মোগল আমল হতে বৃটিশ শাসনকাল (১৪ আগস্ট ’৪৭) পর্যন্ত একটা দীর্ঘ সময় আজকের পশ্চিমবঙ্গ ও আমাদের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সমন্বয়ে গঠিত অবিভক্ত বাংলা বা বৃহৎ বাংলা জনসংখ্যা ভাষা (বাংলা) ভূমি পরিমাপগত বৃটিশ ভারতে স্বীকৃত সর্ববৃহৎ ছিল।
তাই আমাদের পূর্ব পুরুষ অর্থাৎ আমার দাদার বৃহৎ উর্বরভূমিতে খুবই কল্পনাতীত ফসল জন্মাতো বলে তারা ৪৭৫ (চার টাকা ১২ আনা) পয়সায় সাড়ে তিন মণ তথা আজকের ১৪০ কেজি চাল খেয়েছে আর আমরা স্বল্প ও সংকীর্ণ ভূমির কারণে ১ কেজি চাউল কিনতে গুণতে হয় ৫০ থেকে ৬০ টাকা। কিন্তু কেন ? এর কারণ কি সম্ভাব্য তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের কল্পনা, নাকি অঘোষিত দুর্ভিক্ষ, মূলতঃ কিছুই না। অসাধু ব্যবসায়ী আর ক্ষমতাসীন আর বিরোধী দলের কিছু অসৎ নেতৃত্বই যৌথ চক্রান্তেই এহেন ভার সাম্যহীনতার জন্য দায়ী। ১৯৫০’র ২৪ মে ১৮ টাকা ৭ আনায় —– পয়সার হিসাবে ১৮৪৩ পয়সায় ১ মন চাউল পাওয়া যেত (পশ্চিমবঙ্গে দৈনিক যুগান্তর তারিখ : ৮/৬/৫১ইং)। নেতারা আমাদেরকে মানুষ বলে গণ্য করতে দ্বিধান্বিত হন। ২০০৩ সালে ঘোষিত আমাদের ৩২তম বাজেটে মদের দাম কমিয়ে ডাল ভাতের দাম বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। যদিও পরবর্তীতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে তা প্রত্যাহার করেছিল। অবশ্য আমাদের দেশের বড় লোকদের কুকুরাও মদ খায়, আর এদের পেছনে মাসে ৭/৮ লক্ষ টাকা খরচ হয়।
আমাদের দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন শাসনামলঅর্থাৎ ১৯৭২’র ২০ জানুয়ারি তারিখে ৭.৩৫ পয়সার ডলার দিয়ে শুরু হয়েছে। ৫১ বছরে আজ তারই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে ডলারের মূল্য ১০৬.৪৩ পয়সায় দাড়ায় (৭ মে ২০২৩ইং মোতাবেক)।
আমার মত গরীবের জীবন ধারনে মৌলিক পথ্য ডাল–ভাতের মূল্য বৃদ্ধিতে দুঃখিত নই। কেননা আমরা গরীবের তথা বাংলাদেশের ৩৭% মানুষ তিন বেলা অভুক্ত থাকার পর চতুর্থ বেলায় ডাল–ভাত খেতে পাই, অর্থাৎ ত্রিশ দিনের মধ্যে মাত্র দশ দিন আমাদের কপালে ভাত জোটে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মোজাফ্ফর আহমদের এক প্রতিবেদনে (সাধারণ মানুষের জীবন ধারণ : ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দী অধুনা বিলুপ্ত বিচিত্রা / পৃ: ১২–১৪/তাং–২১/০৩/৮৬ইং) দেখা যায় ১৩১ বছর আগে মাত্র ৪ টাকা বার আনায় (বর্তমান পয়সার হিসেবে ৪৭৫ পয়সা) সাড়ে ৩ মন বা ১৪০ সের চাল