দাবি না মানলে ২৮ আগস্ট থেকে লাগাতার কর্মবিরতি

রেলওয়ের রানিং স্টাফদের মাইলেজ জটিলতা নিরসনে আল্টিমেটাম

শুকলাল দাশ | শনিবার , ১২ আগস্ট, ২০২৩ at ৬:১৮ পূর্বাহ্ণ

রেলওয়ের রানিং স্টাফদের (ট্রেনের চালক, সহকারী চালক, গার্ড ও টিটি) মাইলেজ জটিলতা নিরসনের দাবিতে দীর্ঘদিনের চলমান আন্দোলন আরো তীব্র হয়ে উঠছে। আগামী ২৭ আগস্ট রাত ১২টার মধ্যে দাবি না মানলে রাত ১২টা ১ মিনিটের পর সারা দেশে লাগাতার কর্মবিরতির (তারা আর কোনো ট্রেন চালাবেন না) ঘোষণা দিয়েছেন রানিং স্টাফরা। এতে সারাদেশে ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাবে। শুধু যাত্রীবাহী ট্রেন নয়, মালবাহী ট্রেন, তেলবাহী ট্রেন সবই বন্ধ হয়ে যাবে। এতে রেলওয়ের রাজস্ব আয়ে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে।

রেলওয়ের রানিং স্টাফ সমিতির নেতারা বলেন, এতোদিন রেলপথ মন্ত্রী, সচিব এবং ডিজিসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আশ্বাসের কারণে আশ্বস্ত হয়ে পূর্বের নিয়মে তারা ট্রেন চালিয়ে আসছেন। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় ১৬০ বছরের আগের মাইলেজ সুবিধা দিতে অসম্মতি জানানোর পর রানিং স্টাফদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়তে থাকে। বিষয়টি সমাধানের জন্য রেল মন্ত্রণালয়কে ২৭ আগস্ট রাত ১২টা পর্যন্ত সময় বেধে দেয়া হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে তাদের ন্যায্য দাবিসমূহ পূরণ না হলে ২৮ আগস্ট থেকে সারাদেশে কর্মবিরতির ঘোষণা দেয়া হয়েছে। সমপ্রতি আইবাস প্লাস প্লাস সফটওয়্যারের মাধ্যমে রানিং স্টাফদের বেতনভাতা প্রদানের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। তবে বাংলাদেশ রেলওয়ের বিভিন্ন বিভাগে কর্মরত শ্রমিককর্মচারীদের বিভিন্ন ভাতা ভিন্নতর হওয়ায় জটিলতার মুখে পড়েছে রেলওয়ে। গত আড়াই বছর ধরে তারা বিভিন্ন দফতরে ঘুরেও কোনো কুলকিনারা না পেয়ে অবশেষে কর্মবিরতিতে যাওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।

রেলওয়ের রানিং স্টাফ কারা : রেলওয়ের রানিং স্টাফদের মধ্যে রয়েছেন ট্রেনচালক (লোকোমাস্টার), গার্ড ও টিকিট টেকার (টিটি), গার্ড(ট্রেন পরিচালক), টিটিই (ট্রাভেলিং টিকেট এঙামিনার)। যারা চলন্ত ট্রেনে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে ট্রেন চলাচল নিরবচ্ছিন্ন ও স্বাভাবিক রাখতে এসব রানিং স্টাফের দৈনিক নির্ধারিত ১২ কর্মঘণ্টার অতিরিক্ত ডিউটি করতে হচ্ছে। এরাই মূলত একটি যাত্রীবাহী, মালবাহী এবং তেলবাহী ট্রেন নির্দিষ্ট স্টেশন থেকে গন্তব্যে নিয়ে যান। এই রানিং স্টাফরা যদি কর্মবিরতিতে যানতাহলে সারাদেশের ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাবে।

রেলওয়ের রানিং স্টাফদের মাইলেজ কি : বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক কর্মচারী সমিতির কেন্দ্রীয় সহ সভাপতি ও চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক মো. মজিবুর রহমান ভূইয়া আজাদীকে বলেন, ট্রেনের চালক, সহকারী চালক, গার্ড ও টিকিট পরিদর্শকরা (টিটি) ১৬০ বছর ধরে (বৃটিশ আমল থেকে) মাইলেজ সুবিধা পেয়ে আসছেন। সরকারি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে রেলওয়ের রানিং স্টাফদের যে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে হয় সেটি বৃটিশ আমল থেকে মাইলেজ নামে পরিচিত। অর্থাৎ

