চলতি অর্থবছরে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৮২০ মার্কিন ডলার। এই মাথাপিছু আয় এ যাবৎকালের রেকর্ড। গত ২০২৩–২৪ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ছিল ২ হাজার ৭৩৮ ডলার। গত অর্থবছরের চেয়ে মাথাপিছু আয় বেড়েছে ৮২ ডলার। দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি নিঃসন্দেহে একটি সুসংবাদ। গত মঙ্গলবার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ২০২৪–২৫ অর্থবছরের মাথাপিছু আয়ের এ তথ্য প্রকাশ করে। সাময়িক হিসাব দেওয়া হয়েছে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি)। বিবিএসের তথ্য মতে, ২০২১–২২ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ছিল ২ হাজার ৭৯৩ ডলার। এরপর ২০২২–২৩ অর্থবছরের মাথাপিছু আয় কমে দাঁড়ায় ২ হাজার ৭৪৯ ডলারে। গত অর্থবছরে তা আরও কমে ২৭৩৮ ডলার হয়। আজাদীতে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, মূলত ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যাওয়ায় বিবিএসের হিসাবে মাথাপিছু আয়ের পার্থক্য হয়। চলতি অর্থবছরের বিবিএসের মাথাপিছু আয় হিসাব করতে প্রতি ডলারের গড় বিনিময় হার ধরা হয়েছে ১২০ টাকা ২৯ পয়সা। গতবার এই বিনিময় হার ধরা হয়েছিল ১১১ টাকা ৬ পয়সা। চলতি অর্থবছরে টাকার অঙ্কে মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৩৯ হাজার ২২১ টাকা। গত অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৪ হাজার ১০২ টাকা। উল্লেখ্য, মাথাপিছু আয় ব্যক্তির একক আয় নয়। দেশের অভ্যন্তরীণ আয়ের পাশাপাশি প্রবাসী আয়সহ যত আয় হয়, তা একটি দেশের মোট জাতীয় আয়। সেই জাতীয় আয়কে মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করে এই হিসাব করা হয়।
দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির বিষয়টি অন্তর্বর্তী সরকারেরও বড় অর্জন। তবে দেশের শতভাগ মানুষ কখনোই একটি সরকারের সকল অর্জনকে সমান চোখে দেখবে না। আমরাও সেটা প্রত্যাশা করি না। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশ মাথাপিছু আয়ে চমক দেখিয়ে আসছে। বলা হচ্ছে প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে আপন গতিতে।
অর্থনীতিবিদরা বলেন, আমাদের দেশে উন্নয়ন হচ্ছে ব্যাপকহারে। তবে তা সমানুপাতিক হারে সবার ভাগে পড়ছে না। সমাজে ধনীর সংখ্যা বাড়ছে তড়তড় করে। কিছু লোকের হাতে ধন সম্পদ জমা হচ্ছে এমনভাবে, যার ভাগ দেশের সাধারণ মানুষ পাচ্ছে না। এ অবস্থাতেও বাংলাদেশের জিডিপি বেড়েছে অবাক করা সংখ্যায়। এই অর্জনের ঘোষণা সরকারের পক্ষ থেকে আসে নি। এর স্বীকৃতি এসেছে আন্তর্জাতিক কর্তৃপক্ষের কাছ থেকেই। এবার ভাবতে হবে সীমিত আয়ের বিপুলসংখ্যক মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন নিয়ে। দেশের অর্থনীতি যেভাবে এগোচ্ছে, সর্বশ্রেণির মানুষের জীবনযাত্রার মানও সেভাবে বাড়াতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ সামাজিকভাবে বসবাস করে। সমাজে যখন দুর্নীতি, ঘুষ, চৌর্যবৃত্তি এবং সামাজিক অপরাধ বেড়ে যায় তখন একই সমাজ ব্যবস্থার কিছু মানুষের আয়, দুর্নীতি, চুরি, চাঁদাবাজি বেড়ে যাওয়ার কারণে এসব চোরগুলোর আয় বেড়ে যায়। সন্ত্রাসী, চোর দুর্নীতিবাজরা হয়ে উঠে প্রচুর সম্পদের মালিক। বিশাল বিশাল বাড়ি, গাড়ী ও অন্যান্য সম্পদের মালিক বনে যায় তারা। তারই পাশে বসবাসরত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা তখন নিজকে অসহায় মনে করে ও নিজের অজান্তে সমাজ ব্যবস্থার কাছে অপরাধী হয়ে যায়। পারিবারিকভাবেও অসহায় হয়ে যায়। এ অবস্থায় যে যে পদে দায়িত্বরত সেই ব্যক্তিদের প্রত্যাশা বাড়তে থাকে। আর এ প্রত্যাশ্যা পূরণ করার জন্য তিনিও হয়ে উঠেন দুর্নীতিবাজ পদস্থ ব্যক্তি। এ অসম সামাজিক ও মানসিক প্রতিযোগিতার কারণে প্রতিটি অফিসে বা সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে বা সর্বক্ষেত্রে চালু হয় ঘুষ, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি। এ প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে মিল না থাকার কারণে সমাজ ব্যবস্থায় গড়ে ওঠে বৈষম্য। এ পরিস্থিতি থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য আয়ের অসম বন্টনকে প্রথমে নজরে আনতে হবে। দুর্নীতিবাজদের লাগাম শক্ত হাতে টেনে ধরতে হবে। তাদের ওপর অধিক হারে কর আরোপ করে সরকারকে সেই অর্জিত কর দরিদ্রদের কল্যাণে ব্যয় করতে হবে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে ব্যাপক হারে কর্মে নিয়োজিত করে তাদের আয় বৃদ্ধির চেষ্টা করতে হবে।
মানুষের আয়ুষ্কাল, কৃষি উৎপাদন, শিক্ষার হার, মাথাপিছু রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয় বেড়েছে। বলা যায় অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে এখন সমৃদ্ধ সময়। বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটেও মাথাপিছু আয় বাড়ার ঘটনা সেই সাফল্যেরই বহিঃপ্রকাশ।