প্রথম রমজান থেকেই ইলিমা ক্যালেন্ডারের তারিখে লাল কলমের ক্রস দাগ দিতে লাগলো।একটা রোজা শেষ হয়, অমনি ইফতার সেরে উঠে দ্রুত ক্যালেন্ডারে একটা তারিখ কেটে দেয়। মেয়ের এমন কাণ্ড দেখে বাবা মা দুজনেই হাসে। ইফতার করতে বসলে কেউ না কেউ টিপ্পনী কাটে, ইলিমা আজকে ক্যালেন্ডারে ইফতারের আগেই দাগ কেটে দে, আব্বা বলে, একসাথে দুটো তারিখ কেটে দিতে পারিস না! হা…হা…হা…।
১.
সেদিন মাকে ক্যালেন্ডারের সামনে দেখে ইলিমা জানতে চায়, মা তুমি সেখানে কি করছো? দেখো তুমি কোন দাগ কেটোনা, তখন আমার রোজার হিসেব ভুল হয়ে যাবে।
– দাগ দিচ্ছি না পাগলী, দেখছিলাম তোর পাগলামি, এতো সুন্দর ক্যালেন্ডারটা লাল দাগে ভর্তি করে ফেলেছিস।
– তোমার এই ক্যালেন্ডার দেখতে হচ্ছে কেন মা! তোমার না মোবাইল আছে!!
লাজুক স্বরে বলতে বলতে দুহাতে মায়ের কোমর ধরে মাকে সরিয়ে দেয়।
– জানিস স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার সময় আমিও তোর মতো এমন করতাম। পরীক্ষার রুটিন গাম দিয়ে একটা ক্যালেন্ডারে লাগিয়ে রাখতাম। একটা পরীক্ষা শেষ করে এসে একটা দাগ কেটে দিতাম। আর গুনতাম কয়টা তারিখ কাটার বাকি আছে। কখন পরীক্ষা শেষ হবে। কি যে আনন্দ, অস্থিরতা ছিলো। যেইদিন সবগুলো পরীক্ষা শেষ হতো পুরো রুটিন লাল দাগ করে দিতাম। চিৎকার করে গান গাইতে গাইতে রুটিন ছিঁড়ে ফেলতাম। তোর দাগ কাটা দেখে কয়েকদিন ধরে আমার স্কুলের কথা মনে পড়ছিলো খুউব। আচ্ছা এখন তো পরীক্ষা নাই, তুই কিসের দাগ কাটিসরে ইলিমা? রোজার??
– মা আমি তো রোজার হিসাব রাখছি না।
– তো কেন তারিখ কাটিস?
– ঈদের কয়দিন বাকি আছে তা গুনছি। কখন নতুন জামা নিবো তার সময় হিসাব করছি। গতকাল ইফতারে সময় বাবা কি বলেছে শুনোনি!!!
– কি বলেছে আবার!! তোরা বাপবেটির এতো কথা শুনতে শুনতে একটা কথা মনে রাখতে আরেকটা ভুলে যাই।
– শুনোনি বাবার গার্মেন্টসে এবার প্রচুর অর্ডার এসেছে, মালিক বলেছে পঁচিশে রমজানের আগে শেষ করতে হবে। এই সময়ের মধ্যে প্রোডাকশন শেষ করতে পারলে ছাব্বিশে রমজানে বেতন বোনাসের সাথে বাড়তি ঈদ উপহারও দিবে। দেখছোনা বাবা ইদানিং দেরি করে বাসায় আসে, ওভার টাইমের জন্য আমাদের সাথে শুক্রবার ছাড়া ইফতারও করতে পারে না। মা, বাবাকে একটা ডা. দেখানো দরকার।
– কেন?
– বাবার পায়ে প্রচন্ড ব্যাথা করে।গতরাতে আমি বাবার দুই পা টিপে দিয়েছি। পরশু রাতে বাবার দুই পায়ের উপর দাঁড়িয়ে থেকেছি।
মেয়ের কথা শারমিন চুপচাপ আনমনা হয়ে যায়। নিজেকে সামলে নিতে জোর গলায় বলে ,আচ্ছা যা এখন পড়তে বস। এত হিসাব রাখতে হবে না, ঈদের এখনও অনেক দেরি।
২.
