একজন শিক্ষিত মা বা নারী চাকরি করবে বা কাজ করবে এটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া এই চড়া দ্রব্যমূল্যের বাজারে দুজনের কর্মসংস্থানেরও দরকার আছে। একটা গাড়ির দুটো চাকা না হলে যেমন গাড়িটা সমানতালে চলে না; ঠিক তেমনি এই যুগে দুজনের সমান অংশগ্রহণ না হলেএকটা সংসার পরিপূর্ণভাবে চলে না। একজন নারী নিজের দক্ষতা যোগ্যতা নিষ্ঠা ও কর্ম দিয়ে বাইরে অন্যের অধীনে কাজ করে অর্থ উপার্জন করে। পাশাপাশি ঘরে সন্তান লালন করে গৃহিণীর ভূমিকাও পালন করে। এই দুই ভূমিকা কিন্তু চাট্টিখানি কথা নয়। শিশু পবিত্র নিষ্পাপ এবং সুন্দর। প্রতিটি শিশুরই অধিকার রয়েছে পৃথিবীতে সুন্দর ভাবে বেড়ে ওঠার। নারী মানে মায়ের জাত, সন্তানের সাথে যার নাড়ির বন্ধন। একজন যোগ্য শিক্ষিত কর্মক্ষম নারী যখন কোনো কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানে যোগদান করেন তখন শুধু নিজের উন্নতিই নয় একটা কোম্পানির তথা দেশের রাষ্ট্রের উন্নতিও সাধন করেন। এভাবে একজন নারী তার জীবনসঙ্গীকে বা সংসারে আর্থিক সহযোগিতা করে থাকেন। স্বাচ্ছন্দ্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নারী যখন সংসারে বিরাট একটা ভূমিকা রাখেন ঠিক তখনই মা হবার কারণে তাকে পীড়া দেয় বাচ্চার লালন পালন। এই দুশ্চিন্তা তাকে কুরে কুরে খায়। না পারে এতদিনে হাসিল করা দুর্লভ চাকরি ছাড়তে, না পারে নিজের বাচ্চার লালন–পালনের ভার অন্য কারো হাতে সপে দিতে। এখন তো যৌথ পরিবারের চেয়ে একক পরিবারের সংখ্যা অনেক বেশি। কোনো কোনো পরিবারে হয়তো নানা–নানি কিংবা দাদা –দাদির মতো মুরুব্বী থাকতে পারে। আবার অনেক সময় সেই দাদা–দাদী বা নানা–নানীর শারীরিক মানসিক আর্থিক বা পারিপার্শ্বিক অবস্থা বাচ্চাকে দেখাশোনার মতো অনুকূলে থাকে না। অনেক পরিবারে স্বামী বা অন্যান্য সদস্যরা মিলে ওই মা বা নারীকে চাকরি ছেড়ে দেয়ার জন্য বাধ্য করে অথবা বিরূপ আচরণ করে। এভাবে একদিকে সন্তান আরেকদিকে লোভনীয় চাকরি। আর তার সাথে সকলের সহিংস আচরণ। এসব কিছুর সাথে সমন্বয় করতে করতে এক সময় হারিয়ে ফেলে জীবনের তাল। নিজ হাতে গলাটিপে হত্যা করে নিজের স্বপ্ন এবং আর্থিক স্বাধীনতা।
অনেকের মতে, এসব কিছু থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায়, ডে কেয়ার সেন্টার। এখানে বাচ্চাকে সুরক্ষিত নিরাপদ ভাবে রেখে মা নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারেন। এতে করে মায়ের শারীরিক–মানসিক স্ট্রেস থাকে না। কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার সময় যদি মা নিজের শিশুটিকে সাথে করে নিয়ে যান এবং সময় হলে দেখতে যেতে পারেন আর আসার সময় সাথে করে নিয়ে আসেন তাহলে কেমন হয় বলুন তো। আমার মনে হয় এতে করে সম্পূর্ণ নিশ্চিত থেকে এই মহিলা সঠিকভাবে কাজে মনোনিবেশ করতে পারবেন।
আমাদের সমাজে একটা কথা প্রচলিত আছে– চাকরিজীবী মায়েদের বাচ্চা অবহেলায় বড় হয়। মা ঠিকমতো যত্ন নিতে পারেন না। স্বাভাবিকভাবে একজন মা তার সংসারে শুধুমাত্র বাচ্চা দেখাশোনাই করেন না। তার সাথে সংসারে প্রচুর দায়িত্ব তার পালন করতে হয়। একা একজন মা কখনো একটা বাচ্চার ডেভেলপ করতে পারেন না।
আন্তর্জাতিক বয়স ছয় বছরে শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। স্কুলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত অর্থাৎ (সাড়ে ৩ থেকে ৬এর ) এমনি পরিবেশে একটা বাচ্চার প্রাক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ থাকে। ডে কেয়ার সেন্টারে একই সাথে অনেকগুলো বাচ্চা থাকে বলে সোশ্যালিটি বা সামাজিকতা শেখার সুযোগ পায়।এখানে ট্রেনিংপ্রাপ্ত শিক্ষিত সুযোগ্য লোক রয়েছে শিশুদের দেখাশোনার জন্য। খাওয়া দাওয়া পরিচর্যা খেলাধুলা করার যথেষ্ট পরিবেশ রয়েছে এখানে। কীভাবে চলাফেরা করতে হবে কখন কোন পরিবেশে কীভাবে মানিয়ে নিতে হবে মানুষের সাথে কিভাবে বিহেভ করতে হবে এই ম্যানার্সগুলো এখানে শেখানো হয়। আনন্দের সাথে গানে গানে ছন্দে ছন্দে শেখানো হয় ছড়া কবিতা। শিশুদের বিকাশের সুন্দর পরিবেশ বলা যায়। কিছু অর্থের বিনিময়ে মাও শান্তিতে কাজ করলো বাচ্চাও সুরক্ষিত থাকলো। চাকরিজীবী মহিলার মনে ভয় থাকে বাসায় বাচ্চা ঠিকমতো আছে কিনা।
বাসায় কোনো কাজের লোক বা আত্মীয়–স্বজনের কাছে বাচ্চা দেখাশোনার দায়িত্ব দিলেও মা সবসময় কর্মক্ষেত্রে টেনশনে থাকেন। বাচ্চা ব্যথা পেলো কিনা কান্না করছে কিনা ঠিকমতো খাওয়া–দাওয়া করছে কিনা কোনো সমস্যা হলো কিনা ইত্যাদি। যদি ঊনিশ বিশ হয়ে যায় সমস্ত অপরাধ এসে পড়বে চাকরির ওপর। শুনতে হবে নানা কটূক্তি অপবাদ। এ ধরনের নারীরা যখন সরকারি অথবা বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানে বা কোম্পানিতে যোগদান করেন এবং বাচ্চার কারণে হঠাৎ করে চাকরি ছেড়ে দিতে হয়; তখন কিন্তু ওই কোম্পানিরও যথেষ্ট ক্ষতি সাধিত হয়।
এই দুই–ই যদি আমরা সুরক্ষিত রাখতে চাই তাহলে দরকার ডে কেয়ার সেন্টার। কর্মজীবী মহিলা এবং মালিক উভয়ের সুবিধার জন্য দেশের প্রতিটি কর্মসংস্থানে যদি ডে কেয়ার সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয় তাহলে দেশের তথা দশের অর্থনীতি সমৃদ্ধি লাভ করবে। ডে কেয়ার সেন্টার অবশ্যই উপযুক্ত এবং চমৎকার একটি স্থান যেখানে একটি শিশু সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠার পরিবেশ পাবে।
নিশ্চিন্তে নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারবেন একজন নারী। নারী কর্মীর কর্মদক্ষতা সমৃদ্ধি সফলতা বাড়বে নিঃসন্দেহে। ডে কেয়ার সেন্টার সাধারণত কীরকম হওয়া চাই এ নিয়ে উদ্যোক্তাদের অবশ্যই সুচিন্তিত মনোভাব পোষণ করা দরকার। সাড়ে তিন থেকে ছয় বছরের আগ পর্যন্ত অর্থাৎ স্কুলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত বয়সী বাচ্চারা ডে কেয়ারে থাকে। দেশে প্রায় ৬৩ টি ডে কেয়ার সেন্টার রয়েছে। তার মধ্যে ঢাকায় রয়েছে ৩৫ টি। এখানে সরকারি বা ব্যক্তি মালিকানাধীন দু‘ ধরনের ডে কেয়ার সেন্টার রয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ডে কেয়ার সেন্টারের কিছু নীতিমালা বা সুচিন্তিত পদক্ষেপ নিয়েছেন। অনেকটা কাজও শুরু করে দিয়েছেন। কারো ইচ্ছে হলে কিন্তু যেমন তেমন করে একটা ডে কেয়ার সেন্টার প্রতিষ্ঠা করতে পারেন না। এক্ষেত্রে শিশুদের বিকাশের এক একটা ধাপ নিয়ে সূক্ষ্মভাবে ভাবতে হবে এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।অনেক সময় দেখা যায় অনেকগুলো বাচ্চা একটা নির্দিষ্ট জায়গায় কোনরকমে ধরে রাখা হয়। যাতে কোনো এক্সিডেন্ট না হয়। তারপর অফিস ছুটি হলে যার যার বাচ্চাকে জাস্ট হাতে ধরিয়ে দেয়। মনে হয় কোনো রকমে দায়ভার থেকে মুক্তি পাওয়া। শিশুদের বয়সের ক্যাটাগরি অনুযায়ী লোক নিয়োগ করা দরকার। উচ্চ শিক্ষিত কর্মীর চেয়ে উপযুক্ত এবং আন্তরিক কর্মীই এখানে বেশি প্রয়োজন যাদের শিশুর প্রতি ভালোবাসা রয়েছে। বাচ্চাদের সঠিক বিকাশের বিষয়টি মালিক যেনো তদারক করতে থাকেন।
সরকার এবং সমাজের ক্ষমতাসীন ব্যক্তি যদি কর্মক্ষেত্রের সাথে সাথে দ্রুত ডে কেয়ার সেন্টার প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নেন তাহলে এই সমস্যা নিরসনে বেশি সময় লাগবে না বলে আমি মনে করি। এক কথায় শিশু পালনের সংকট কাটিয়ে নারীকর্মী উপহার দেবে একটা সুন্দর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ।