ইরান এবং আফগানিস্তান এ–দুটি দেশ সুপ্রাচীন সভ্যতার লীলাভূমি। প্রথমটি পারস্য সভ্যতা এবং দ্বিতীয়টি ভারতীয় সভ্যতার আকর ক্ষেত্র। কিন্তু এ–সময়ে এসে দেশ দুটি নিজের পায়ে কুড়াল মেরে চলেছে অবিরত। ধ্বংস করেছে প্রাচীন সেসব সভ্যতার বিভিন্ন নিদর্শন; পুরাকীর্তি, স্থাপত্য, ভাস্কর্য, গ্রন্থরাশি। কেবল এটুকুতেই ওরা থেমে নেই। হত্যা করছে শিল্প সংস্কৃতি সংশ্লিষ্ট প্রথিতযশা ব্যক্তিত্ব ও কর্মীদের নৃশংসভাবে। কখনও গুপ্তভাবে, কখনও প্রকাশ্যে।
যে ধর্মের দোহাই দিয়ে তারা এসব অপকর্ম করে চলেছে বছরের পর বছর, সে ধর্ম মানবতার কথা বলে, বলে সহনশীলতার কথা, বলে সৃষ্টিশীলতার কথাও। সাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, স্থাপত্য, নাট্যকলা, চিত্রকলা, রন্ধনশিল্প, বস্ত্রশিল্প, বিজ্ঞান প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই ধর্মের অনুসারীরা যুগ যুগ ধরে মৌলিক অবদান রেখে এসেছেন। মধ্য উত্তর এশিয়ার দেশগুলো এর প্রকৃষ্ট সাক্ষ্য বহন করে।
অথচ বানোয়াট কিছু অজুহাত দেখিয়ে এদেশ দুটি ধর্মকে নিজেদের ক্ষমতার স্বার্থে ব্যবহার করে অমানবিক যত কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে। এর সাম্প্রতিক উদাহরণ ইরানের রাজধানী তেহরানে ঘটে যাওয়া এক ন্যক্কারজনক ঘটনা, যার আশানুরূপ প্রতিবাদ তেমন কোথাও হয়নি।
গত ১৩ অক্টোবর তেহরানের শহরতলীতে সস্ত্রীক খুন হয়েছেন ইরানি চলচ্চিত্রের প্রধান চলচ্চিত্রকার দারিয়ুস মেহেরজুই। যে–মানুষটি ইরানের সিনেমাকে সারা বিশ্বের কাছে পরিচিত করে তুললেন তার ‘দি কাউ’ ছবিটির মাধ্যমে, যে মানুষটি ইরানের সিনেমাকে পথ চলার ঠিকানার হদিস এনে দিলেন তাঁকেই কিনা প্রাণ দিতে হলো বেঘোরে! ৮২ বছর বয়সে তাঁর এই মর্মান্তিক পরিণতি কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। যাঁর যাবার কথা বীরের মতো, তিনিই কিনা বিদায় নিলেন গুপ্তঘাতকের হাতে নৃশংসভাবে।
ইরানের চলচ্চিত্র আজ সারা বিশ্বে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত। তার রয়েছে চমৎকার একটি ঘরানা। আব্বাস কিয়ারোস্তমি, মোহসেন মাখমালবাফ, জাফর পানাহি, মাজিদ মাজিদি, বাহরাম বেহজাই, আমিন আমিনিসহ আরও বেশ কয়েকজন চলচ্চিত্র পরিচালক ইরানের সিনেমাকে রীতিমতো ঈর্ষণীয় একটি অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছেন। অথচ এঁদের অনেকেই আজ বিদেশে স্বেচ্ছা নির্বাসনে রয়েছেন শাসক শ্রেণির আতঙ্কে। যে আব্বাস কিয়ারোস্তমি এক নামে ইরানের চলচ্চিত্র দুনিয়ার প্রতিনিধিত্ব করে গেছেন তাঁকেও জীবনের বেশিরভাগ সময় নির্বাসনে কাটাতে হয়েছে প্যারিসে। জাফর পানাহি অনেক বছর ধরে কারান্তরীণ। ইরানের অনেক অভিনয়শিল্পী ও কলাকুশলী আজ কারাবাসী। যাঁদের সিংহভাগ নারী। কি এক অরাজক পরিস্থিতি যে চলছে ইরানের শিল্পসংস্কৃতির জগৎকে ঘিরে তা রীতিমতো ভয়ংকর ও মানবতাবিরোধী। ইরানে সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া নারী আন্দোলন ও দমন পীড়নের মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণে নেয়ার জন্যে সে দেশের শাসক মহলের বিরামহীন চেষ্টা এর আরেকটি অসহনীয় নজির। এর ফলে তথাকথিত নীতি পুলিশের হাতে খুন হয়েছেন একজন নারী। অসংখ্য প্রতিবাদী নারী আটক হয়েছেন।
তবে ১৪ অক্টোবরের ঘটনাটি বলতে গেলে আত্মঘাতী। এতে সরাসরি সরকারি সম্পৃক্ততা ওপর থেকে দেখা না গেলেও সরকারি মদদের ব্যাপারটি সহজেই বোঝা যায়। ১৪ অক্টোবর তেহরানের শহরতলী এলাকার বাড়ির পাশে দারিয়ুস মেহেরজুই ও তাঁর স্ত্রী তাহিদিয়া মোহাম্মদির ক্ষতবিক্ষত মরদেহ পুলিশ উদ্ধারের পর জানিয়েছে এটা ‘গুপ্তহত্যা’। কোনো তদন্তের পূর্বেই তারা এটা জানিয়েছে। যদিও পুলিশ বলেছে, ‘জোর তদন্ত চলছে’। যে মানুষটি দেশের জন্যে সারাজীবন ধরে এতকিছু করে গেলেন তার বিনিময়ে তিনি ও তাঁর স্ত্রী স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা থেকেই বঞ্চিত হলেন। ৮২ বছর বয়সে ছুরিকাঘাতে প্রাণ বিসর্জন দিতে হলো দারিয়ুসকে সস্ত্রীক। ধীরে ধীরে ঘটনাটি চেপে যাওয়া হবে। খুনিরা কখনও ধরা পড়বে না। হয়তো কিছু সাজানো নাটকও অভিনীত হবে যার সংলাপও বরাবরের মতো পুরোনো। দারিয়ুসের স্ত্রী তাহিদিয়া বেশ কিছুদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অভিযোগ করে আসছিলেন কেউ তাঁদের হত্যার হুমকি দিচ্ছে। অথচ ব্যাপারটি নিয়ে কেউই প্রতিরোধমূলক কোনো উদ্যোগ নেননি।
এরকম ঘটনা একসময় লাতিন আমেরিকার দেশে দেশে সামরিক জান্তাদের আমলে ঘটতো। সেসব দিনগুলিতে এই মহাদেশের বিভিন্ন দেশে শত শত চলচ্চিত্র পরিচালক, অভিনয়শিল্পী ও কলাকুশলী খুন, গুম ও কারাবন্দী হয়েছিলেন। কারণ তারা জান্তাবিরোধী আন্দোলনে শরিক হয়েছিলেন চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে।
দারিয়ুস মেহেরজুই–এর প্রতিনিধিত্বশীল চলচ্চিত্র ‘দি কাউ’ এর কথা শুরুর দিকে বলেছি। তুলনা করে বলা যায়, দারিয়ুস হলেন ইরানের সত্যজিৎ রায় এবং ‘দি কাউ’ হলো ‘পথের পাঁচালী।’ দারিয়ুসের জন্ম ১৯৪০ সালে তেহরানে। কৈশোর উত্তীর্ণ বয়সে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে দর্শন ও চলচ্চিত্রে অধ্যয়নের শেষে স্বদেশে ফিরে এসে চলচ্চিত্র নির্মাণে যুক্ত হন। প্রথম ছবি ‘দি কাউ’ নির্মাণ করেন ১৯৬৯ সালে। একটি গরুর হারিয়ে যাওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছবিটির আখ্যানভাগ গড়ে উঠেছে। ছবির মূল চরিত্র একজন হতদরিদ্র কৃষক যে তার একমাত্র সম্পদ গরুটিকে হারিয়ে শোষণতন্ত্রের যাঁতাকলে পড়ে প্রায় উন্মাদ হয়ে যায়। এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে দারিয়ুস ইরানের সামাজিক ব্যবস্থার অনিয়ম, অবিচার, অশিক্ষা, আমলাতন্ত্র এসবের সমালোচনা করেছিলেন। ফলে শুরু থেকেই তিনি তৎকালীন শাহ সরকারের বিরাগভাজন হন।
দারিয়ুস মেহেরজুইয়ের সবচেয়ে সাড়া জাগানো চলচ্চিত্র ‘দি সাইকেল’। ১৯৭৫ সালে মুক্তির পর পর শাহ সরকার ছবিটির দেশে বিদেশে প্রদর্শন নিষিদ্ধ করেন এবং দারিয়ুসের ওপর নানারকম বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। ১৯৭৭ সালে ছবিটি প্যারিসে প্রদর্শিত হলে সারা বিশ্বে ছবিটি নিয়ে রীতিমতো আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এক দরিদ্র কৃষক সন্তান আলির জীবনকে কেন্দ্র করে ইরানের সামাজিক অবক্ষয়ের চিত্র এ–ছবিতে চিত্রায়িত করা হয়েছে।
দারিয়ুসের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রগুলো; ‘দ্য জান্্ক হাউস’, ‘দ্য পোস্টম্যান’, ‘দ্য টেনান্টস’ ‘শিরাক’, ‘হামুন, ‘বানু’ ‘সারা’, ‘পরী’, ‘ লেইলা’। প্রতিটি চলচ্চিত্রে তিনি ইরানি সমাজ কাঠামোর অনিয়ম অত্যাচার, অবিচার, শোষণ, নিপীড়ন, এক কথায় সামগ্রিক অবক্ষয়ের কথা বলে গেছেন সাহসের সঙ্গে জীবনের ঝুঁকিকে উপেক্ষা করে। কোনো ভয় ভীতি, হুমকি ও প্রতিবন্ধকতায় থেমে থাকেননি ১৯৬৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত।
পরাক্রমশালী রাজতন্ত্রের ধারক শাহ সরকার দারিয়ুস মেহেরজুই এর কর্মকাণ্ডে নানারকম প্রতিবন্ধকতা তৈরি করলেও তাঁর জীবননাশ করার উদ্যোগ নেননি। কিন্তু বর্তমানের ধর্মাশ্রয়ী সরকারের আমলে এই বয়োজ্যেষ্ঠ চলচ্চিত্রকারকে ৮২ বছর বয়সে নির্মমভাবে প্রাণ হারাতে হলো। এই হলো বীরের প্রতি রাষ্ট্রের উপহার।
সিনেমা দুনিয়ার ইতিহাসে সাহসী, নির্ভীক ও সৎ চলচ্চিত্রকার হিসেবে দারিয়ুস মেহেরজুই–এর নাম অবশ্যই মর্যাদার সঙ্গে লিপিবদ্ধ থাকবে যা সাহস যোগাবে আপোষহীন চলচ্চিত্র নির্মাতা ও কর্মীদের। যুগ যুগ জিয়ো–দারিয়ুস মেহেরজুই।