নে আমলারা একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অনন্য ভূমিকা রাখতে পারবে।
সেমিনারের সভাপতি তার সমাপনী বক্তব্যে সেমিনারে অংশগ্রহণ করে দিক–নির্দেশনা, গঠনমূলক ও বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা করার জন্য প্রধান অতিথিসহ আমন্ত্রিত অতিথি এবং অংশগ্রহণকারী সকলকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সেমিনারে সমাপ্তি ঘোষণা করেন।












