বাঁশখালীর শেখেরখীলের ফেরদৌস যে জলদস্যু দলের সদস্য, বৃদ্ধা মা সফুরা খাতুন তা কখনও বুঝতে পারেননি। ১৫ বছর সংসার করে স্ত্রী হাসিনা আক্তারও স্বামীর ওই পরিচয় জানতে পারেননি। যখন তারা সেই সত্য জানলেন, পাঁচ সন্তানের মা হাসিনার তখন দিশেহারা অবস্থা। বউ-শাশুড়ি মিলে অনেক বুঝিয়ে আত্মসমর্পণে রাজি করান ফেরারি ফেরদৌসকে। গতকাল বৃহস্পতিবার বাঁশখালী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে আরও ৩৩ জন জলদস্যুর সঙ্গে ফেরদৌসও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের কাছে অস্ত্র জমা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার শপথ নিয়েছে। খবর বিডিনিউজের।
৫২ বছর বয়সী ফেরদৌস এক সময় ছিলেন ইঞ্জিনচালিত নৌকার মাঝি। সাগরে নৌকা চালাতে চালাতেই এক সময় জড়িয়ে পড়েন জলদস্যুতায়। তার মা মা সফুরা খাতুন ও স্ত্রী হাসিনা আক্তারও এসেছিলেন আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে। খুব অস্পষ্ট, নিচু স্বরে সফুরা খাতুন বলেন, ছেলে স্বাভাবিক জীবনে আসবে; এটাই সুন্দর হবে। হাসিনা আক্তার বলেন, অনেক কষ্ট করেছি, এখন চাই আত্মসমর্পণ করে আমাদের কাছে চলে আসুক।
এদিন এই অনুষ্ঠানে আত্মসমর্পণ করা জলদস্যুরা ৯০টি আগ্নেয়াস্ত্র ও দুই হাজার ৫৬টি গুলি জমা দিয়েছে। তাদের স্বজনদের অনেকেই এসেছিলেন, স্কুলের মাঠের এক কোণে ভিড় করেছিলেন তারা। সেখানে কথা হল কুতুবদিয়ার বাঁকখালীর তৌহিদ ইসলাম মানিকের (৩৪) স্ত্রী পপির সঙ্গে। এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়েই মাঠে এসেছিলেন তিনি। পপি বলেন, পাশের বাড়ির করিম নামে এক ‘খারাপ লোকের’ সঙ্গে মিশে জলদস্যু হয়ে যায় তার স্বামী। সেই করিম এখন কারাগারে। তিনি বলেন, আমার স্বামী আগে কৃষি কাজ করত। এই খারাপ কাজে জড়ানোর পর আমাকেও দুই বাচ্চা নিয়ে এলাকা ছেড়ে চকরিয়ার আজিজ নগর চলে যেতে হয়েছে।
মানিক এ পর্যন্ত দুবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে ছয় মাস ও আট মাস করে জেল খেটেছে। এখন তিনি আত্মসমর্পণ করায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবে, তার বিরুদ্ধে থাকা মামলাগুলো সরকার মাফ করে দেবে বলে আশা করছেন পপি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে র্যাব ৭ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মশিউর রহমান বলেন, ধর্ষণ ও হত্যা মামলা থাকলে কিছু করার নেই। অন্য মামলাগুলো থেকে তাদের কিভাবে রেহাই দেওয়া যায় সে বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আমরা ব্যবস্থা করব। তবে এসব মামলায় তাদের নিয়মিত হাজিরা দিয়ে যেতে হবে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও ধর্ষণ ও হত্যা মামলা ছাড়া অন্য মামলায় আইনগত সহায়তা দেওয়ার আশ্বাস দেন আত্মসমর্পণ করা জলদস্যুদের। অন্য যারা এখনও দস্যুতায় লিপ্ত, তাদেরও তিনি আত্মসমর্পণ করার আহ্বান জানান। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবেন মনজুর আলম (৪২), এই আশা বুকে নিয়েই স্কুলের মাঠে এসেছিলেন তার স্ত্রী লায়লা। তিনি জানান, তার স্বামী মাছের খামারে কাজ করতেন; কখনও খারাপ কিছু তিনি দেখেননি। আর মনজুর আলমের ছোট ভাই বদিউল আলম দাবি করেন, দুশমনি করে তার ভাইকে বিভিন্ন মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। কুতুবদিয়া উত্তর দুরুম ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাহাবুদ্দিনের স্ত্রী আনোয়ারা বেগমও বলেন, তার স্বামী লবণের খামারের শ্রমিক, তার নামে মামলা করা হয়েছে শত্রুতা করে।
সাহাবুদ্দিনের আগে তিনবছর জেল খেটেছেন জানিয়ে আনোয়ারা বলেন, এখন আর অতীত নিয়ে ভাবতে চাই না; স্বামীকে নিয়ে বাকি জীবন ভালোভাবে কাটাতে চাই। তিনি জানান, রিগান ও রায়হান নামে ১২ ও ১০ বছরের দুটি ছেলে আছে তাদের। দুই সন্তানের ভবিষ্যত ভালো হোক, এখন এটুকুই চাওয়া তার।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক আশিক বিল্লাহ বলেন, ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর সুন্দরবনকে ‘জলদস্যু মুক্ত’ ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী। আজকের ৩৪ জন নিয়ে মোট ৪০৫ জন জলদস্যু এ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করেছে। এদের মধ্যে ৩২৬ জন সুন্দরবনের ৩২টি বাহিনীর সদস্য ছিল। এছাড়া ৪৩ জন মহেশখালী এবং আজ (গতকাল বৃহস্পতিবার) আত্মসমর্পণ করা ৩৪ জন বাঁশখালীর। এই এলাকায় ৭৭ জন জলদস্যু এ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করেছে। আমরা আশা করছি এ এলাকা জলদস্যু মুক্ত হবে।
বাঁশখালী বাজারের মোস্তাফা জেনারেল স্টোরের মালিক নুরুল আলম বলেন, সাগর তীরের গ্রাম পশ্চিম বাঁশখালী, সরল, গণ্ডামারা, শেখেরখীল, বাহারছড়া, কদমরসুল, খানকানার যুবকদের মধ্যেই জলদস্যুতায় জড়ানোর প্রবণতা বেশি। সাগরের তীরে এইসব গ্রামে মাছ ধরে আর লবণ চাষ করেও অনেক মানুষ ভালো আছে। প্রচুর সবজিও হয় এখন। চাইলে জলদস্যু না হয়েও ভালো থাকা যায়।