দারিদ্র ও বেকারত্ব নিরসনে আত্মকর্মসংস্থান

বাসুদেব খাস্তগীর | বুধবার , ২৮ এপ্রিল, ২০২১ at ৭:৩৬ পূর্বাহ্ণ

কর্মসংস্থান যে কোন দেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শিল্প,বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে সমৃদ্ধ দেশগুলো নিজের দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেই শিল্পে সমৃদ্ধ হয়েছে। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি দেশের শিল্পায়ন, ব্যবসায় বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ওপর নির্ভর করে। স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ অনেক সীমিত তার নানান সীমাবদ্ধতার কারণে। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি না হলে দেশে বেকারত্ব বেড়ে যায়। বলা হয় বেকারত্ব সমাজের অভিশাপ। প্রচুর বেকার থাকা মানে সমাজে এক ধরনের অস্থিরতা। আর শিক্ষিত শ্রেণির মানুষের বেকারত্ব মানেই এক ধরনের দুর্বিষহ মানসিক যন্ত্রণা। সমাজে বেকারত্ব বেড়ে গেলে সামাজিক অনাচার ও অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যায়। দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে আত্মকর্মসংস্থানের বিষয়টি সামনে আসে এবং আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে বেকারত্ব দূরীভূত করা সম্ভব হয়। একটি রাষ্ট্রের পক্ষে বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে প্রয়োজন আত্মকর্মসংস্থান। আর সেই আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া আত্মকর্মসংস্থানের ক্ষেত্র তৈরি হতে পারে না। বেসরকারিভাবে কিছু হলেও তা কিন্তু বৃহত্তর পরিসরে সামান্যই ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু সমাজের কর্মক্ষম বৃহত্তর শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে যেহেতু রাষ্ট্রের চাকরিতে প্রবেশ করানোর সুযোগ নেই, সেহেতু আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করাই হচ্ছে আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল অন্যতম উপায়। আত্মকর্মসংস্থানের ধারণা হচ্ছে নিজের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নিজেই করা। আধুনিককালে এটি কর্মসংস্থানের একটি উপায়ও বটে। আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে মানুষ তার নিজস্ব স্বাধীনতা বজায় রাখতে পারে এবং নিজের সিদ্ধান্তে অর্থ উপার্জনে আত্মনিয়োগ করতে পারে। মানুষ লেখাপড়া শেষ করে চায় একটি ভালো চাকরি। কিন্তু মেধা থাকা সত্ত্বেও অনেকেই প্রয়োজনীয় পদ না থাকায় পছন্দমত চাকরিতে যোগ দিতে পারে না। একসময় তাকে হতাশায় পেয়ে বসে। এসময় প্রয়োজনীয় অর্থ, পুঁজি, প্রশিক্ষণ নিয়ে সরকার বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আত্মকর্মসংস্থানের ক্ষেত্র তৈরিতে এগিয়ে আসলে বদলে যেতে পারে সেই হতাশাগ্রস্ত মানুষের জীবন। আত্মকর্মসংস্থান এর মাধ্যমে একজন মানুষ নিজেই নয়, এর পাশাপাশি আরো অনেক বেকার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে সমাজ তথা রাষ্ট্রের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। আত্মকর্মসংস্থান রাষ্ট্রের চাকরির চাহিদার ওপর চাপ কমাতে পারে এবং বেকার সমস্যার মত রাষ্ট্রীয় সমস্যা নিরসনে অবদান রাখতে পারে। আত্মকর্মসংস্থানকে একটু ব্যাপক অর্থে আমরা দেখতে পারি। নিজেই নিজের কর্মসংস্থানকে আমরা যদি আত্মকর্মসংস্থানই বলি, কিন্তু ব্যাপারটা কিন্তু একেবারে সহজ কাজ নয়। এটাকে আমরা এক ধরনের ছোটখাটো ব্যবসায় বলতে পারি। ব্যবসায় মানেই ঝুঁকি। ব্যবসার সাথে ঝুঁকি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আত্মকর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও ঝুঁকি রয়েছে। কিন্তু এই আত্মকর্মসংস্থানে যারা জড়িত হবেন তাদের মনে আত্মবিশ্বাস তৈরি খুবই দরকার। নানা ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তৈরি হতে পারে আত্মবিশ্বাস। আর এ আত্মবিশ্বাস আত্মকর্মসংস্থানকে পেশা হিসাবে নিতে উৎসাহিত করে এবং ঝুঁকিও হ্রাস করে। আত্মকর্মসংস্থানের মধ্যে থাকে নিজস্ব অথবা ঋণ করা কিছু সম্পদ, নিজস্ব চিন্তা, জ্ঞান, বুদ্ধিমত্তা ও দক্ষতা। এগুলোকে কাজে লাগিয়ে কিছুটা ঝুঁকি নিয়ে জীবিকা নির্বাহের জন্য আত্মকর্মসংস্থানের পথ বেছে নিতে হয়। চাকরি হচ্ছে মজুরি বা বেতনভিত্তিক একটি পদ্ধতি। আত্মকর্মসংস্থান সেক্ষেত্রে মজুরি বা বেতনভিত্তিক চাকরির বিকল্প একটি পেশা। রাষ্ট্রীয় বা বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি আত্মকর্মসংস্থান পেশা ঐ ব্যক্তি স্বীয় দক্ষতা বা গুণাবলির দ্বারা পরিচালিত হয়। যার মাধ্যমে ব্যক্তি নিজেই অর্থ উপার্জন করে জীবন- জীবিকা চালানোর প্রয়াসে নিবেদিত হয়। দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল রাখতে কর্মক্ষম জনসংখ্যার বৃহৎ অংশকে আত্মকর্মসংস্থানে নিয়োজিত করা গেলে দেশের অর্থনীতির গতিও হবে সচল। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের আর্থ- সামাজিক অবস্থা বিচার বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে এদেশের অধিকাংশ মানুষই নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির। এ শ্রেনির মানুষরা নানা প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে জীবন সংগ্রামে ব্রতী হয়। এক ধরণের আর্থিক অস্বচ্ছলতার মধ্যেও এ পরিবারগুলো পড়াশুনা চালিয়ে যায়। উদ্দেশ্য থাকে পড়াশুনা শেষে একটা চাকরি। কিন্তু পড়াশুনার সাথে প্রাপ্ত ডিগ্রি মিলিয়ে চাকরি মেলানো বড়ই কঠিন। অনেকের মনোবাসনা পূর্ণ হয়। অনেকের মনোবাসনা পূর্ণ হয় না। চাকরি অনেকের কাছে থেকে যায় অধরা এক সোনার হরিণ। কিন্তু চাকরি পায় নি বলে অনেকের মেধা নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ নেই। প্রয়োজনীয় পদ না থাকাতে মেধাসম্পন্ন অনেকেই চাকরিতে জায়গা করে নিতে পারে না। এ রকম উদাহরণ অনেক। বাংলাদেশের মত দেশে এটি একটি চরম বাস্তবতা। যে হারে পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিবছর ছাত্রছাত্রীরা নানা ডিগ্রি নিয়ে বের হচ্ছে তার তুলনায় কর্মসংস্থানের সুযোগ খুবই কম। সুতরাং বেকারত্ব এক ধরনের মহামারির আকারে রূপ নেয়। এ অবস্থায় আমাদের শিক্ষিত সমাজকে ভিন্ন পথ খুঁজতে হবে, সে ভিন্ন পথে হচ্ছে আত্মকর্মসংস্থানের মত পথ বেছে নেয়া এবং এজন্য যথাযথ উদ্যোগ। এখানে থাকবে নিজের স্বাধীনতা, নিজের দক্ষতায় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সফল হবার সম্ভাবনা। আমরা জানি আত্মকর্মসংস্থান শুধু পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত একটি সাধারণ তত্ত্বগত বিষয় নয়। এটি একটি ব্যবহারিক বিষয়। তত্ত্বগত বিষয়ে পড়াশুনা করে আত্মকর্মসংস্থান সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা যায়, কিন্তু সে জ্ঞানকে বাস্তবে কাজে লাগিয়ে নিজেই নিজের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে সফলতা লাভ করার মধ্যেই আসল কৃতিত্ব। চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পরে অনেকেই আত্মকর্মসংস্থানের নিয়োজিত হন, আবার অনেকেই আছেন ছোটখাটো চাকরি ছেড়ে দিয়ে বেছে নিয়েছেন আত্মকর্মসংস্থানে মত পেশাকে। আমাদের মনে রাখতে হবে আত্মকর্মসংস্থান এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা একই সঙ্গে আমাদের সমাজ থেকে দূর করে দিতে পারে দারিদ্র্য ও বেকারত্বের মতো বড় জাতীয় সমস্যাকে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বে পরিচিত এক উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে। এ উন্নয়নশীল দেশে আমাদের সবাইকে আগাতে হবে সমান তালে। শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে চাকরি না পেয়ে হতাশায় নিমজ্জিত হলে চলবে না। আমাদের দারিদ্র ও বেকারত্বকে চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিয়ে সামনে অগ্রসর হতে হবে। আত্মকর্মসংস্থান হতে পারে সে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার হাতিয়ার। বাংলাদেশের আর্থিকভাবে কিছু নিম্নশ্রেণির মানুষ আছেন যারা চাকরির মাধ্যমে ভাগ্য ফেরাতে পারেন না তাদের কাছে আত্মকর্মসংস্থান একটি অমিয় সম্ভাবনার হাতছানি। আত্মকর্মসংস্থান মানুষের জীবনমান উন্নয়ন ও ধনী-গরিবের ব্যবধান অনেকটা ঘোচাতে পারে। এ রকম উদাহরণ আমাদের অনেক আছে। এখানে পৃষ্ঠপোষকতার যে কথা বলা হয়, তা করে দিতে হবে সহজ এবং অবারিত। সরকারি, বেসরকারি ব্যাংক, সরকারের যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, মৎস্য অধিদপ্তর, কৃষি অধিদপ্তর, পশুসম্পদ অধিদপ্তর,এন.জি.ও,ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা সহ আরো নানা প্রতিষ্ঠান পুঁজি বিনিয়োগসহ প্রশিক্ষণ,পরামর্শ দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বেকারত্ব হচ্ছে যন্ত্রণাদায়ক অভিশপ্ত এক জীবন। একটি দেশের উন্নয়নের হাতিয়ার হচ্ছে শ্রমশক্তি। এই শ্রমশক্তির অপচয় মানে উন্নয়ন গতিহীন হওয়া। এ বিষয়টি অনুধাবন করেই সরকারের কাজ হতে পারে আত্মকর্মসংস্থানের মত বিষয়কে সামনে এনে অর্থনীতিকে গতিশীল করার পথকে মসৃণ করে দেয়া এবং বেসরকারি পর্যায়েও অগ্রসর হওয়ার জন্য উৎসাহ উদ্দীপনা সৃষ্টি করা। কারণ রাষ্ট্রের অর্থনীতি বদলে দিতে পারে এমন ক্ষেত্রকে ছোট করে দেখার কোন অবকাশ নেই।
লেখক : শিশুসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক; সহকারী অধ্যাপক, বি এম সি ডিগ্রি কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশ্রমিকের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা প্রসঙ্গে
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাহ