কোভিড মহামারীর পর ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বৈশ্বিক মন্দার মধ্যেও বাংলাদেশে ছয় বছরে দারিদ্র্যের হার কমার খবর দিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো– বিবিএস। তবে দেশে দারিদ্র্যের হার কমলেও এই সময়ে পরিবার প্রতি খরচ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। আবার গত ছয় বছরে মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। ২০২২ সালে করা জরিপ অনুযায়ী সংস্থাটি বলছে, দেশে মানুষের মাসিক আয় বেড়ে বর্তমানে ৩২ হাজার ৪২২ টাকা হয়েছে। যা ২০১৬ সালে ছিল ১৫ হাজার ৯৮৮ টাকা। আবার পরিবার প্রতি খরচ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১ হাজার ৫০০ টাকা। সর্বশেষ যখন ২০১৬ সালে হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এঙপেন্ডিচার সার্ভে (এইচআইইএস) করা হয়, তখন দেশে পরিবার প্রতি খরচ ছিল ১৫ হাজার ৭১৫ টাকা। খবর বিডিনিউজ ও বাংলানিউজের।
দেশে উন্নয়নের পাশাপাশি বৈষম্য বাড়ার বিষয়ে অর্থনীতিবিদরা যে বক্তব্য দিয়ে আসছেন, সেটির প্রমাণ মিলল পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপে। পরিসংখ্যানের তথ্য অনুযায়ী, পরপর দুই দফায় বৈষম্যের হার বাড়ার চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, শহরের চেয়ে গ্রামের মানুষের আয় ও ব্যয়, সবই কম। তবে শহরে আয় বৈষম্য বেশি, গ্রামের পরিস্থিতি তুলনামূলক কিছুটা হলেও ভালো। গতকাল বুধবার পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রকাশিত ‘খানা আয় ও ব্যয় জরিপ ২০২২’ প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, বর্তমানে দেশে দারিদ্র্যের হার আরো কমে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ হয়েছে। ২০১৬ সালের জরিপে এই হার ছিল ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০২০ সালে বিবিএস এর প্রাক্কলনে দারিদ্র্যের হার ২০ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে এসেছিল।
নতুন জরিপে দেশে অতি দারিদ্র্যের হারও কমেছে অনেকটা। বিবিএস বলছে, দেশে এখন অতি দারিদ্র্যের হার ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। ২০১৬ সালের জরিপে এই হার ছিল ১২ দশমিক ৯ শতাংশ। বিবিএস এর ২০২০ সালের প্রাক্কলনে অতি দারিদ্র্যের হার ১০ দশমিক ৫ শতাংশ দেখানো হয়েছিল।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ের পরিসংখ্যান ভবনের সম্মেলন কক্ষে এক অনুষ্ঠানে জরিপের তথ্য প্রকাশ করেন প্রকল্প পরিচালক মহিউদ্দিন আহমেদ। তিনি জানান, পল্লী এলাকায় বর্তমানে দারিদ্র্যের হার ২০ দশমিক ৫ শতাংশ এবং শহরে ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ। অন্যদিকে অতি দারিদ্র্যের হার গ্রামে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ, শহরে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ।
কোভিড মহামারীর ধাক্কার পর ইউক্রেন যুদ্ধের দুঃসময়েও দেশে দারিদ্র্যের হার কীভাবে কমল, সে বিষয়ে একটি ব্যাখ্যা অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। তার যুক্তি, কোভিডের সময় সরকার পুরোপুরি লকডাউনে না গিয়ে সতর্ক অবস্থান নেওয়ার পাশাপাশি শিল্প, কৃষক এবং প্রান্তিক মানুষসহ সকল স্তরের মানুষের জন্য নানা ধরনের প্রণোদনা দেওয়ার ফলে দেশে এই দুঃসময়েও দারিদ্র্য কমেছে।
এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, কোভিডের সময় আমরা যে সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ঝুঁকি নিয়েছি, আমরা কমপ্লিট লকডাউনে যাই নাই। সিলেক্টিভ লকডাউন আমরা করেছি। তখন অনেক জ্ঞানী ব্যক্তিরা বলেছিলেন, সর্বনাশ হয়ে যাবে, রাস্তা ঘাটে মানুষ মরে পড়ে থাকবে। কিন্তু আমরা রাস্তাঘাট বন্ধ না করে বিশেষ করে শ্রমিক ও কৃষকদের চলাফেরা বন্ধ করিনি। এর ফলে আমাদের শিল্প ও কৃষি উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। কারখানার উৎপাদন, এসএমইর উৎপাদন এবং বহিরাগত শ্রমিক যাওয়া আসা প্রত্যেকটি বিষয় আমরা ধরে রাখতে পেরেছিলাম।’
এবারের খানা আয় ও ব্যয় জরিপে সারা দেশে ১৪ হাজার ৪০০ পরিবারের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বছরব্যাপী এই তথ্য সংগ্রহের কাজ চলে।
জরিপের অন্যান্য খাতে দেখা যায়– দেশে বর্তমানে ৯৯ দশমিক ৩২ শতাংশ খানা বিদ্যুৎ সুবিধা পাচ্ছে। ২০১৬ সালে এই হার ছিল ৭৫ দশমিক ৯২ শতাংশ। ৭ বছরের বেশি বয়সীদের সাক্ষরতার হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৪ শতাংশ। ২০১৬ সালের জরিপে এই হার ৬৫ দশমিক ৬ শতাংশ ছিল। বর্তমানে দেশের ৯৬ দশমিক ১ শতাংশ খানা নিরাপদ পানি পাচ্ছে। এখন দেশের ৯২ দশমিক ৩২ শতাংশ উন্নত টয়লেট, ৬ দশমিক ৯৯ শতাংশ অনুন্নত টয়লেট ব্যবহার করে। তবে এখনো ০.৬৯ শতাংশ উম্মুক্ত স্থানে মল ত্যাগ করে।
জরিপের তথ্য বলছে, মাসিক গড় মাথাপিছু আয় বেড়ে হয়েছে ৭ হাজার ৬১৪ টাকা। এই অংক ছয় বছর আগের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। ২০১৬ সালে মাথাপিছু গড় আয় ছিল ৩ হাজার ৯৪০ টাকা।
জরিপের তথ্য বলছে, দেশের সামস্টিক অর্থনীতির এত সফলতার মধ্যেও দেশে আয় বৈষম্য বেড়েছে। ২০২২ সালের খানা আয় ও ব্যয় জরিপ অনুযায়ী দেশে আয় বৈষম্য বেড়ে শুন্য দশমিক ৪৯৯ শতাংশ হয়েছে। ২০১৬ সালের জরিপে এই হার ছিল শুন্য দশমিক ৪৮২ শতাংশ।