পাওয়া যেত। প্রতিবেদনে তিনটি তুলনামূলক চিত্র তিনি তুলে ধরেন – সাড়ে তিন মন চাল ১৮৭১ সালে ৪ টাকা বার আনা, ১৯১০ সালে ১৯ টাকা চার আনা, ১৯৮৫ সালে ১৩৩০ টাকা পাওয়া যেত। অনুরূপভাবে ৮ সের ডালের দাম ছিল যথাক্রমে ৮ আনা (১৮৭১), ১ টাকা ৪ আনা (১৯১০), ১৮৮ টাকা (১৯৮৫), ২ সের সিিরষার তেল ৯ আনা (১৮৭১), ১ টাকা ৩ আনা (১৯১০), ৭২ টাকায় (১৯৮৫), ২ সের লবন ৪আনা (১৮৭১), ২ আনা (১৯১০), ৫ টাকায় (১৯৮৫) পাওয়া যেত।
১৯৫১’র ৮ জুন পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত দৈনিক যুগান্তরের এক তথ্য হতে জানা যায় ১৯৫০’র ২৪ মে এক মন চাউলের মূল্য ছিল ১৮ টাকা ৭ আনা যা বর্তমান পয়সার হিসাবে ১৮৪৩ পয়সা মাত্র।
১৯৭৫ থেকে ২০২৩ এর ৭ মে পর্যন্ত জাতির পিতা হতে শেখ হাসিনা পর্যন্ত কয়েকটি সরকারের তুলনামূলক বাজার দর পাঠকদের কাছে তুলে ধরছি :
প্রতি কেজি চাউল ১৯৭৫–৪.০০, ’৭৯–৭.০০ টাকা, ’৮৫–৯.৫০, ’৯৫–১২.৫০, ২০২৩–৪৫.০০ ও ৫০.০০।
প্রতি কেজি তেল : ১৯৭৫–১৬.০০, ৭৯–৩০.০০, ৮৫–৩৬.০০, ৯৫–৬০.০০, ২০২৩–১৯৯.০০
প্রতি কেজি চিনি : ১৯৭৫–১০.০০, ’৭৯–১৪.০০, ’৮৫–২৮.০০, ’৯৫–৩০.০০, ২০২৩–১৪০.০০
ইলিশ মাছ : ১৯৭৫–১৪.০০, ’৭৯–১৫.০০, ’৮৫–৩২.০০, ’৯৫–৮০.০০, ২০২৩–১৮০০.০০
গরুর মাংস : ১৯৭৫–১২.০০, ’৭৯–১৮.০০, ’৮৫–৪০.০০, ’৯৫–৭০.০০, ২০২৩–৮৫০.০০
ডাল : ১৯৭৫–৫.০০, ’৭৯–৮.০০, ’৮৫–১৬.০০, ’৯৫–৪৮.০০, ২০২৩–১২০.০০
স্বর্ণ : প্রতি ভরি ১৯৭৫–১৫০.০০, ’৭৯–৩৬০০.০০, ’৮৫.৬৫০০.০০, ’৯৫–৬৬৫০০.০০, ২০২৩–৯৯৭৫০.০০
ডলার : ১৯৭৫–৮.০০ হতে শুরু হয়ে ২০২৩ সালে ১০৭.০০ টাকায় দাঁড়িয়েছে।
সাম্প্রতিকালের দ্রব্যমূল্য একবার বাড়ে আরেকবার কমে, এই ওঠানামা খেলায় কিছু অসৎ রাজনৈতিক ব্যবসায়ী সর্বোতভাবে দায়ী। এদের বিরুদ্ধে কঠোর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নেয়ার আমাদের দেশে সেরকম কোন আইন নাই বা প্রণীত করা ও হচ্ছে না। এক্ষেত্রে আইন–শৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে সেনা–বিজিবি–র্যাবকে ব্যবহার করা উচিত বলে আমার মত শরীরের দৃঢ় অভিমত।
অতএব দ্রব্যমূল্যের লাল–নীল বাতি জ্বলতেই থাকবে আর আমরা সাধারণ মানুষ দিশেহারা হয়ে পথহারিয়ে ফেলে তাই আগামী দুদিনের অপেক্ষায় থাকব। কখন ভূমি দস্যু রাজা–রানীদের হাত থেকে আমাদের উর্বর জমিগুলি উদ্ধার হবে সেখানে গুমাই বিল হবে ফসলের ফলন বাড়বে চালের দাম কমবে।
লেখক : জীবন সদস্য–বাংলা একাডেমি; সভাপতি (১৯৭২–৯০)-শেখ মুজিব গণ পাঠাগার (গহিরা, রাউজান, চট্টগ্রাম) ও কলামিস্ট।










