দানব

সরোজ আহমেদ | বুধবার , ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ at ১১:১৮ পূর্বাহ্ণ

সারাক্ষণ উদাস মনে জানালা ধরে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে সূহী। হঠাৎ হঠাৎ কেঁদেও ফেলে। প্রথম প্রথম হাউমাউ করে কাঁদলেও এখন আর শব্দ করে কাঁদে না। ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদে। সূহীর পছন্দের সব খাবার সামনে এনে দেয় মা নূরী। তাতেও তার মন ভরে না। শুধু কাঁদে আর কাঁদে। সূহীর মায়ের মনেও কষ্ট। খুব কষ্ট। কিন্তু মেয়েকে বুঝতে দেয় না। রাতে যখন মেয়ে ঘুমিয়ে যায়, নিরবে চোখ মুছে মুছে কাঁদে নূরী। আর মনে মনে বলে-‘হে খোদা, আমার নিষ্পাপ মেয়েটাকে তুমি বাপ হারা কইরো না। তুমি বড়ই মেহেরবান। যদি কোনো পাপ করে থাকি, ক্ষমা কইরা দিও খোদা।’
ঘুমন্ত সূহীকে বুকে জড়িয়ে কাঁদে নূরী। অজান্তে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে সূহীর কপালে। ঘুম ভেঙে যায় সূহীর। দেখে মা কাঁদছে। ‘মা’ বলে ডাকতেই চমকে উঠে নূরী। বিচলিত হয়ে চোখ মোছার চেষ্টা করে। মেয়েকে ভোলানোর জন্য এটা সেটা বলে। কিন্তু দ্বিতীয় শ্রেণি পড়ুয়া সূহীও বুঝে যায়- বাবার জন্য কষ্ট শুধু তার একার নয়, মাও কষ্ট পাচ্ছে।
কষ্ট পাবারই কথা। মানুষটা দুই বছর পর যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফিরলো। বিমানবন্দরে মা-মেয়ে দূর থেকে এক নজর দেখছে কেবল, কাছেও যেতে পারল না। পোশাকধারী কয়েকজন লোক এসে সূহীর বাবাকে কি যেন বললো। তারপর তাকে একটি গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে চোখের সামনে হাওয়া হয়ে গেল ওরা! একটা কিছু বলারও সুযোগ দিল না। শুধু গাড়িতে উঠানোর সময় মানুষটা হাতের ইশারায় মেয়েকে নিয়ে বাসায় চলে যেতে বললো, এইটুকু।
বিমানবন্দরের বারান্দায় পাথরের মত দাঁড়িয়ে থাকে মা-মেয়ে। এর মধ্যে সিকিউরিটি টাইপের দুজন লোক এসে একটা বড় সাইজের লাগেজ রেখে যায় তাদের সামনে। সেদিকে মা-মেয়ের নজর নেই। মানুষটাকে বহুদিন পর কাছে পেয়েও না পাওয়ার কষ্ট নূরীকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। সূহীও বাবাকে নিয়ে যাওয়া গাড়িটার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। গাড়িটা চোখের আড়াল হতেই হাউমাউ করে কেঁদে মাকে জড়িয়ে ধরে সূহী। ‘মা, বাবাকে ওরা ওভাবে নিয়ে গেল কেন! বাবা কি করেছে?’ মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে নূরীও কেঁদে ফেলে। তারপর আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বললো, ‘বাবাকে ওরা কোয়ারেন্টাইনে নিয়ে যাচ্ছে।’
‘বাবা বাসায় না গিয়ে ওখানে কেন যাচ্ছে, মা?’
‘না গিয়ে উপায় নেই মা। বাবা যে দেশ থেকে এসেছে ওখানে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে।’
‘করোনাভাইরাস! সেটা আবার কি?’
‘অনেক বড় একটা রোগ মা।’
‘সেই রোগ কী বাবারও হয়েছে?’
বিচলিত হয়ে নূরী বললো, ‘এমন কথা বলতে নেই মা। বাবার না হলেও যেসব দেশে এই রোগ ছড়িয়ে পড়েছে সেসব দেশ থেকে কেউ ফিরলে তাদের আলাদা একটা জায়গায় রাখতে হয়।’
‘রোগ না হলেও রাখতে হয়?’
‘রাখতে হয় মা। রোগটা ছোঁয়াছে কীনা তাই। যার এই রোগ হয়, তার সঙ্গে যারা মিশবে তাদেরও হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এজন্য সন্দেহ হলেই আলাদা থাকতে হয়, যেন সর্বনাশা ভাইরাসটা ছড়াতে না পারে।’
‘আমাকে বাবার কাছে নিয়ে চলো মা। আমিও বাবার সাথে থাকবো।’
‘তা হয়না, মা। এতদিন যখন বাবা ছাড়া থেকেছো, আর নাহয় চৌদ্দটা দিন অপেক্ষা করো। তারপর বাবাকে কাছে পাবে।’
বাবার অপেক্ষায় সূহী সারাক্ষণ জানালা ধরে দূরে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে। ঠিকমত খাওয়া-দাওয়া নেই। মা জোর করে খাওয়ালেও, একটু খেয়ে আর খেতে চায় না। মেয়ের জন্য লাগেজ ভর্তি খেলনা এনেছে বাবা। মেয়ে ফোনে যা যা বলেছে, তারচেয়েও বেশি এনেছে। মা লাগেজটা খুলে মেয়ের সামনে এনে দেয়। কিন্তু মেয়ে খেলনাগুলো একবার ছুঁয়ে দেখলো না। শুধু বার বার জানতে চায়- ‘বাবা এখনো আসছে না কেন?’ নূরী কখনো উত্তর দেয়, কখনো মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে চোখ বুজে থাকে। এক সপ্তাহ হয়ে গেল মানুষটা কেমন আছে, কোথায় আছে কে জানে। নূরী দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সোফায় শরীরটা এলিয়ে দেয়।
করোনাভাইরাসের ভয়াবহতা মাঝে কিছুদিন কমলেও আবার বাড়ছে। সুদূর চীনের উহান প্রদেশ থেকে ছড়িয়ে পড়া করোনার ছোবল এখন বিশ্বব্যাপী। ইতালি, স্পেন, বৃটেন, ফ্রান্স, ব্রাজিল, ভারত, যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কয়েকটি দেশে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতি মুহূর্তে বাজছে মৃত্যু ঘন্টা। এই সর্বনাশা ভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে বিচ্ছিন্ন সামাজিক সম্পর্ক, একঘরে হয়ে পড়েছে মানবকূল। এক এক করে লকডাউনে যেতে বাধ্য হচ্ছে দেশের পর দেশ। বাংলাদেশকে বাদ দেয়নি এই ভাইরাস। ক্রমে ক্রমে গ্রাস করে নিয়েছে গোটা পৃথিবী। বাংলাদেশেও প্রতিনিয়ত কারও না কারও মৃত্যু হচ্ছে। অনেকদিন লকডাউন ছিল এখানেও। তখন সবাই হোম কোয়ারেন্টাইনে ছিলেন। সোজা বাংলায় ‘গৃহবন্দি’।
মেয়েকে যতই সান্ত্বনা দিক, শঙ্কা কিছুতেই কাটছে না নূরীর। চারপাশে এত দু:সংবাদ ভেসে বেড়াচ্ছে, টেনশনমুক্ত থাকার জো নেই। খোদা না করুক যদি অশুভ কিছু ঘটে যায়, মেয়েটা নিয়ে কোথায় যাবে……।
সূহীর ডাকে নূরীর ধ্যান ভাঙে। ‘কিছু বলবে, মা?’ সূহী মায়ের কোলে বসে বললো, ‘আচ্ছা মা, করোনাভাইরাস খুবই জঘন্য?’
‘হুম। খুবই জঘন্য এবং খুবই ভয়ানক। যাকে গ্রাস করে তাকে মেরে ফেলে।’
‘তাহলে তো ভাইরাসটা দানবের মত। দাদু একবার আমাকে দানবের গল্প বলেছিলেন। দানবটা এতই ভয়ঙ্কর যাকে ধরে তাকে মেরে ফেলে।’
‘ঠিক তাই, করোনাভাইরাসটা দানবের মত। এ পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের লাখ লাখ বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে পাজি দানবটা।’
‘দানবটার কাছ থেকে বাঁচার কী কোন উপায় নেই, মা?’
‘অবশ্যই আছে।’
‘কি উপায়, মা।’
‘মূলত এই ভাইরাসটা বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায়। তাই সবসময় নিজেকে এবং ঘর-দুয়ার পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। হাতে কোনো কিছু স্পর্শ করার পর কিংবা বাহির থেকে এসে সাবান পানি বা স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধুতে হবে। খবরদার, হাত না ধোয়া পর্যন্ত ওই হাতে নাক, মুখ, কান, চোখ স্পর্শ করা যাবে না।’
‘তারপর?’