রেলওয়ের ১৮৬২ সালের আইন অনুযায়ী ট্রেন চালক, সহচালক, পরিচালক ও অন্যদের বিশেষ আর্থিক সুবিধা প্রদান করা হয়ে থাকে। ৮ ঘণ্টা কর্মদিবস হলেও রানিং স্টাফদের গড়ে ১৫১৮ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। এজন্য তাদের দেওয়া হয় বিশেষ আর্থিক সুবিধা যাকে রেলওয়ের ভাষায় বলা হয় মাইলেজ। মাইলেজ রানিং স্টাফদের বেতনেরই অংশ, ওই পদে নিয়োগ বিধিমালাতে সেটাই বলা আছে। সেই নিয়ম অনুযায়ী শত বছর ধরে তারা সেই হিসেবে বেতনও পেয়ে আসছেন। মাইলেজের হিসাব হলো, প্রতি ১০০ কিলোমিটার ট্রেন চালালে রানিং স্টাফরা মূল বেতনের এক বেসিকের সমপরিমাণ টাকা বেশি পাবেন। ৮ ঘণ্টায় একদিনের কর্মদিন ধরলে রানিং স্টাফদের প্রতি মাসে কাজ দাঁড়ায় আড়াই বা দুই তিন মাসের সমপরিমাণ। তাদের বেতনও সেইভাবেই দেওয়া হয়। এছাড়াও মূল বেতনের হিসাবে অবসরকালীন ভাতা যা হয় তার সাথে অতিরিক্ত আরও ৭৫ শতাংশ টাকা বেশি দিয়ে তাদের পেনশন দেওয়া হয়। রেলে প্রচলিত এই পদ্ধতিকে বলা হয় মাইলেজ।

কিন্তু সমপ্রতি রাষ্ট্রের বেসামরিক কর্মীদের মূল বেতনের অতিরিক্ত অর্থ পাওয়ার বিধান নেই মর্মে অর্থ মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপন জারি করে রেলের রানিং স্টাফদের মাইলেজ সুবিধা বাতিল করে দেয়। এতেই ক্ষিপ্ত হন রানিং স্টাফরা। ফলে তাদের বেতন নিয়েও তৈরি হয়েছে জটিলতা। এই বেতন জটিলতার নিরসন ও মাইলেজ পদ্ধতি পুনর্বহালের দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন রেলের রানিং স্টাফরা।

জানা গেছে, রেলওয়ের সংস্থাপন কোডের বিধানের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ রেলওয়ের ট্রাফিক রানিং স্টাফ এবং লোকোমোটিভ রানিং স্টাফদের ১৯৯৭ সালের ১ জুলাই থেকে মূল বেতনের ভিত্তিতে রানিং অ্যালাউন্স প্রদানের প্রস্তাব হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৮ সালের

২৮ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রানিং স্টাফদের বিশেষ এ ভাতা প্রদানের প্রস্তাব অনুমোদন করেন। কিন্তু সমপ্রতি ইএফটির মাধ্যমে বেতনভাতা প্রদান প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্তিতে বিশেষ ভাতা সীমিত হয়ে যাওয়ার ঘোষণা মানছেন না রানিং স্টাফরা।

একজন সরকারি কর্মকর্তাকর্মচারী তাদের ডিউটি শেষে পরবর্তী ১৬ ঘণ্টা বিশ্রামে যেতে পারেন বা ব্যক্তিগত কাজ সম্পন্ন করতে পারেন। কিন্তু একজন লোকোমাস্টার ডিউটি শেষ করার পরেও সবসময় অতিরিক্ত ডিউটির জন্য তৈরি থাকতে হয়। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের ফোন পাওয়া মাত্রই সাড়া দিতে হয়।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঈদের ছুটি, পূজার ছুটি, গোলযোগের সময়েও রেলওয়ের লোকোমাস্টারকে ট্রেন নিয়ে ছুটতে হয়। তাদের কোনও ছুটি নেই। বছরে ৩৬৫ দিন তাদের ২৪ ঘণ্টা ডিউটি করতে হয়। সেই বিবেচনায় বৃটিশ

আমল থেকেই ট্রেনের লোকোমাস্টাররা ‘মাইলেজ’ পান। ট্রেন চালকদের ডিউটির সাথে অন্য কারও ডিউটির তুলনা চলে না। সেটা রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও স্বীকার করেন। কিন্তু বাধ সেধেছে অর্থমন্ত্রণায়। তারা এই খাতে অর্থ ছাড় দিতে নারাজ। এই নিয়ে রানিং স্টাফদের মধ্যে অসন্তোষ।

বেশ কয়েজন রানিং স্টাফ জানান, গত ২৩ জুলাই থেকে আট ঘণ্টার বাড়তি দায়িত্ব পালন থেকে তারা বিরত ছিলেন। এতে পণ্যবাহী ও লোকাল ট্রেন চলাচলে স্থবিরতা সৃষ্টি হয়। পরে ডিজি মহোদয় আমাদেরকে আশ্বস্ত করেছেন তিনি এবং সচিব স্যার অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাথে কথা বলে বিষয়টি সুরাহা করবেন। কিন্তু এখনো আমাদের রানিং স্টাফরা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কারণে তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

তাই গত ৩ আগস্ট রানিং স্টাফরা পাহাড়তলীতে সমিতির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জরুরি মিটিং শেষে ২৮ আগস্ট থেকে কর্মবিরতির আল্টিমেটামের সিদ্ধান্ত নেন। সেই লক্ষ্যে তারা গত ৩দিন আগে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় রেলওয়ে ম্যানেজার আবিদুর রহমানকে স্মারকলিপি দিয়েছেন। গত ১০ আগস্ট তারা পাহাড়তলী ও চট্টগ্রাম রেল স্টেশনে বিক্ষোভ করেছেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৪৬,৭৮৭ ডলারের সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা জব্দ
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা