দিনভর ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া, ঢিলবৃষ্টি আর মারপিটের পর রাজধানীর নিউ মার্কেট এলাকায় দোকানকর্মীদের সঙ্গে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে বিরতি মিললেও পুরো এলাকায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সায়েন্স ল্যাবরেটরি থেকে নিউ মার্কেট পর্যন্ত সড়কে আগের রাত থেকেই যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল। সন্ধ্যায় মারামারির বিরতিতে গাড়ির চাকা আর ওই পথে গড়ায়নি। রিকশা, অটোরিকশার মতো দুয়েকটি বাহন সাহস করে চলার চেষ্টা করলেও ছাত্ররা তাদের সরিয়ে দেয়।
এদিকে দফায় দফায় সংঘর্ষের মধ্যে আহত একজন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। তার নাম নাহিদ হাসান (২৩)। তিনি ডি লিংক নামে একটি কুরিয়ার সার্ভিসে ডেলিভারিম্যানের চাকরি করতেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত রাতে তার মৃত্যু হয়। চিকিৎসক রাত ৯টা ৪০ মিনিটে যখন নাহিদের মৃত্যু ঘোষণা করেন, তখন হাসপাতালে উপস্থিত তার স্ত্রী ডালিয়া সুলতানা কান্নায় ভেঙে পড়েন। ছয় মাস আগে বিয়ে করার পর নাহিদ ও ডালিয়া ঢাকার কামরাঙ্গীরচরে বাসা ভাড়া করে থাকতেন।
গতকাল প্রথম প্রহর থেকে শুরু করে দিনভর দফায় দফায় সংঘর্ষে এই প্রথম কারও মৃত্যু হলো। ঢাকা মেডিকেল কলেজে আরও তিনজন এখনও ভর্তি রয়েছেন। তারা হলেন দোকানকর্মী মোরসালিন (২২) ও ইয়াসিন (২৩) ও ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী কানন চৌধুরী (২২)। এদের মধ্যে মোরসালিনের অবস্থা শঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন ডা. আলাউদ্দিন। এর বাইরে স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি আছেন মোশাররফ হোসেন নামে ঢাকা কলেজের আরেক শিক্ষার্থী। তাকে আইসিইউতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
পুলিশের নিউ মার্কেট জোনের সহকারী কমিশনার শরীফ মোহাম্মদ ফারুকুজ্জামান জানান, বিকালে দিক থেকে সংঘর্ষের তীব্রতা কমে আসছিল। সন্ধ্যায় ইফতারের সময়টা মোটামুটি চুপচাপই পার হয়। কিন্তু রাত পৌনে ৮টার দিকে ব্যবসায়ীরা আবার রাস্তায় জড়ো হয়ে বিক্ষোভ শুরু করে। ছাত্ররাও ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে রাস্তায় অবস্থান নেয়। আমরা তখন ব্যবসায়ীদের লাঠিচার্জ করে ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছি।
শিক্ষার্থীদের একটি অংশ লাঠিসোঁটা হাতে কলেজ ফটকের সামনের সড়কে অবস্থান নিয়ে আছে। তাদের একটি অংশ কলেজের অধ্যক্ষের কার্যালয়ের বাইরে বিক্ষোভ করছে। সেখানে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে অবরুদ্ধ করে হল খালি করে দেওয়ার নির্দেশ প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছে তারা।
ছোট-বড় ইটের টুকরো, ভাঙা জিনিসপত্র আর পুলিশ ব্যারিয়ার মিলে ঢাকা কলেজ থেকে চন্দ্রিমা সুপার মারকেট পর্যন্ত রাস্তা দেখে আর রাস্তা বলে চেনার উপায় নেই।
নিউ মার্কেট জোনের অতিরিক্ত উপ কমিশনার শাহেন শাহ সন্ধ্যায় বলেন, আপাতত সংঘর্ষ বন্ধ। তবে পুলিশ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। আমাদের আরো দেখতে হবে, পরিস্থিতি কোন দিকে যায়।
এই সংঘর্ষের কারণে সায়েন্স ল্যাব থেকে নিউ মার্কেট পর্যন্ত অন্তত ৭৫টি মার্কেট বন্ধ রয়েছে বলে দোকান মালিকরা জানিয়েছেন। ঈদের এই ভরা মৌসুমে সংঘর্ষ আর দোকানপাট বন্ধ থাকায় উদ্বেগ রয়েছে তাদের মধ্যে। দফায় দফায় সংঘর্ষে অন্তত অর্ধশত আহত হয়েছেন, শিক্ষার্থী ও দোকানকর্মী ছাড়াও পথচারী, হকার, সাংবাদিক রয়েছেন তাদের মধ্যে।
সোমবার নিউ মার্কেটে একটি খাবারের দোকানের কর্মীদের সঙ্গে কয়েকজন শিক্ষার্থীর বিতণ্ডার জের ধরে ঢাকা কলেজের ছাত্রদের সঙ্গে ব্যবসায়ী ও দোকানকর্মীদের সংঘর্ষ শুরু হয়। রাত ১২টা থেকে শুরু করে প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে দুই পক্ষের মধ্যে দফায় দফায় ধাওয়া, পাল্টা ধাওয়া চলে। শেষ পর্যন্ত রাত আড়াইটার দিকে পুলিশ টিয়ার শেল ও রাবার বুলেট ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। রাতের ঘটনার প্রতিবাদে গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ছাত্ররা মানববন্ধন করতে আবার রাস্তায় জড়ো হয়। এ সময় ব্যবসায়ীরাও বেরিয়ে এলে সংঘর্ষ শুরু হয়। দুই পক্ষের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া আর ঢিল য়ুদ্ধ চলে বিকাল পর্যন্ত, পুরো নিউ মার্কেট এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। সংঘর্ষের মধ্যে বেশ কয়েকজন সংবাদকর্মী দোকান কর্মচারীদের হামলার শিকার হন। ওই পথে একটি অ্যাম্বুলেন্সও ভাঙচুর করে তারা।
ওই এলাকায় মোবাইল ইন্টারনেটের গতি কমিয়ে দেওয়া হয়েছে বলেও বিকালে খবর আসে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে। সেখানে অবস্থানরত অনেকেই মোবাইলে ঠিকমত নেট না পাওয়ার কথা বলেছেন, যদিও কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা দেয়নি।
হলে থাকার আশ্বাসে মুক্ত অধ্যক্ষ : দিনভর সংঘর্ষের মধ্যে ঢাকা কলেজ বন্ধ ও হল খালি করার ঘোষণা দিয়ে তোপের মুখে পড়া অধ্যক্ষ এটিএম মইনূল হোসেন ছাত্রদের ‘হলে থাকতে দেওয়ার আশ্বাস’ দিয়ে ক্যাম্পাস ছেড়েছেন। ক্যাম্পাস থেকে রাত সাড়ে আটটার দিকে বেরিয়ে তিনি পান্থপথে স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন গুরুতর আহত শিক্ষার্থী মোশাররফ হোসেনকে দেখতে যান। কলেজের ব্যবস্থাপনা চতুর্থ বর্ষের এ ছাত্র ওই হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি রয়েছেন।
এদিকে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনিও আহত শিক্ষার্থীতে দেখতে স্কয়ার হাসপাতালে যান। এছাড়া আহত শিক্ষার্থী রজব রায়হান ও কানন চৌধুরীকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে দেখতে যান তিনি।
২শ কোটি টাকার ক্ষতির আশঙ্কা : সংঘর্ষে স্থবির হয়ে পড়েছে নিউ মার্কেটসহ আশপাশের মার্কেটগুলোর বেচাকেনা। ঈদের আগে বেচাকেনা বন্ধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। দেড় দিন ধরে চলা এই সংঘর্ষে বন্ধ রয়েছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ফলে ২০০ কোটি টাকার বেশি ক্ষতির আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। গত রাতে এই আশঙ্কার কথা জানান বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন।