করোনায় টানা কয়েকমাস স্কুল বন্ধ ছিলো। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খুবই বাজে অবস্থা। জমে যাওয়া সিলেবাসের পড়া শেষ করতে অনেক জরুরি নির্দেশনা দিয়ে বিশ রমজান পর্যন্ত স্কুল খোলা থাকবে।
কাল শুক্রবার। ইলিমাকে স্কুলে যেতে হবেনা। সে মায়ের কাছে আবদার করলো সেহরিতে তাকে ঘুম হতে ডেকে তুলতে। কাল সে রোজা রাখবে। মা কিছুতেই রাজি হচ্ছে না। উল্টো বকা দিলো, সবসময় কেবল বড়োদের কাজ করতে হয়।
ইলিমা তবু প্যানপ্যান করে, ” আমাকে সেহরিতে না ডাকলে আমি কাল সারাদিন কিছুই খাবো না“
– শোন মা ছোটোদের রোজা নেই। ছোটোরা রোজা রাখলে তা মা বাবার হিসেবে জমা হয়।
– তাহলে তো আরো ভালো হলো। কাল শুক্রবার যে রোজা রাখবো, তা বাবার নামে, পরের শুক্রবার যেটা রাখবো সে রোজাটা তোমার নামে।
– আচ্ছা যা যা, এখন পড়তে বস।
– মা সেহরির সময় ঘুম হতে ডেকে তুলবে তো?
– হ্যাঁ তুলবো তুলবো। মেয়েটাকে আশকারা দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলেছে বলে ইলিমার বাবার উপরে এই সুযোগে দোষ চাপিয়ে দিলো।
এমন নানান আবদার, খুনসুটি, মায়া মমতায় দিন কাটে মা মেয়ে ছেলে ইভানের। টানাপোড়েনের সংসারেও কেমন একটা আনন্দ উৎসব আছে তাদের। স্বামীর সামান্য আয়ের সংসার জোড়াতালি দিয়ে চালিয়ে নেয় শারমিন।
৩.
সকাল হতেই হঠাৎ দমকা হাওয়া ঝড় বৃষ্টি। বৈশাখের শুরু হতেই প্রচন্ড গরমে হাঁপিয়ে উঠা মানুষজন এই বৃষ্টিতে যেন স্বস্তি পেলো। আশেপাশের সব পুকুরের পানি তলানিতে চলে গিয়েছিল। পাতা পঁচা দুর্গন্ধ পানিতে না পারতে ধোয়াপালার কাজ করতে হয়েছে। এবারের রোজার উপোস প্রায় চৌদ্দ ঘন্টা। গ্রীষ্মের প্রখর রোদের গরমে গলা শুকিয়ে যায়। ভোর রাত হতে শুরু হওয়া বৃষ্টিতে কাজে ডুবে থাকা মানুষগুলো একটু প্রশান্তি পেলো।
ইলিমা রোজা রাখায় আজ দুপুরে রান্নার বাড়তি কোন ঝামেলা ছিলো না। সেহরির সময়ে রান্না করা তরকারি গরম করে ছেলে ইভানকে খেতে দিয়ে বিছানায় শুয়ে আছে শারমিন। ইলিমাও পাশে শুয়ে আছে ক্লান্তি ভরা চেহারা নিয়ে। শারমিন ঘুমানোর চেষ্টা করছে কিন্তু ঘুম আসেনা। কেমন ছটফট করছে। ডানপাশ বামপাশ করতে করতে বেলা গড়ায়। ইফতার তৈরির সময় হয়ে এলেও বিছানা হতে উঠতে কেমন যেন জোর পাচ্ছেনা শরীরে। একবার ভাবলো ইলিমার বাবাকে ফোন করে বলবে কাজ হতে ফিরতে যেন ছোলা পেঁয়াজু বেগুনি নিয়ে আসে। আবার মনে মনে ভাবে সারাদিন গার্মেন্টসে কাজ করে দোকানে ঝামেলার মধ্যে নাস্তা নিতে যেতে বলাটা কেমন যেন।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে রান্না ঘরে যায়। চুলোয় আগুন দিয়ে ছোলা তুলবে অমন সময় বাড়ির বাইরে প্রচুর মানুষের হৈচৈ। ইলিমা ইভান দুইজনে ভয় পেয়ে মায়ের কাছে ছুটে যায়। শারমিনের মনে হচ্ছে হৈচৈ এর শব্দ আরো কাছে আসছে। কয়েক মিনিটের মধ্যে বাড়ির উঠোনে বিভিন্ন বয়সের মানুষের ঢল নামলো। শারমিন দরজা খুলে তাকালো, কার বা কোথায় কি হয়েছে কিছুই আন্দাজ করতে পারছে না মা মেয়ে। আট বছর বয়সই ইভান মা আর বোনের দিকে তাকায় একটু পরপর। ইলিমা ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে জানতে চায়, মা কি হয়েছে? এতো মানুষ কেন আমাদের বাড়ির উঠোনে?
