‘দরদীয়ারে বন্ধু’ : মরমী সুফীবাদের অনন্য দর্শন

জসিম উদ্দিন খান | মঙ্গলবার , ১২ নভেম্বর, ২০২৪ at ৫:২৮ পূর্বাহ্ণ

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শেষ লেখাকাব্যগ্রন্থের ‘প্রথম দিনের সূর্য’ কবিতাটি বহুল পঠিত একটি কবিতা। প্রথম দিনের সূর্য/ প্রশ্ন করেছিল/সত্তার নূতন আবির্ভাবেকে তুমি,/মেলে নি উত্তর। বৎসর বৎসর চলে গেল,/দিবসের শেষ সূর্য/ শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল পশ্চিমসাগরতীরে,/নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়কে তুমি,/পেল না উত্তর।

বিজ্ঞানীগণ হাজার বছর ধরে যে প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন, কবিগুরু সেই প্রশ্নের উত্তরই দিলেন তাঁর প্রথম দিনের সূর্য কবিতায়।

মূলত এ বিশ্ব সংসারে মানবসৃষ্টি স্রষ্টার এক বিস্ময়কর ও রহস্যপূর্ণ কর্ম। বিচিত্র মানব জীবনধারা, এর উদ্দেশ্য ও পরিণতি, আদি বা শেষ কোত্তেকে বা কোথায় এ প্রশ্ন চিরন্তন ও আজো অমীমাংসিত। বাস্তবিকই, মানব জীবন বড়ই বিচিত্রময়। আমাদের মনের ভেতর যে মানুষের বাস তার নাম কেউ জানে না। সে মানুষ নাকি আরো শক্তিধর তা কেউ বলতে পারে না। কিন্তু মানুষের হৃদয়ে যে সুরের অনুরণন চলছে নিরন্তর তার প্রকাশের ভিন্নতা তাকে নানাভাবে চিহ্নিত করতে পারে। সুরের প্রকাশের ভেতর তার পরিচয়। সুতরাং সুর আর মানুষ এক অভিন্ন সূত্রে গাঁথা। এই সুর যিনি ধরে আছেন তিনি কিন্তু অধরা। আর এই অধরাকে লাভ করার জন্যেই মানুষ উপাসনা করে, আরাধনা করে, ধ্যান করে। তাই এই অধরার রূপ দেখতে যেমন ব্যাকুল ওলি, সাধক, পীর, সুফী, দরবেশ, জ্ঞানী, ধ্যানী; তেমনি সুরের অনুরণনে অধরা নিরঞ্জনের সন্ধানে ব্যাকুলতার প্রকাশ ঘটে আধ্যাত্মিক, মরমী, সুফী, বাউল, বিচ্ছেদ, দেহতত্ব, মারফতী, মুর্শিদী গানে। ভাব, ভক্তি, নুর, রস, প্রেম, মায়া, দয়া, মুক্তি, বিরহ, সাধনা, আকুতি প্রভৃতির রূপ মুগ্ধতায় বিভোর লালন সাঁইজী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, হাছন রাজা, শাহ আবদুল করিম, রাধা রমন, আরকুম শাহ, রাকিব শাহ, দুরবীন শাহ, রমেশ শীল, মাওলানা হাদী, মাওলানা বজলুল করিম প্রমুখ সাধকগণ সুরে, কথায়, ছন্দে সে আধ্যাত্মিকতা ধারণ করে এরই আবহ ছড়িয়েছে বিশ্বে প্রান্তরে। তারই বিষয় ও বর্ণনার ধারাবাহিকতায় কবি, গীতিকার ও বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী ইকবাল হায়দার তাঁর ‘দরদীয়ারে বন্ধু’ গ্রন্থের অবতারণা করেছেন। আধ্যাত্মিকতার ওপর তিনি শুধু এই গ্রন্থভুক্ত গানই রচনা করেননি। তাঁর সংকলিত ‘আমার রচিত যত গান’ এর পাশাপাশি তিনি ‘লোকসঙ্গীতে আধ্যাত্মিকতা ও বিবিধ অনুষঙ্গ’ শিরোনামে প্রবন্ধ সম্ভারও রচনা করেছেন যা শিল্পীসমাজে ও পাঠক সমাজে ব্যাপক সমাদৃত হবে বলে আশা রাখি।