‘আক্রান্ত ব্যক্তি ও ভাইরাস আছে এমন কোনো কিছু স্পর্শ না করা। বেশি লোকজনের সমাগম এড়িয়ে চলা। হাঁচি, কাশি দেয়ার সময় মুখ ঢেকে রাখা। বাইরে চলাফেরার সময় মুখে মাস্ক পরা। এছাড়া মাছ, মাংস, ডিম রান্নার সময় খুব ভালোভাবে সিদ্ধ করা। তবে এ রোগের নির্দিষ্ট কিছু লক্ষণ আছে।’
‘কি রকম?’ জানতে চাইলো সূহী।
জবাবে মা বললো, ‘সার্দি, কাশি, জ্বর, মাথা ব্যথা, গলা ব্যথা এবং মারাত্মক পর্যায়ে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া। মোট কথা এই দানবকে বিনাশের জন্য সবার সচেতনতা জরুরি। সচেতনতাই পারে নিজে বাঁচতে এবং অন্যকেও বাঁচাতে।’
সূহী ভাবে, মানুষগুলো যেন কেমন! নিজের ভালোটাও বোঝে না। একটু নিয়ম মেনে চললে, সতর্ক থাকলে করোনার মত ভয়ঙ্কর সব দানব দ্বারে কাছেও ঘেঁষতে পারবে না।
সূহী স্কুলের খাতায় রঙ পেন্সিল দিয়ে এলোমেলো অক্ষরে বেশ কয়েকটি স্লোগান লিখে নিয়ে এলো মায়ের কাছে। মা হাতে নিয়ে দেখলো তাতে লিখেছে- ‘মাস্ক ছাড়া বাইরে নয়, করোনা করবো জয়’, ‘সাবান দিয়ে ধোব হাত, করোনা নিপাত যাক’, ‘হাঁচি-কাশিতে ঢাকবো মুখ, ছড়াবে না আর রোগশোক’।
মেয়ের কান্ড দেখে নূরী অবাক। মেয়েটার বুদ্ধি ভালো তা জানে। কিন্তু আজ প্রমাণ হলো, মেয়ে যথেষ্ট ট্যালেন্টও বটে। মেয়েকে কোলে নিয়ে অনেক আদর দিল নূরী। তারপর জানতে চাইলো, ‘এসব কেন লিখলে, মা? সূহী জবাব দিল, ‘এই কাগজগুলো রাস্তার পাশে দেয়ালে লাগিয়ে দেবো, লোকজন দেখে সাবধান হবে। ঠিক বলেছি না, মা?’
‘অবশ্যই। চলো আমিও তোমাকে সাহায্য করবো।’ এরপর মা-মেয়ে রাস্তার পাশের দেয়ালে, গেইটে খুব যত্ন করে কাগজগুলো লাগিয়ে দিল।
সন্ধ্যায় মেয়েকে পড়ার টেবিলে বসিয়ে নূরী ওয়াশরুমে ঢুকলো। হঠাৎ কলবেল বেজে ওঠে। নূরী ওয়াশরুম থেকে সূহীকে ডেকে বললো, ‘মা, দেখো কে এসেছে, অপরিচিত হলে দরজা খুলবে না কিন্তু।’
‘বাবা’ বলে চিৎকার দিয়ে ওঠে সূহী। মেয়ের চিৎকার শুনে ছুটে আসে নূরী। দরজা খুলতেই বাবা মেয়েকে জড়িয়ে ধরতে গিয়ে থমকে যায়। নূরীও থেমে যায় স্বামীর কাছে গিয়ে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সূহী দৌঁড়ে ভেতরে চলে যায়। আবার ছুটে আসে জীবাণুনাশক স্প্রে নিয়ে। তারপর বাবার দুই হাতে স্প্রে করে দিয়ে হাত ধরে টেনে বাবাকে ভেতরে নিয়ে যায়। অবশেষে প্রিয়জনকে সুস্থ ফিরে পেয়ে সবার আনন্দ আর ধরে না।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমাইজভাণ্ডার দরবারে খতমে বোখারি মাহফিল
পরবর্তী নিবন্ধকবর থেকে বলছি