– জানিনারে মা, কিছুই বুঝতে পারছিনা। যা তো আমার মোবাইলটা নিয়ে আয় তো। তোর বাবাকে একটা ফোন করি।
মানুষের হৈচৈ কোলাহলে সাইরেন বাজার শব্দ কানে আসে।ফায়ার সার্ভিস না মেডিকেলের এম্বুলেন্সের গাড়ি তা বুঝে উঠার আগেই সবাই বলাবলি করতে লাগলো,
লাশের গাড়ি এসে গেছে, লাশ গাড়ি হতে নামামো যাবেনা। দুই ঘন্টা পুড়ে এতো বিভৎস হয়েছে কাউকে দেখানোর নাকি অবস্থা নেই।
ইলিমা মোবাইল নিয়ে এসে দেখে মা বিলাপ করে কাঁদছে, আল্লাহ আমাদের এটা কি করলা, আমার দুটো ছেলেমেয়েকে তুমি ক্যান এতো তাড়াতাড়ি এতিম করে দিলে?
ইলিমা তার মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে।
” ইলিমারে তোর জন্য ঈদের জামা কে কিনবে মা? সবতো পুড়ে গেছে।
মায়ের বিলাপের কথাগুলো ইলিমা কিছুটা বুঝতে পারলেও ইভান সেইভাবে বুঝতে পারছে না। মাকে কাঁদতে দেখে তাদেরও চোখে পানি। এদিকে ওদিকে তাকাচ্ছিলো দুই ভাইবোন। উঠোনে সাদা গাড়ি দেখে জানতে চায়
– মা কি হয়েছে? বারবার মাকে জিজ্ঞেস করেও কোন জবাব পায়না ইলিমা।কেবল কান্নার গোঙ্গানির শব্দ পেলো।
উঠোনে দলবাঁধা লোকজন বলাবলি করছে যোহরের আজানের সময় ফ্যাক্টরিতে আগুন লেগেছে। ত্রিশ চল্লিশ জন আগুনে পুড়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। খালিদসহ ছয় সাতজন ফ্লো হতে বেরও হতে পারেনি। আগুনে একেবারে পুড়ে শেষ। লোকজনের মুখে বাবার নামটি শুনতে পায় ইলিমা। আগুনে পুড়ছে শুনে আৎকে উঠে মাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো।
লাশটি গাড়ি হতে নামানো হয়নি।
ইলিমার মা একটিবার মুখটা দেখতে চাইলেও কেউ কেউ মানা করছে। তবুও সে দেখতে চায়। আমাকে ইলিমার বাপরে দেখাও। আমার মেয়েটাকে শেষবারের মতো তার বাবাকে দেখতে দাও। মা মেয়ের বিলাপে সাত আসমান যেন কেঁপে উঠছে। দেখতে আসা কেউই নিজের চোখের জল আটকাতে পারেনি।
শারমিনকে ধরাধরি করে গাড়ির কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। মুখটা কাপড়ে ঢাকা। শারমিন এইটুকু দেখলেও আর কেউ কিছু দেখতে পেলো না।
ইলিমাও শেষবারের মতো দেখতে পেলোনা তার বাবাকে।
৪.
বাবা মারা গেছে।আর কখনো বাবাকে পাওয়া যাবেনা এইটুকু খুব ভালোভাবে বুঝতে পারে ইলিমা। একেকটা রোজা শেষ হয়, সে ক্যালেন্ডারের পাতায় আর দাগ কাটে না। ঈদের জামা কে বা কিনে দিবে? নতুন জামার নিতে তার আর ইচ্ছে করছে না। নতুন জামা নয় তার কেবল বাবাকে পেতে ইচ্ছে করছে। গতকাল ইফতার করতে বসে মায়ের কাছে জানতে চায়,
মা বাবা চাইলে কি আরেকবার আমাদের কাছে আসতে পারে না? নতুন জামা আমার আর লাগবে না, কেবল বাবাকে পেলেই হয়। আচ্ছা মা , তুমিই বলো বাবাকে ছাড়া কি ঈদ হয়??