ইকবাল হায়দার মূলত এ জনপদের একজন সুপরিচিত সংগীতশিল্পী। আধ্যাত্মিক, মরমী বা ফোক ঢংয়ের গানে তিনি সুপরিচিত একজন মানুষ। এ ধরনের গানগুলো জনমনে স্থান পাওয়ার জন্য যে ধরনের কণ্ঠশৈলী দরকার ইকবাল হায়দারের কণ্ঠ যেন সে কণ্ঠেরই একটি নিরেট প্রতিচ্ছবি। যুগে যুগে সংগীত আমাদেরকে মানবিক ও সংস্কৃতিবান মানুষ হিসাবে তৈরি করতে ভূমিকা রেখেছে। ইকবাল হায়দারের প্রাথমিক জীবন লেখালেখির মাধ্যমে শুরু হলেও তাঁর মনে সংগীত প্রেমের সুপ্ত এক বাসনা লুকায়িত ছিল তিনি একজন সুপ্রতিষ্ঠিত শিল্পী হয়ে তা প্রমাণ করেছেন। বেতার ও টেলিভিশনে তাঁর সগৌরব পদচারণা। লেখালেখির প্রাথমিক যে দিকটা তাঁর মাঝে উজ্জ্বলভাবে দৃশ্যমান ছিল একজন সুপ্রতিষ্ঠিত সংগীত শিল্পী হয়েও তা থেকে তিনি বিচ্যুত হননি। সে কারণে সংগীত চর্চার পাশাপাশি লোক সংগীতের গবেষণাধর্মী লেখালেখিতেও তিনি নিবেদিত থেকেছেন নিবিষ্টচিত্তে। লোকসংগীত, ফোক, আধ্যাত্মিক ঘরানার প্রচুর গান তিনি আমাদের উপহার দিয়েছেন। তাঁর লেখা গানের সম্ভার নিয়ে বেশ কিছু বইও তিনি প্রকাশ করেছেন। এই প্রকাশিত বইগুলোর মধ্যে দরদীয়ারে বন্ধুচমৎকার আধ্যাত্মিক ভাবধারা বা লোক সংগীত ভাবধারার সমাহারে পরিপূর্ণ একটি বই। বইটিতে মোট ১০০ টি গান স্থান পেয়েছে। গানগুলোর ভাবার্থ আত্মস্থ করতে হলে বইটির ভেতরে ডুব দিতে হবে বারবার। গানগুলোর বাণী ও শব্দ চয়নে চমৎকারিত্ব রয়েছে। স্বাভাবিক গানের বৈচিত্র্য থেকে আধ্যাত্মিক বা লোক সংগীত ঘরানার গানগুলো স্বাভাবিকভাবেই বিষয় বৈচিত্র্যে অন্যরকম হবেই। এ ধরনের গান রচনার পারঙ্গমতা ইকবাল হায়দারের মত লেখক সত্তার কণ্ঠশিল্পীর মাধ্যমেই সৃষ্টি সম্ভব। যার ধ্যান জ্ঞান ও নিবিষ্টতা এই ঘরনার গানে সীমাবদ্ধ থাকে তিনিইতো আমাদের লোকজ গানের নানা প্রশাখায় বিচিত্রভাবে বিচরণ করতে পারেন।

বইটির প্রথম গানেই তিনি শিল্পীসত্তার পাশাপাশি একজন গীতিকার হিসাবে মুন্সীয়ানারই পরিচয় দিলেন। একজন যে ঘরনার গান পরিবেশনে সিদ্ধহস্ত তার থেকে এ ধরনের আধ্যাত্মিক বা অদৃশ্য সৃষ্টিকর্তার শানে লোকগীতি ধারার গানতো জন্ম নিতেই পারে। তিনি লিখছেন– ‘দিলের কথা কইলি না, নয়ন মেলে দেখলি না, অভাগার প্রাণ কেমনে বাঁচে তোমার দরশন বিনা।’ এখানে লেখকের কল্পনাকে আমরা নানামুখী বিশ্লেষণের ধারায় টানতে পারি। এখানে কলবপুর বা কামিনী কাঞ্চন নামক শব্দের যে ব্যবহার দেখি তা লেখকের শব্দ সংযোজনের বৈচিত্র্যে অনন্য। ‘কেমনে পাশরি বন্ধু/ তোমার যাদুর মায়া, আগুন লাগাইয়া গেলা/ পুড়ে অঙ্গার কায়া’ সৃষ্টিকর্তার সাথে তার প্রাণের আকুতি গানের বাণীতে প্রাণময় হয়ে ফুটে উঠেছে। এখানে পাশরি কিংবা কায়া শব্দের যে ব্যবহার তা এ ধরনের গানের বাণীতেই সম্ভব। ইকবাল হায়দার এই বইয়ের প্রত্যেক গানেই এরকম আধ্যাত্মিক বা সুফিবাদ ঘরানার গান বলেই টেনে এনেছেন এরকম প্রচুর শব্দ। ‘মনের মানুষ কোন ভুবনে/ অটল মানুষ নাই, অধর মানুষ দেয় না ধরা/ মানুষ রতন নাই।’ এ রকম একটা গানের স্থায়ী কথা চমৎকার। সে গানের শেষ অন্তরাতে তিনি লিখছেন ‘চুয়া চন্দন, আতর, গোলাপ/ দিয়া কুঞ্জ সাজাই, কৃষ্ণরূপে কদম ডালে/ বাঁশরী বাজাই, যমুনারই জল উছলায়/ ঢেউ লাগে তার কূলে যাই।এখানে নিজেকে কৃষ্ণরূপ কল্পনা করে নিজেকে পরম পিতার কাছে সমর্পণ করেছেন শিল্পী। এক ধরনের আত্মভোলা প্রেমিক হয়ে তিনি নিজেকে কল্পনা করেছেন পরমাত্মার সান্নিধ্যে।

ঘরের মধ্যে ঘর, /অতি মনোহর, আটচল্লিশ কুঠুরী তাতে/ দেখিতে সুন্দর।’ পুরো গানটাই চমৎকার। সবকটি লাইনেই রয়েছে আধ্যাত্মিকতার পরশ। আমাদের মানব জীবনের আধ্যাত্মিকতার এই বিষয়গুলো সুফিবাদ ঘরানার সুফি সাধকের কথায় নানাভাবে চিত্রিত হয়েছে। এই গানটি সহ আরো অনেক গানে এরকম ভাবধারার সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন শিল্পী গীতিকার ইকবাল হায়দার।

বেদ কি তার মর্ম জানে/ কী রূপে সাই লীলা করে, এই দেহে এই অন্তরে জন্ম জন্মান্তরে।’ এ গানের কথার শেষ অন্তরাতে তিনি বলছেন ‘আল্লাহ হরি ভজন পুজন সকলি মানুষের সৃজন, দেহের সাধন আমার সার, বিবাগী এ রং সংসারে।’ সৃষ্টি কর্তা এক অদ্বিতীয় এবং তা ভিন্ন ভিন্ন পথেই মানুষের আবাহন। সকল কিছুর মূলেই মানুষের কল্যাণ। রঙের এ সংসারে মানুষ বাইরেরই আবরণ মাত্র। তার গানে এ সব বিষয়ও চমৎকারভাবে তুলে ধরা হয়েছে। মানুষের মনে গান অসামপ্রদায়িক জাগরণও সৃষ্টি করতে পারে। তা সময়ে সময়ে নানা গীতিকার কবিদের লেখায় পরিস্ফুট হয়েছে। ‘মুর্শিদের রূপ অপরূপ/ নয়নে না হেরি, আকাশ মাটি জল আগুনে/ সে করে তাই ফেরি।’ অদৃশ্যতার আড়ালেই তো অনেক কিছু। ভাব জগতের মানুষের আছে কল্পনার আরেক জগত। সে জগত শুধু তারাই দেখে যারা অদৃশ্য শক্তির কাছে নিজেকে সমর্পণ করেন। তাদের সে ভাবনায় বাংলার পথপ্রান্তরে রচিত হয়েছে কত অমর গীতিকাব্য। সেই অজানা অদৃশ্য জগতের জাগতিক ভাবনাগুলোকেই অন্যদের মত তুলে আনার প্রয়াসী হয়েছেন ইকবাল হায়দার তাঁর অনেক গানের বাণীতে। তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য কিছু গানের স্থায়ী শুরু হয়েছে এভাবে– ‘উড়ে গেলো সাধের পাখি/ অসীম অন্ধকারে, আর পাব না ছুটে তারে/ এ দেহ সংসারে’। প্রাণে আগুন আর দিও না/ এই অবলা বিনয় করি, হয়তো দিও দেখা না হয়/ পরানটারে নিও হরি,’ ‘এসে ভবের হাটেতে/ সারা জনম বাইলাম তরী, একই ঘাটেতে’। ‘নির্ধনিয়ার ধন তুমি নির্ধনিয়ার ধন, এই ভুবনে তোমার চেয়ে নাইরে আপনজন,’ (‘আমি ভাব করেছি নিজের সনে,/মন বেঁধেছি মনে মনে, ঘুরছি কখন বৃন্দাবনে’। আমার মন যমুনায় ঢেউ লেগেছে ঢেউ/, কার ছায়া দেখছি জলে (বানান ছিল জ্বলে) ভালো কি বেসেছে কেউ?’ ‘যতই তত্ত্ব খুঁজিস ওরে, চিরকাল রাখবে না তোরে, সুন্দর এ ধরা,’ ‘আধরার মুরতি কেমনে ধরি/ আমি ভাব সাগরে মরি ডুবে, নিত্য জপি আল্লাহ হরি’, ‘নিরঞ্জন পাখি আমার/ নিরঞ্জন পাখি, কোন শিকলে তোরে বেঁধে রাখি,’। ‘আমি ধর্ম করি/ মর্ম না বুঝে, ওরে সাধু সন্ন্যাস ঘুরে মরে/ কাহারে খুঁজে,’) – এ গানগুলোর ভাবধারায় রয়েছে অদৃশ্য পরমাত্মার প্রতি এক ধরনের প্রচ্ছন্ন টান, আবেগ ভালোবাসা বা আকুতি। সে আকুতি ধরা দিয়েছে নানা বৈচিত্র্যে ও কল্পনায়।

এ রকম গানের আরো অনেক উদাহরণ এখানে টানা যায়, একশত গানের প্রতিটি বাণীকে টেনে এনে বিশ্লেষণ করা দুরূহ এবং সময়সাপেক্ষও বটে। তবুও কিছু গানের বিশ্লেষণ টেনে সমগ্র বইয়ের একটি চিত্র তুলে প্রয়াস এখানে নিলাম। ‘কালার বাঁশি না বাজলে আর/ কি হবে রাধিকা তোমার, যমুনার জল যদি না উছলায়/ কি আর হবে বৃন্দাবন/ শূন্য রবে নিধুবন /যতই চোখের জল ফেল পায়’ গানটিতে রাধা কৃষ্ণের সেই চিরায়ত বিরহকে তুলে ধরেছেন তিনি। এ নিয়ে সংগীতের ইতিহাসে বহু কালজয়ী গান রচিত হয়েছে। তিনিও এর মধ্যে নিবিষ্ট থাকার চেষ্টা করেছেন। এ রকম ভাবধারার আরো বেশ কিছু গান তিনি এখানে স্থান দেয়ার চেষ্টা করেছেন।

বইয়ের নাম ‘দরদীয়ারে বন্ধু’ ( পৃষ্ঠা ৮৩)-তার নাম ভূমিকা নিয়ে গানটিতে গীতিকবি বলছেন, ‘দরদীয়া রে বন্ধু/ যাসনেরে ছেড়ে/ ভাসিয়ে নয়ন জলে/ কে শোনাবে মধুর বাঁশি /যমুনার কূলে আসি/ বসে কদম তলে,’- বিরহ কাতরতায় গানের বাণীগুলো হৃদয়কে স্পর্শ করেছে দারুণভাবে। গানের সুরের প্রাধান্য অন্যতম একটা দিক। পড়ে গানকে হৃদয়ে যতটুকু স্থান দেয়া যায়, শুনে তার চেয়ে অধিক গানকে হৃদয়ে ধারণ করা যায়। সব মিলিয়ে ইকবাল হায়দারের গানের বই চিন্তা চেতনা ভাবধারায় ব্যতিক্রমি একটি প্রয়াস। বইটি কালধারা প্রকাশনীর একটি চমৎকার প্রকাশনা। ২০২২ সালে প্রকাশিত বইটির মূল্য রাখা হয়েছে ২২০ টাকা। ইকবাল হায়দার যে ধরনের গান করেন সে ধারার গানের শিল্পী সমাজে খুব কমআবার থাকলেও সেই ঘরানার গান লেখাতে অনেকেই সিদ্ধহস্ত নন। সে কারণে ইকবাল হায়দার তাঁর শিল্পীসত্তার পাশাপাশি ব্যতিক্রমী এ গান লেখার চর্চায় নিবেদিত থাকলে আমাদের সংস্কৃতি জগৎ আরো উজ্জ্বলতর হবে।

লেখক: শিশুসাহিত্যিক, গীতিকার, ব্যাংকার।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাংলাদেশের শ্রম আইন এবং গার্মেন্টস শ্রমিকদের অধিকার ও চ্যালেঞ্জ
পরবর্তী নিবন্ধ‘সব সময় নিজের ভেতরের শক্তিকে পরিচর্যা করতে হবে’