দারিদ্র্য ও বৈষম্য কমাতে সমন্বিত কৌশল গ্রহণ করা জরুরি

| বুধবার , ৩ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ৪:৫৩ পূর্বাহ্ণ

সমপ্রতি প্রকাশিত পিপিআরসিঅর্থ মন্ত্রণালয়ের যৌথ সমীক্ষায় বলা হয়েছে গত ৩ বছরে বেড়েছে দেশের দারিদ্র্য হার। ২০২২ সালের বিবিএসের হিসাবে দেশে অতি দারিদ্র্য ছিল ৫ দশমিক ৬ শতাংশ, সেটি ২০২৫ সালে বেড়ে ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ হয়েছে। এছাড়া সাধারণ দারিদ্র্য হার ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭ দশমিক ৯৩ শতাংশে। নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের মাসিক আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ায় ধারদেনা করে চলছে সংসার। একটি পরিবারের খাবার কিনতে ব্যয় করতে হবে মোট আয়ের ৫৫ শতাংশ। পরিবারে আর্থিক ঝুঁকির মধ্যে সবচেয়ে বেশি চিকিৎসা ব্যয় ৬৭ দশমিক ৪ শতাংশ। ঋণ পরিশোধে যায় ২৭ শতাংশ। বেড়েছে আয়বৈষম্য। এছাড়া নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে দেখা দিয়েছে সবচেয়ে বড় সংকট।

বিশ্বব্যাংকের ‘বাংলাদেশের দারিদ্র্য ও বৈষম্য মূল্যায়ন ২০২৫’ প্রতিবেদনে যে তথ্য উঠে এসেছে, তা উদ্বেগজনক বলে উল্লেখ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলেন, এটি আমাদের নীতিনির্ধারক ও সুশীল সমাজকে গভীরভাবে ভাবিয়ে তোলার জন্য যথেষ্ট। গবেষণায় উঠে এসেছে, দেশের মোট জনসংখ্যার একতৃতীয়াংশ বা ৬ কোটি ২০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে রয়েছে। এই পরিসংখ্যান কেবল একটি সংখ্যা নয়, এটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্তর্ভুক্তিমূলক চরিত্র নিয়েও প্রশ্নের জন্ম দেয়। এই ঝুঁকিকে আরও প্রকট করেছে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি, কর্মসংস্থানের অভাব এবং আয়বৈষম্যের মতো বহুমাত্রিক সমস্যাগুলো। প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৬ সালের পর থেকে প্রবৃদ্ধি তুলনামূলকভাবে কম অন্তর্ভুক্তিমূলক হওয়ায় এর সুফল মূলত ধনীরাই ভোগ করেছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে স্থবিরতা, বিশেষ করে ২০২২ থেকে ২০২৫ সময়ে প্রায় ২৮ লাখ কর্মসংস্থান কমার আশঙ্কা, নারী ও তরুণদের ওপর বড় প্রভাব ফেলেছে। দেখা যাচ্ছে, অতি দরিদ্রদের মজুরি বৃদ্ধির তুলনায় দ্রব্যমূল্য দ্রুত বাড়ায় তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। ফলে দারিদ্র্যের হার ১৮.৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ২২.২ শতাংশে পৌঁছানোর আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

এদিকে, দেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতি খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পিপিআরসি ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত গবেষণায় দারিদ্র্য ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে এমন উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ‘কুইক পোভার্টি অ্যাসেসমেন্ট সার্ভে২০২৫’ পরিচালনা করবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। ১ ডিসেম্বর থেকে শুরু করে ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশের ৩ হাজার ৫৪০টি পরিবার থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হবে।

এ প্রসঙ্গে বিবিএসের মহাপরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান পত্রিকান্তরে বলেন, বিবিএস এ জরিপটি ছোট পরিসরে পরিচালনা করছে। এর মধ্যমে প্রাপ্ত ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে একটি সময়োপযোগী ও হালনাগাদ জাতীয় পর্যায়ের দারিদ্র্য পরিস্থিতি সরকারকে সরবরাহ করা হবে। তিনি আরও বলেন, দারিদ্র্যের হার পরিমাপের একমাত্র গ্রহণযোগ্য উপাত্ত পাওয়া যায় খানার আয় ও ব্যয় জরিপ (হায়েস) হতে, যা সাধারণত বছরব্যাপী পরিচালনা করা হয়। যেখানে সিজনাল ভেরিয়েশন বিদ্যমান থাকে। কিন্তু শর্ট টার্ম সূচকের প্রাক্কলন তৈরির জন্য তুলনামূলক দ্রুত ও প্রয়োজনে হালনাগাদ দারিদ্র্য পরিস্থিতি নিরূপণে কুইক পোভার্টি অ্যাসেসমেন্ট সার্ভে২০২৫ পরিচালনা করা হচ্ছে। এক কথায় বলা যায়, দ্রুত দারিদ্র্য পরিস্থিতি জানতেই এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

জরিপের সঙ্গে যুক্ত একজন কর্মকর্তা বলেন, কোনো ব্যক্তি যদি কোনো ধরনের অর্থনৈতিক কাজ করে আয় করে থাকেন সেই কাজই ওই ব্যক্তির পেশা হিসাবে ধরা হবে। যেমনচাকরি, ব্যবসা, নাপিত, ধোপা ইত্যাদি। তবে এই জরিপে বেকারেরও তথ্য উঠে আসবে। এক্ষেত্রে ১০ বছর বা তার ঊর্ধ্ব বয়সের কোনো ব্যক্তি যদি গত ৩০ দিনে কোনো কাজ খুঁজে থাকেন এবং গত ৭ দিনে কাজ করার জন্য প্রস্তুত থাকেন তাহলে তিনি বেকার বলে বিবেচিত হবেন। কোনো ছাত্র যদি অধ্যয়ন অবস্থায় গত ৩০ দিনে কোনো কাজ খোঁজেন বা গত ৭ দিন কাজ করার জন্য প্রস্তুত থাকেন তিনিও বেকার হিসাবেই বিবেচিত হবেন।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, দারিদ্র্য বিমোচনকে টেকসই করতে হলে কেবল সাময়িক সহায়তা নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি ও কার্যকর নীতি বাস্তবায়ন জরুরি। বিশ্বব্যাংকের সুপারিশ অনুযায়ী, প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে, মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে হবে এবং বেসরকারি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে হবে। বিশেষত উৎপাদনশীল খাতে কর্মসংস্থানের ভিত্তি মজবুত করা এবং লক্ষ্যভিত্তিক সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। দারিদ্র্য ও বৈষম্য কমাতে একটি সমন্বিত ও কর্মসংস্থানকেন্দ্রিক কৌশল গ্রহণ করাও জরুরি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে